চীনের উইগুর মুসলিম অধ্যুষিত শিনজিয়াং রাজ্যের অধ্যাপক ইমিনজান সায়দিনকে তিন বছর আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল৷ সম্প্রতি তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়৷
বিজ্ঞাপন
বাবার মুক্তির জন্য ক্যাম্পেন চালাচ্ছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সামিরা ইমিন৷
মুক্তি পাওয়ার পর এক ভিডিওতে তাঁর বাবা বিদেশে থাকা চীনবিরোধীদের দ্বারা বিভ্রান্ত না হতে তাঁকে পরামর্শ দিয়েছেন বলে ডয়চে ভেলেকে জানান সামিরা ইমিন৷
তিনি বলেন, তাঁর বাবা খুব একটা ধার্মিক ছিলেন না৷ ধর্মপালনে তিনি সাধারণত চীন সরকারের নীতি মেনে চলার চেষ্টা করতেন৷
২০১৭ সালের মে মাসে সায়দিনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়৷ এরপর ২০১৯ সালে ফেব্রুয়ারিতে ‘মৌলবাদী মতাদর্শ উসকে’ দেয়ার অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ সম্প্রতি হঠাৎ করে তাঁকে মুক্ত করে দেয়া হয়৷
অধ্যাপনার পাশাপাশি সায়দিন ২০১২ সালে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালু করেন৷ সেখান থেকে তিনি আরবি ব্যাকরণের উপর একটি বই প্রকাশ করেছিলেন৷ এর বাইরে প্রযুক্তি, শিক্ষা, মনস্তত্ত্ব ও নারী বিষয়ে ৫০টির বেশি বই প্রকাশ করেছেন৷
চীন সরকার গত তিন বছরে কয়েকশ বুদ্ধিজীবীসহ হাজার হাজার মানুষকে ধরে নিয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে রেখেছে বলে অভিযোগ রয়েছে৷ মুসলমানদের ‘পুনরায় শিক্ষিত’ করতে এসব ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়৷
এই প্রশিক্ষণ ‘ঐচ্ছিক’ বলে দাবি করে চীন সরকার৷ কিন্তু গত নভেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস' জানায়, এসব ক্যাম্পে বন্দিদের আদর্শ ও আচরণগত প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে তাঁদের মনোজগতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়৷
তুরস্কে কেমন আছে উইগুর মুসলিমরা
বিশ্বের অন্যতম নিপীড়িত এক জাতি চীনের উইগুর মুসলিমরা৷ এই সম্প্রদায়ের অনেকেই বসবাস করছেন তুরস্কে৷ সেখানেও বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন তাঁরা৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
উইগুরদের পরিচয়
উইগুররা মূলত চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসরত একটি মুসলিম সম্প্রদায়৷ চীনের স্বিকৃত ৫৫টি সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর একটি তাঁরা৷ চীন ছাড়াও কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও সৌদি আরবেও এই জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/epa/H. H. Young
চীনা নিপীড়ন
চীনে উইগুরদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় বাধা-নিষেধ আরোপ রয়েছে৷ উইগুরসহ দেশটির ১০ লাখের বেশি মুসলমানদের আলাদা নজরদারিতে রেখেছে সরকার৷ জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা এ পরিস্থিতিকে বন্দীদশার সাথে তুলনা করেছে৷ তবে ইসলামি জঙ্গীবাদ ঠেকাতে এমন উদ্যোগ বলে দাবি চীনের৷
ছবি: Getty Images/K. Frayer
উইগুরদের তুর্কি যোগাযোগ
তুর্কি ভাষাভাষি উইগুরদের তুরস্কের সংস্কৃতির সাথে নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে৷ চীনের জিনজিয়াংয়ে তাঁদের করুণ পরিস্থিতি নিয়ে একমাত্র এই দেশটিই নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে৷ ১৯৬০-এর দশক থেকে উইগুরদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ও তুরস্ক৷ ‘ইস্ট তুর্কেস্থান ন্যাশনাল সেন্টার’ নামের একটি সংস্থার হিসাবে দেশটিতে বর্তমানে ৩৫,০০০ উইগুর বসবাস করছে৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
তুরস্কেও বিপাকে উইগুররা
