বিদেশি চিহ্নিত হলেই আসাম সরকার নির্দেশ দিচ্ছে, 'ভারত ছাড়'
২১ নভেম্বর ২০২৫
২০০৬ সালের মামলার ভিত্তিতে অক্টোবরে 'একতরফা রায়ে' পাঁচজনকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করেছিল আসামের শোণিতপুর জেলার একটি ফরেনার্স ট্রাইবুনাল(এফটি)। ঠিক এক মাস পর স্থানীয় প্রশাসন তাদের নোটিশ দিয়ে জানায়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারতের সীমানা ছাড়তে হবে। সরকারের দাবি, ১৯৫০ সালের ইমিগ্র্যান্টস (এক্সপালশন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট অনুযায়ী এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, এটা বিরল ঘটনা।
শোণিতপুরের সীমান্ত পুলিশ ২০০৬ সালে পাঁচজনের নামে রেফারেন্স পাঠিয়েছিল। সেই মামলাগুলোই এবছর আবার ট্রাইবুনালে তোলা হয় এবং একতরফা শুনানির ভিত্তিতে তেজপুরের এফটি–২ ট্রাইবুনাল হনুফা, আমজাদ আলি, মরিয়ম নেসা, ফাতেমা ও মনোয়ারা নামের পাঁচজনকে ‘বিদেশি’ ঘোষণা করে। এদের মধ্যে চারজন মহিলা এবং একজন পুরুষ। আদালতের নথি অনুযায়ী, প্রত্যেকেই জামুগুড়িহাট থানার ধোবোকাটা গ্রামের বাসিন্দা।
গত ১৮ নভেম্বর শোণিতপুরের জেলাশাসক আনন্দ কুমার দাস নোটিশ জারি করেন। তাতে উল্লেখ করা হয়, রায় হাতে পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ভারতীয় ভূখণ্ড ছেড়ে যেতে হবে। তিনটি নির্দিষ্ট রুট, ধুবরি, শ্রীভূমি ও দক্ষিণ সালমারা–মানকাচর, উল্লেখ করে বলা হয়, এগুলো সরাসরি বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছে যায়। তাদের বলা হয়, নির্দেশ অমান্য করলে সরকার আইন অনুযায়ী তাদের রাজ্য থেকে অপসারণ করবে।
জেলাশাসক দাস স্থানীয় মিডিয়াকে বলেছেন, “তাদের বিরুদ্ধে প্রায় দুই দশক পুরনো মামলা ছিল। সেপ্টেম্বর মাসে সরকারের নতুন সিদ্ধান্তের পর মামলাগুলো পুনরায় যাচাই করা হয়। প্রাথমিক নোটিশ পাঠানো হলেও তারা আদালতে হাজির হননি। একতরফা শুনানিতে ট্রাইবুনাল তাঁদের বিদেশি ঘোষণা করেছে। এখন ১৯৫০ সালের এক্সপালশন আইনের অধীনে আমরা তাদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছি। অমান্য করলে পুলিশ তাদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেবে।”
শিলচরের ট্রাইবুনালের প্রাক্তন বিচারক ও আইনজীবী ধর্মানন্দ দেব ডিডাব্লিউকে জানান, ''দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসী প্রবেশের পরিপ্রেক্ষিতে কেন্দ্র ১৯৫০ সালে যে আইন করেছিল, সেটাই ইমিগ্রান্টস (এক্সপালশন ফ্রম আসাম) অ্যাক্ট। পরে আসামে বিদেশি শনাক্তকরণে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের ব্যবস্থা চালু হয়। কিন্তু সম্প্রতি ১০ সেপ্টেম্বর, আসাম মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেয় যে বিদেশি বিতাড়নে ফের ১৯৫০ সালের আইন ব্যবহার করা হবে। তারা একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর (এসওপি) জারি করে।''
ধর্মানন্দ জানান, ''এই আইনে জেলাশাসক স্তরের আধিকারিকরা সন্দেহজনক বিদেশিদের সরাসরি বহিষ্কার-নোটিশ দিতে পারেন। আইনটি তখনও জরুরি ছিল, আজও আছে। শোণিতপুরে যে নির্দেশ হয়েছে সেটা বেআইনি নয়, তবে বিরল ও নতুন। ভবিষ্যতে হয়তো এমন ঘটনা আরও দেখা যাবে।”
'পাঁচজন নিখোঁজ'
শোণিতপুরের পুলিশ সুপার বরুণ পুরকায়স্থ ডিডাব্লিউ–কে জানান, অভিযুক্ত পাঁচজনকে এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, “মামলার সময় ঠিকানায় নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। রায় ঘোষণার পরেও পাঠানো হয়। তবে ১৮ নভেম্বরের নোটিশ হাতে পাওয়ার পর পুলিশ তাঁদের গ্রামে গেলে দেখা যায়—এই নামের কেউ আর সেখানে থাকে না। পাঁচজনের ক্ষেত্রেই একই ঘটনা ঘটেছে। যেহেতু নির্দেশ অমান্য করলে তাঁদের সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়ার কথা বলা আছে, তাই আমরা খোঁজে নেমেছি। দু’দিন ধরে অভিযান চলছে, এখনও তাদের পাওয়া যায়নি।”
ধোবোকাটা গ্রামের বাসিন্দারা জানান, পাঁচজনই দুই পরিবারের সদস্য এবং বহু বছর আগেই গ্রাম ছেড়ে গেছেন। ২০০৬ সালে নোটিশ জারির পর থেকেই পুলিশ প্রায়ই এসে জিজ্ঞাসাবাদ করত, দিনে-রাতে ডেকে পাঠাত। প্রায় ১২ বছর আগে তারা হঠাৎ গ্রাম ছেড়ে চলে যান।
কেন এই পদ্ধতি নেওয়া হলো?
