ডলার সংকটের মধ্যেই আরেকটি নেতিবাচক খবর দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ ২০২২ সালের তুলনায় গত বছর সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে ১৪ শতাংশের মতো৷
বিজ্ঞাপন
পাশাপাশি অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশ থেকে বিদেশিদের পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে৷ ২০২২ সালে বিদেশি বিনিয়োগ ছিল সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার৷ সেখানে গত বছর এটা নেমে গেছে তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে৷ অন্যদিকে ২০২২ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়া হয়েছিল ৬ কোটি ৪৭ লাখ ডলার৷ গত বছর নেওয়া হয়েছে ৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার৷ গত মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে৷
অন্যদিকে দুর্বল অবকাঠামো, সংস্কারের ধীরগতি ও অর্থায়নে অসুবিধার কারণে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশেরও অবনতি হয়েছে৷ চলতি অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্সে (বিবিএক্স) এ তথ্য উঠে এসেছে৷ বৃহস্পতিবার এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে৷
বিদেশিরা কেন বিনিয়োগ কমিয়ে উল্টো পুঁজি নিয়ে যাচ্ছে? জানতে চাইলে হামীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সংসদ সদস্য এ কে আজাদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা যখন বিদেশিদের বিনিয়োগের কথা বলি, তখন তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস দেওয়ার আশ্বাস দেই৷ কিন্তু আমরা তো তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দিতে পারছি না৷ পাশাপাশি গ্যাসের চাপ দিন দিন কমে যাচ্ছে৷ আমাদের কারখানাগুলোতেই ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে৷ এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন বিনিয়োগ করবেন? আবার সবাই তো বিনিয়োগ করা অর্থ বা লভ্যাংশ ফেরত নিতে চায়৷ কিন্তু ডলার সংকটের কারণে তারা লভ্যাংশও নিতে পারছে না৷ এসব কারণেই হয়ত বিদেশি বিনিয়োগ কমছে৷”
এমন পরিস্থিতিতে তারা কেন বিনিয়োগ করবেন?: এ কে আজাদ
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে দেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে রেকর্ড পরিমাণে৷ এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, নিট হিসাবে কমেছে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ৷ এর বিপরীতে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ৷ দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ৷ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়েছে৷
প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে এফডিআই এসেছিল ৪৮২ কোটি ৭৩ লাখ ডলার৷ ২০২৩ সালে এসেছে ৩৯৬ কোটি ৯৮ লাখ ডলার৷ এক বছরের ব্যবধানে এফডিআই কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ, যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় রেকর্ড৷ অতীতে এত বেশি হারে কখনোই এফডিআই কমেনি৷ বৈশ্বিক মন্দার কারণে বাংলাদেশে এফডিআই কমেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে৷ তবে ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআই বেড়েছে ২ দশমিক ২ শতাংশ৷ ২০২১ সালে এফডিআই এসেছিল ৩৮৮ কোটি ৩৩ লাখ ডলার৷
বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিদেশি বিনিয়োগ কমার অনেকগুলো কারণ আছে৷ শুধু একটি কারণে তো আর বিদেশি বিনিয়োগ কমে না, একটার সঙ্গে আরেকটার সম্পর্ক আছে৷ প্রথমত সুশাসন৷ অর্থাৎ দুর্নীতি কমাতে হবে৷ দ্বিতীয়ত, অবকাঠামো ও যোগাযোগ৷ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু যেভাবে হচ্ছে তাতে বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার মতো না৷ প্রয়োজনীয় যোগাযোগগুলো আরও বাড়াতে হবে৷ তৃতীয়ত, বন্দরগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ এখানে মানুষ হয়রানির শিকার হন৷ বন্দরের ব্যবস্থাপনা গতিশীল করতে হবে৷ এরপর রয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা৷ একটা ফাইল, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিতে লম্বা সময় লাগে৷ এটাও কমাতে হবে৷ এছাড়া সরকারের পলিসিতেও সংকট আছে৷ আমাদের ট্যাক্স পলিসিও ব্যবসা বান্ধব না৷ সবকিছু মিলিয়েই বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাচ্ছে৷”
বাণিজ্য ও হুন্ডির আড়ালে টাকা পাচারের যত কৌশল
বৈধভাবে স্থানান্তরের সহজ উপায় না থাকলেও বিদেশে ঠিকই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন অনেক বাংলাদেশি৷ বিপুল টাকা রাখছেন ব্যাংকেও৷ এই অর্থপাচারের কৌশলগুলো কী জেনে নিন ছবিঘরে...
