অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ৷ এই দেশের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুময় সমুদ্র সৈকত, রয়েছে সুন্দরবন আর অসাধারণ সুন্দর পাহাড়ি এলাকা৷ আর অতিথিপরায়ন সাধারণ মানুষ৷ তা সত্ত্বেও বিদেশি পর্যটকদের বড় ঘাটতি কেন?
বিজ্ঞাপন
পর্যটনের প্রতি বাংলাদেশিদের আগ্রহ কতটা সেটা বোঝা যায় ছোট্ট একটা পরিসংখ্যানে৷ গত সেপ্টেম্বর মাসে ভারতে সর্বোচ্চ সংখ্যক বিদেশি পর্যটক কোন দেশ থেকে গিয়েছিল জানেন? বাংলাদেশ থেকে৷ হ্যাঁ, বাংলাদেশের মানুষ পর্যটক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করছেন ভারতে৷ এতে করে আর্থিকভাবে ব্যাপক লাভবান হচ্ছে দেশটি, আর এই লাভ সব দেশই চায়৷
শুধু ভারত কেন, ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও পর্যটক হিসেবে যাচ্ছেন বাংলাদেশীরা৷ এই সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে৷ তবে হতাশার দিকে হচ্ছে, বাংলাদেশে বিদেশিদের আগমন বাড়ছে না৷ বিশ্বব্যাংকের হিসেবে গত কয়েক বছরের মধ্যে ২০০৮ সালে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে গিয়েছিল৷ আর ২০১৪ সালে এই সংখ্যাটা ছিল এক লাখের কিছু বেশি৷ গত জুনে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলায় বেশ কয়েকজন বিদেশি নিহতের ঘটনার পর সংখ্যাটি যে কমবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷
তবে একটি হামলা একটি দেশের পর্যটন খাতকে পুরোপুরি ধসিয়ে দেবে এমনটা ভাবাও বোধহয় ঠিক নয়, কেননা, সন্ত্রাসী হামলা শুধু বাংলাদেশে হয় না, বিশ্বের অনেক ধনী রাষ্ট্রেও হচ্ছে৷ তাই নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারলে এই হামলার ক্ষত নিরাময়ে খুব বেশিদিন লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস৷
আসলে বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের যা নিশ্চিত করা উচিত, তা হচ্ছে ‘স্বাধীনতা'৷ পর্যটকরা নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করে যখন কোথাও বেড়াতে যান, তখন সেখানে নিজের স্বাধীনতাটুকু নিশ্চিত করতে চান৷ এর মধ্যে থাকতে পারে, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সঙ্গীকে নিয়ে মুক্তভাবে বিচরণের সুযোগ৷ সমুদ্রতটে একজন পশ্চিমা পর্যটক বিকিনি পরে ঘুরতে চাইবেন, যেটা খুবই স্বাভাবিক৷ অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশেও সেটা স্বাভাবিকভাবেই নেয়া হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে বিষয়টি কি সেই পর্যায়ে পৌঁছেছে?