এতদিন ট্রাইবুনাল কাউকে বিদেশি চিহ্নিত করার পর তাদের বাংলাদেশে পুশ ব্যাক করানো হচ্ছিল। পুশ ব্যাক নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদতের গ্রহণ করতে চায়নি। জোর করে মানুষদের সীমান্তের ওপারে পাঠানো নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়েছে। পরিবার আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে। এই ক্ষেত্রে দেখা গেলো, নতুন পদ্ধতিতে বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
সেপ্টেম্বর মাসে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছিলেন তারা এবার থেকে পদ্ধতি বদল করছেন কারণ গত দু'বছরে প্রায় প্রত্যেক দিন আসামে অবৈধ পথে ভারতে প্রবেশ করার বিদেশী নাগরিকরা ধরা পড়েছে। তিনি বলেন, "আমরা এত বছর ধরে এই সমস্যায় ভুগছি তবে এখন পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিদেশি নাগরিক বিতরণের আইনি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি ১৯৫০ সালের আইনটি এখনো অসমে ব্যবহার করা যাবে।"
তিনি জানান, আইনটি কি বলছে এবং এটি ব্যবহারের নীতি কি হওয়া উচিত, এটা পর্যালোচনা করে এক বিশেষজ্ঞ দল। এরপরেই নতুন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "এবার থেকে আমাদের নীতি পরিষ্কার, বিদেশি বিতারণের ক্ষেত্রে দশ দিনের বেশি সময় নষ্ট করা হবে না। আমরা আগের মত ট্রাইবুনালে গিয়ে রায়ের পর রায় এবং পরবর্তীতে ডিটেনশন ক্যাম্পে রেখে তাদের পাঠানোর লম্বা প্রক্রিয়ায় সময় নষ্ট করবো না। ধরা পড়ার ১০ দিনের মধ্যে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেওয়া হবে বিদেশীদের এবং আইন বলছে এটা আমরা করতে পারি।"
বিশেষজ্ঞদের মত
গৌহাটি হাইকোর্টের আইনজীবী তানিয়া লস্কর মনে করেন এই নতুন প্রক্রিয়াটি সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক। তিনি ডিডাব্লিউ কে বলেন, "নাগরিকত্ব বিষয়টি আইনের প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই যাওয়া প্রয়োজন তবে সরকার এখন একে প্রশাসনিক স্তরে নিয়ে আসতে চাইছে। যেখানে একজন সরকারি আধিকারিক ইচ্ছেমতো কাউকে বিদেশি মনে করে দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিতে পারেন। তবে এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে উদ্বেগের দিক হচ্ছে, যাকে নিয়ে গোটা প্রক্রিয়া হচ্ছে তার নিজের কথা বলার জায়গা থাকছে না। ঠিক যেমনটা শোনিতপুরে হয়েছে। আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, এই পাঁচজনকে একতরফা বিচারে বিদেশি ঘোষণা করে দেশ ছাড়া নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের নিজের দিক তুলে ধরার সুযোগ দেওয়া হয়নি। এটা অমানবিক এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি ভয়ংকর দৃষ্টান্ত।"
শিলচরের সমাজকর্মী কমল চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, বাংলাভাষী মানুষদের নাগরিকত্ব বারবার প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো হয়েছে। ২০০৬ সালে যারা আসামে ছিলেন, যার প্রমাণ পুলিশের নেওয়া মামলার নথিতেই আছে। এত বছর পর হঠাৎ একতরফা রায়ে এদের বিদেশি ঘোষণা, তারপর মাত্র ২৪ ঘণ্টার সময় দিয়ে দেশ ছাড়তে বলা, এটা কতটা মানবিক?”
তিনি আরও বলেন, ''বিদেশি শনাক্তকরণে বহু আইন আছে, কিছু কিছু আইন পরস্পরবিরোধী। যখন আইন প্রয়োগ ধর্ম দেখে হয়, তখনই এর অপব্যবহার ঘটে। সরকারকে আরও মানবিক হতে হবে।”