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো
ধরা যাক শিল্প কারখানার জন্য এক লাখ ডলারের যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খুললেন দেশের কোনো আমদানিকারক৷ কিন্তু এই পণ্যের প্রকৃত মূল্য ৫০ হাজার ডলার৷ মূল্য বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিলেন বিক্রেতাকে৷ সেই ব্যক্তি তার দামটি রেখে বাকি টাকা আমদানিকারকের বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ এতে দেশ থেকে ৫০ হাজার ডলার পাচার হয়ে গেল৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘ওভার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images
রপ্তানির মূল্য কম দেখানো
ধরা যাক দেশের কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার ডলারের পণ্য বা সেবা রপ্তানির ঘোষণা দিলেন, যদিও তার প্রকৃত মূল্য এক লাখ ডলার৷ পণ্য পৌঁছানোর পর ক্রেতা দেশে ৫০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠালেন, আর অঘোষিত ৫০ হাজার ডলার তার বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে এভাবে রপ্তানিকারক দেশে অর্জিত ৫০ হাজার ডলার পাচার করলেন৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Yu Fangping/Costfoto/picture alliance
পণ্যের পরিমাণে হেরফের
শুধু টাকার গড়মিল না, আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের হিসাবের গড়মিলের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়৷ যেমন, কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার পিস পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে এক লাখ পিস রপ্তানি করতে পারেন৷ এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পিসের টাকা তিনি বিদেশে পাচার করলেন৷ উল্টোভাবে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ অতিরিক্ত দেখিয়ে বেশি দাম পরিশোধের মাধ্যমে টাকা পাচার হতে পারে৷
ছবি: Saudi Press Agency/REUTERS
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের আরেকটি উপায় হলো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা৷ কোনো পণ্য আমদানি না করেই ভুয়া ঋণপত্র এবং শুল্ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভুয়া ছাড়পত্র দেখিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়৷ অনেক সময় একই পণ্যের আমদানির বিপরীতে একাধিক ঋণপত্র খুলে সেই পণ্যের নামে একাধিকবার টাকা পাঠানো হয়৷ সহজে যাতে ধরা না পড়েন তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন টাকা পাচারকারীরা৷
ছবি: imago/blickwinkel
টাকা পাঠানোর ভিন্ন চ্যানেল বা হুন্ডি
প্রবাসীরা জটিলতা এড়াতে স্বীকৃত পদ্ধতির বদলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠান, যা হুন্ডি নামে পরিচিত৷ এই পদ্ধতিতে তারা বিদেশে কোনো ব্যক্তির কাছে বা কোনো মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করেন৷ হুন্ডি পরিচালনাকারী নেটওয়ার্ক সমপরিমাণ টাকা প্রবাসীর পরিবারকে পরিশোধ করে দেয়৷ এতে পরিবার টাকা বুঝে পেলেও প্রবাসীর অর্জিত মূল্যবান অর্থ দেশে পৌঁছে না৷ টাকা পাচার করতে চান- এমন কারো বিদেশি অ্যাকাউন্টে হয়ত তা চলে যায়৷
ছবি: Imago/Steinach
কর স্বর্গে ছায়া কোম্পানি
পাচার করা অর্থ বিদেশে রাখা ও কর ফাঁকি দেয়ার আরেকটি প্রচলিত উপায় হলো ‘কর স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বেনামে কোম্পানি খোলা৷ এই কোম্পানিগুলোর সাধারণত কাগজ-কলমেই অস্তিত্ব থাকে৷ কয়েক স্তরে এমনভাবে এর মালিকানা আড়াল করা হয় যে প্রকৃত ব্যক্তির নাম জানা কঠিন হয়ে পড়ে৷ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ জমা রাখা, নিজ দেশের বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়া ও পাচারকৃত টাকা আড়াল করতে এই ধরনের কোম্পানি ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷
ছবি: Imago/M. Bäuml
বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব
বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলে৷ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা এই সুযোগ লুফে নেন৷ ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের মাল্টা, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, লুক্সেমবুর্গে বিদেশিদের জন্য এমন স্কিম আছে৷ এই ‘গোল্ডেন ভিসা স্কিম’-এর মাধ্যমে ইইউ দেশগুলো গত দশকে আড়াই হাজার কোটি ডলার আয় করেছে৷ এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সাইপ্রাস ও স্পেন৷
ছবি: DW/A. de Loore
কর স্বর্গে বাংলাদেশিরা
পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা হংকংয়ের মতো কর স্বর্গে বিভিন্ন সময়ে কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশিরাও৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজে-র ফাঁস হওয়া চারটি নথিতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ১০২ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা ৪৩টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২১-২২ অর্থবছরে শতকরা ২০ থেকে ২০০ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি মূল্যের ৮,৫৭১টি অর্থপাচারের ঘটনা শনাক্ত করে৷ এই সংখ্যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি৷ ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর৷ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বছরে চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের হিসাবে, বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করে কর ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় চার হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা হারাচ্ছে৷ এই অর্থ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৩১ শতাংশ ও শিক্ষার ছয় শতাংশের বেশি৷ মাথাপিছু হিসাবে দুই ডলার বা ২০০ টাকার উপরে৷ এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ৩৭ কোটি ডলার ও ব্যক্তি পর্যায়ে ফাঁকির পরিমাণ দুই কোটি ৬০ লাখ ডলার৷
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
গোল্ডেন ভিসায় বাংলাদেশিরা
বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি পরিচিত গোল্ডেন ভিসা স্কিম নামে৷ গত কয়েক বছরে ক্যানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের এই সুযোগ নেয়ার খবর উঠে এসেছে৷ যেমন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে ন্যূনতম এক লাখ ২৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে হয়৷ দেশ থেকে বৈধভাবে এত টাকা স্থানান্তরের সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই স্কিম ব্যবহারে উপরের দিকে আছেন৷
ছবি: bdnews24.com
পরিসংখ্যানে অর্থ পাচার
কোন দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয় তা বোঝার একটি কৌশল আমদানি-রপ্তানি করা দেশ ও গন্তব্যের পরিসংখ্যান তুলনা করা৷ তার ভিত্তিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সম্ভাব্য ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমান ছিল ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা আট হাজার কোটি টাকার বেশি৷
ছবি: Stefan Klein/imagebroker/picture alliance
12 ছবি1 | 12
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরের ব্যবধানে বিদেশ থেকে পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা কমেছে ৩১ শতাংশ৷ ২০২২ সালে পুঁজি হিসাবে এফডিআই এসেছিল ১০২ কোটি ৬৩ লাখ ডলার৷ ২০২৩ সালে এসেছে ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার৷ ২০২১ সালের তুলনায় পুঁজি হিসাবে এফডিআই আসার প্রবণতা আরো কম অর্থাৎ, ৩৮ শতাংশ কমেছে৷ ২০২১ সালে পুঁজি হিসাবে এফডিআই এসেছিল ১১৩ কোটি ৮৭ লাখ ডলার৷ গত ৩ বছরের মধ্যে গত বছর বিদেশি পুঁজি সবচেয়ে কম এসেছে৷
এফডিআইয়ের প্রবাহ কমায় ও দেশ থেকে পুঁজি তুলে নেওয়ায় দেশে এফডিআইয়ের স্থিতিও কমেছে৷ ২০২২ সালে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল ২ হাজার ৭ কোটি ৫৫ লাখ ডলার৷ ২০২৩ সালে তা আরো কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪ কোটি ৯২ লাখ ডলারে৷ একই সময়ে নিট এফডিআই কমেছে ৫ দশমিক ১ শতাংশ৷ ২০২১ সালের তুলনায় এফডিআইয়ের স্থিতি কমেছে আরো বেশি, অর্থাৎ ৬ দশমিক ৯ শতাংশ৷ ওই বছরে এফডিআইয়ের স্থিতি ছিল ২ হাজার ১৫৮ কোটি ১৯ লাখ ডলার৷ গত ৩ বছরের মধ্যে এফডিআইয়ের স্থিতি এখন সবচেয়ে কম৷