বিকিনি পরাটাও ব্যক্তি স্বাধীনতার একটি অংশ৷ কক্সবাজার এবং সেন্টমার্টিন এলাকায় বিদেশি পর্যটকদের পোশাকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পারলে পর্যটকের সংখ্যা অনেকটা বাড়তে পারে৷ এর সঙ্গে যোগ হতে পারে পর্যটন এলাকাগুলোতে রাতের বেলা তাদের মুক্তভাবে বিচরণের স্বাধীনতা নিশ্চিতের বিষয়টি৷ এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায়িত্ব অনেক৷ যেসব এলাকায় বিদেশি পর্যটক যেতে পারেন, সেসব এলাকার মানুষকে পর্যটন কিভাবে আর্থিকভাবে তাদের লাভবান করতে পারে, সেই বিষয়ে সচেতন করা যেতে পারে৷ তখন স্থানীয়রাই চাইবেন, বিদেশি পর্যটক বেশি করে আসুক৷ আর নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশকেও আরো দায়িত্বশীল হতে হবে৷
পর্যটন খাতকে এগিয়ে নেয়ার আরেকটি বড় উপায় হচ্ছে বিজ্ঞাপন৷ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে চমৎকার সব বিজ্ঞাপন প্রচার করে৷ এসব বিজ্ঞাপনের মধ্যেই একজন পর্যটক দেশটিতে কতটা স্বাধীনতা পাবেন সেটা বুঝিয়ে দেয়া হয়৷ আমার মনে হয়, বাংলাদেশ এই দিক দিয়ে বেশ পিছিয়ে আছে৷ বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারে, দেশটির এমন সব দিক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে৷ এক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে৷ ইংরেজি ভাষায় ভ্রমণ বিষয়ক বিভিন্ন ব্লগে যাতে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক লেখালেখি করা হয়, সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন৷ এক্ষেত্রে জনপ্রিয় নারী ব্লগার ও ভিলগারদের বাংলাদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে৷ তাদের লেখালেখি বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ বাড়াতে পারে৷
বন্ধুরা, দেশি পর্যটকদের বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট করতে আর কী করা যেতে পারে? আপনাদের মতামত জানা, লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷
বাংলাদেশের জনপ্রিয় ১৫টি পর্যটন কেন্দ্র
পৃথিবীর মানচিত্রে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ৷ সমুদ্র-পাহাড়-নদী – সব পর্যটন আকর্ষণই আছে এই দেশটিতে৷ বাংলাদেশের ১৫টি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রের কথা তুলে ধরা হলো এখানে৷
ছবি: DW/M. Mamun
দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত
পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার৷ প্রায় ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য৷ কক্সবাজারকে তাই বলা হয় বাংলাদেশের পর্যটন রাজধানী৷ কক্সবাজার শহরে গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মানের হোটেল-রিসোর্ট৷
ছবি: DW/M. Mamun
একমাত্র প্রবাল দ্বীপ
বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন৷ টেকনাফ থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার সমুদ্র গর্ভে জেগে ওঠা এ দ্বীপটির আয়তন প্রায় ১৬ বর্গকিলোমিটার৷ এ দ্বীপের মূল আকর্ষণ সৈকত জুড়ে প্রবাল পাথরের মেলা, সারি সারি নারিকেল বৃক্ষ, দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া সমুদ্রের নীল জলরাশি আর স্থানীয়দের বিচিত্র জীবনযাপন৷ প্রায় দশ হাজার লোকের বসবাস এই দ্বীপে৷ এ দ্বীপের আরেক নাম ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’৷
ছবি: DW/M. Mamun
নির্জন সমুদ্র সৈকত
বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরিবিলি ও পরিচ্ছন্ন সমুদ্র সৈকত টেকনাফ৷ নির্জনে যারা অবকাশ যাপন পছন্দ করেন, তাদের জন্য আদর্শ ভ্রমণ গন্তব্য এটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাহাড় চূড়ায় নীলগিরি
বান্দরবান জেলাসদর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরের এ পর্যটন কেন্দ্রটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত৷ এখান থেকে মেঘ ছুঁতে পারেন পর্যটকরা৷ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত এ পর্যটন কেন্দ্রটিতে কয়েকটি রিসোর্টও আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
মেঘে ঢাকা নীলাচল
বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ার পাহাড়চূড়ায় জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র নীলাচল৷ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬০০ ফুট উচ্চতায় এ পর্যটন কেন্দ্রটিতে মেঘের লুকোচুরি দেখা যায়৷ নীলাচল থেকে পাখির চোখে দেখা যায় বান্দরবান শহরকেও৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাহাড়ের বাঁকে কাপ্তাই লেক
পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে প্রায় ১৭৬০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কাপ্তাই লেক রাঙ্গামাটির অন্যতম ভ্রমণ গন্তব্য৷ কাপ্তাই লেকের ঝুলন্ত সেতু পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয়৷ এছাড়া কাপ্তাই লেকের অন্যতম আকর্ষণ নৌকা ভ্রমণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পাথর বিছানো বিছনাকান্দি
সিলেট জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলার রুস্তমপুর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা বিছনাকান্দি পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়৷ পাথর বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তরের উপরে বয়ে চলা মেঘালয়ের পাহাড়ী ঝরনাধারা বিছনাকান্দির মূল আকর্ষণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা ষাট গম্বুজ
দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহর বাগেরহাটে অবস্থিত ষাট গম্বুজ মসজিদ৷ ১৯৮৩ সালে এটি বাংলাদেশের তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানের একটি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে৷ নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদটিতে মূলত একাশিটি গম্বুজ আছে৷ খান জাহানের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি এটি৷ ধারণা করা হয়, ষাট গম্বুজ মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের কিুছুকাল আগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন
বাংলাদেশ ও ভারতজুড়ে প্রায় দশ হাজার বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ এর বাংলাদেশ অংশের আয়তন প্রায় ছয় হাজার বর্গ কিলোমিটার৷ ১৯৯৭ সালে সুন্দরবন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় ৭৯৮তম বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ বিপন্ন বেঙ্গল টাইগারের নিরাপদ আবাসস্থল এটি৷ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে যায়গাটি বেশ পছন্দের৷
ছবি: DW/M. Mamun
রাঙ্গামাটির ছাদ সাজেক ভ্যালি
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট উচ্চতায় সাজেক ভ্যালিকে বলা হয় ‘রাঙ্গামাটির ছাদ’৷ ভৌগোলিক অবস্থান রাঙামাটিতে হলেও যাতায়াতের সহজ পথ খাগড়াছড়ি হয়ে৷ সাজেকের আশপাশের গ্রামগুলোতে লুসাই,পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা আদিবাসীদের বসবাস৷ কমলা চাষের জন্য বিখ্যাত সাজেকে কফিও চাষ করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
দক্ষিণের ভাসমান বাজার
দক্ষিণের জেলা শহর ঝালকাঠী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে ভিমরুলি গ্রামের কৃত্তিপাশা খালের শতবর্ষের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী ভাসমান বাজার৷ প্রায় সারা বছরই এ হাট বসলেও পেয়ারা ও আমড়ার মৌসুমে প্রায় তিন মাস এ হাট জমজমাট থাকে৷ সপ্তাহের প্রতিদিনই বসে ভাসমান এ হাট৷ ঝালকাঠী থেকে ছোট ছোট খালে ঘুরে এ সব এলাকার মানুষের বিচিত্র জীবনযাত্রাও দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাগরকন্যা কুয়াকাটা
সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা পটুয়াখালীর শেষপ্রান্তে অবস্থিত৷ এটি বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত যেখানে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায়৷ এছাড়া কুয়াকাটার পাশেই আছে ফাতরার বন, যেটি সুন্দরবনেরই একটি অংশ বিশেষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দির
পুরনো ঢাকার প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঢাকেশ্বরী মন্দির৷ কিংবদন্তী আছে রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের জঙ্গলে দেবী দুর্গার একটি মূর্তি পেয়ে একটি মন্দির নির্মাণ করে সেটিকে সেখানে স্থাপন করেন৷ আর নাম দেন ঢাকেশ্বরী মন্দির৷ অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই ঢাকেশ্বরী নাম থেকেই ‘ঢাকা’ নামের উৎপত্তি৷
ছবি: DW/M. Mamun
লালবাগ দুর্গ
পুরনো ঢাকার লালবাগে অবস্থিত এ দুর্গটি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে শাহজাদা আজাদ ১৬৭৮ সালে নির্মাণ শুরু করেছিলেন৷ পরে শায়েস্তা খান এসে ১৬৮৪ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ করেন৷ এ দুর্গের ভেতরে পরীবিবির সমাধি, দরবার হল ও তিন গম্বুজ বিশিষ্ট তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
প্রাচীন স্থাপনা সমৃদ্ধ সোনারগাঁও
প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম থেকেই সোনারগাঁও নামের উদ্ভব৷ বঙ্গ অঞ্চলে মুসলমানদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে ১৬১০ সালে ঢাকা নগরের অভ্যুদয়ের আগ পর্যন্ত সোনারগাঁও ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের প্রশাসনিক কেন্দ্র৷ সোনারগাঁও এলাকার প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খাসনগর দীঘি, দুলালপুরের নীলকুঠি, গোয়ালদি শাহী মসজিদ, আমিনপুর মঠ, দামোদরদি মঠ, পানাম নগরের আবাসিক ভবন, বড় সরদার বাড়ি প্রভৃতি৷