এফডিআইয়ের স্থিতিও কমার কারণ জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের সাবেক অর্থনীতিবিদ এম মাসরুর রিয়াজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর মূলত তিনটি কারণ৷ একটি কারণ সম্প্রতি তৈরি হয়েছে৷ সেটা হলো গত দুই বছর ধরে আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতি অত্যন্ত চাপের মুখে আছে৷ এই চাপ থেকে বের হতে ডলারের প্রয়োজন৷ সেটার সরবরাহ তো বাড়ছে না৷ আবার দেখেন আমাদের নিম্ন আয়ের দেশ থেকে উত্তরণ ঘটছে৷ সেখানে আমরা যাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছি সেই ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, ভারতের চেয়ে আমাদের বিনিয়োগের পরিবেশ ভালো না৷ বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাও বাড়েনি৷ ব্যবসার পরিবেশ, বাণিজ্য নীতি, লজিস্টিক খাত ও পুরোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো এর পেছনের কারণ৷”
আকৃষ্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতাও বাড়েনি: এম মাসরুর রিয়াজ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর নেদারল্যান্ডস থেকে এসেছে বিনিয়োগ এসেছে ৩৬৬ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩১৪ দশমিক নয় মিলিয়ন ডলার, চীন থেকে ২৫৯ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন ডলার, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ১৮১ দশমিক ৪৩ মিলিয়ন ডলার ও নরওয়ে থেকে ১৭৬ দশমিক ৮৭ মিলিয়ন ডলার৷
বিশ্বব্যাপী পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া, পণ্য সরবরাহে ঝামেলা হওয়া, বৈদেশিক চাহিদায় মন্দা ও হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার কারণে চলতি মাসের শুরুতে রিজার্ভ ১৯ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়৷ ২০২১ সালের আগস্টে তা ছিল ৪০ দশমিক সাত বিলিয়ন ডলার৷ এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলাসবহুল ও অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি সীমাবদ্ধ করতে বাধ্য হয়৷ গত দুই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার দাম কমেছে ৩৪ শতাংশ৷
ফরেন ইনভেস্টর্স চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাহী পরিচালক টিআইএম নুরুল কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, "বিদেশি বিনিয়োগ কমার কারণ আমরা বিশ্লেষণ করেছি৷ সেখানে আমরা দেখেছি, সরকারের কিছু রেগুলেশনে অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে৷ ধরেন, প্রনোদনা পেয়ে কিছু বিনিয়োগ হয়েছিল৷ এক বছর পরই সেই প্রনোদনা তুলে নেওয়া হলো৷ এরপর তাদের উপর এসডি, ভ্যাট চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ এতে ব্যবসার খরচ বেড়ে যাচ্ছে৷ এখন বিদেশিরা তো এক বছরের পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করেন না৷ তারা দীর্ঘ সময়ের পরিকল্পনা নিয়ে আসেন৷ অনেক সময় তারা বিদ্যমান বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকেও ধারণা নেন৷ সেখানে যদি তারা দেখেন পলিসিতে অনিশ্চয়তা আছে, তাহলে তো তারা এখানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না৷”
এদিকে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে দেশে ব্যবসার পরিবেশের আরো অবনতি হয়েছে৷ এবার ব্যবসা পরিবেশ সূচকে অর্জিত পয়েন্ট হয়েছে ৫৮ দশমিক ৭৫, যা গত আগের অর্থবছরে ছিল ৬১ দশমিক ৯৫৷ চলতি অর্থবছরের ব্যবসা পরিবেশ সূচক বা বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স)-এ তথ্য উঠে এসেছে৷ বৃহস্পতিবার এমসিসিআইয়ের গুলশান কার্যালয়ে এ জরিপের চিত্র তুলে ধরা হয়৷ তৃতীয়বারের মতো বিবিএক্স জরিপ পরিচালনা করেছে মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ৷ ব্যবসায়ীদের মধ্যে করা জরিপের মাধ্যমে এ সূচক তৈরি করা হয়েছে৷
কোন মেগা প্রকল্পে কত বিদেশি ঋণ
বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের সরকার কয়েকটি মেগা প্রকল্প শেষ করেছে৷ আরও কিছু সমাপ্তির পথে৷ কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷ বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে বলে সম্প্রতি জানিয়েছে সিপিডি৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
রাশিয়া ১,১৩৮ কোটি ডলার দিচ্ছে ঋণ দিচ্ছে৷ ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ এই ঋণের সুদের হার হচ্ছে, লাইবর রেট (একসময় বৈশ্বিক সুদহার নির্ধারণের অন্যতম মাপকাঠি ছিল লন্ডন ইন্টার-ব্যাংক অফারড রেট বা লাইবর রেট) এবং সঙ্গে আরও ১.৭৫ শতাংশ৷ ইতিমধ্যে ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে৷
ছবি: Abdul Goni/AFP/Getty Images
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ
এই প্রকল্পে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ এই ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ চলতি অর্থবছর থেকে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Shamsul Haque Ripon
ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
প্রকল্পটিতে ১১২ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন৷ সুদহার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর৷ ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৬ সালে৷
ছবি: Rehman Asad/NurPhoto/picture alliance
পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
এই প্রকল্পে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক৷ এই ঋণের সুদহার লাইবরের সঙ্গে ২.৯৮ শতাংশ৷ ৪ বছর গ্রেসসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷ বর্তমানে এই ঋণের বিপরীতে প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে৷ ২০২৬-২৭ অর্থবছর নাগাদ তা ৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua News Agency/picture alliance
মেট্রোরেল
এই প্রকল্পের জন্য জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জাইকার কাছ থেকে ১৯ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে৷ ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে প্রায় ৬৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে৷ ৩০ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
কর্ণফুলী টানেল
এই প্রকল্পে ৬,০৭০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে চীন৷ সুদসহ এটি ফেরত দিতে হবে৷ চলতি অর্থবছরে ঋণ পরিশোধ শুরু হবে৷
ছবি: Salim/Xinhua/picture alliance
দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৭ সালে এডিবির সঙ্গে ১৫০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছিল৷ ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে৷
ছবি: Ehsan Kutubi
ভারতীয় ঋণগুচ্ছ
তিনটি লাইনস অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত ৭৩৬ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷ গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ১৬৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে৷ এসব ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ৷ ভারতীয় ঋণ পরিশোধের সময় পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর৷ তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প শেষ হয়েছে৷ চলমান আছে আটটি প্রকল্প৷
ছবি: Al-emrun Garjon/AP/picture alliance
ঋণ নিয়ে বিদেশি ঋণ শোধ
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান গত ৪ এপ্রিল ঢাকায় ‘বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ ও ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন৷ এইসময় তিনি বলেন, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে সরকারকে এখন ঋণ করতে হচ্ছে৷
ছবি: Patrick T. Fallon/AFP/Getty Images
দ্বিপক্ষীয় ও দাতা সংস্থার ঋণের পার্থক্য
চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরের মধ্যে শোধ করতে হবে৷ আর বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং জাপানের মতো দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে সাধারণত ৩০-৩৫ বছরের মধ্যে শোধ করার সুযোগ থাকে৷