তিন-চার বছর আগ পর্যন্ত তুরস্কে বসবাসে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি উইগুরদের৷ কিন্তু বেইজিংয়ের সাথে আংকারার সুসম্পর্কের জের ধরে সেই ধারার পরিবর্তন হয়েছে৷ নির্বাসিত উইগুরদের সংগঠন ‘অ্যাসেম্বলি অফ ইস্ট তুর্কেস্তান’-র প্রধান সাইদ তুমতুর্ক জানান, তাদের কিছু সদস্য সিরিয়ার বাসার আল-আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদি লড়াইয়ে অংশ নেয়ায় চীন তুরস্কের উপর চাপ দিয়েছে৷ এতে উইগুরদের বিরুদ্ধে তুরস্কের মনোভাবও পাল্টে গেছে৷
ছবি: Reuters/Murad Sezer
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার শঙ্কা
২০১৫ সালে স্ত্রী আর সন্তানদের নিয়ে বাধ্য হয়ে তুরস্কে পাড়ি জমান নূরমুহাম্মদ৷ পরিবারের অন্যরা পেলেও বসবাস আর কাজ করার অনুমতি পাননি তিনি৷ এমন অবস্থায় তুরস্ক সরকার তাঁকে বের করে দেয়ার শঙ্কায় রয়েছে নূরমুহাম্মদ৷ জিনজিয়াংয়ে বসবাসরত স্বজনদের সাথেও যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
চীনে বন্দী সন্তান
২০১৬ সালে দাদা-দাদির সাথে দেখা করতে চীনের জিনজিয়াংয়ে যান নূরমুহাম্মদের সন্তান পাকজাত৷ পৌছানোর পর বিমানবন্দর থেকেই চীন সরকার তাকে বন্দী করে বলে খবর পেয়েছেন তাঁরা৷ ‘‘আমার সন্তানকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন সে ১৬ বছরের এক শিশু৷ তার ছোট ভাই-বোনরা অনবরত প্রশ্ন করে, বড় ভাইয়ের সাথে তারা কবে একসাথ হবে?’’ রয়টার্সকে জানান পাকজাতের মা গুলজিন মাহমুত৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
পাসপোর্ট জটিলতা
তুরস্কে চীনা দূতাবাস সেখানে বসবাসরতদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে তা আর নবায়ন করছে না৷ একটি কাগজ দেয়া হয়, যার মাধ্যমে তাঁরা চীনে ফেরার সুযোগ পান৷ অন্যদিকে ২০১৭ সালে এক উজবেক নাগরিক ইস্তানবুলে নাইট ক্লাবে হামলা চালিয়ে ৩৯ জনকে হত্যার পর তুরস্ক সরকারও কিছুটা সতর্ক অবস্থান নিয়েছে৷ সেখানে কাজের অনুমতি না পাওয়ায় দেশটিতে বসবাসরত উইগুররা তাঁদের ভবিষ্যত নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছেন৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
আশার আলো
চীনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রায়ই তুরস্কে প্রতিবাদে অংশ নেন উইগুর জনগোষ্ঠী৷ তাঁদের অধিকার আদায়ে তুরস্কই এখনও একমাত্র ভরসা৷ গত মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসোগলু উইগুরদের বিরুদ্ধে চীনের দুর্ব্যবহারের সমালোচনা করেন ও ধর্মপালনের স্বাধিনতা দেয়ার আহ্বান জানান, যা উইগুরদের নতুন করে আশার আলো দেখাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
8 ছবি1 | 8
সায়দিনের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছে বলে মনে করছেন তাঁর মেয়ে ইমিন৷ তিনি জানান, ৪ মে বন্ধুদের কাছ থেকে তিনি জানতে পারেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র চায়না ডেইলি তাঁর বাবার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে৷ ঐ ভিডিওতে তাঁর বাবার বক্তব্য অদ্ভুত শুনিয়েছে বলে জানান ইমিন৷ ভিডিওতে সায়দিন বলেন, ‘‘সম্প্রতি বিদেশে থাকা চীনবিরোধী কিছু পক্ষ আমার মেয়েকে বিভ্রান্ত করেছে৷ তারা দাবি করছে, আমাকে অবৈধভাবে আটক করা হয়েছিল৷ এসব কথা বিভ্রান্তিকর ও অর্থহীন৷ আমি খুব ভালো আছি, মুক্ত আছি৷''
ভিডিওতে সায়দিন তাঁর মেয়েকে ‘বিভ্রান্তিকর গুজব’ বিশ্বাস না করতে এবং ‘তাঁর আটকের বিষয়ে' বিদেশে মিথ্যা তথ্য না ছড়ানোর পরামর্শ দেন৷
সায়দিন আরো বলেন, কমিউনিস্ট পার্টি ও সরকারের সহায়তা ছাড়া তিনি কোনোদিন অধ্যাপক হতে পারতেন না৷ বিদেশে পড়ার সুযোগ পাওয়ার জন্য দলকে ধন্যবাদ জানাতেও মেয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি৷
সায়দিন বলেন, ‘‘আমাদের পরিবারের প্রতি পার্টি ও সরকারের দয়া ছাড়া এসব অর্জন করা অসম্ভব ছিল৷’’
মেয়ের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমার বিশ্বাস ছিল তুমিও এভাবেই চিন্তা কর৷ কিন্তু তুমি যা বলেছো তা শুনে আমার হৃদয় ভেঙে গেছে৷ আমার মেয়ে কীভাবে এমন কথা বলতে পারে?’’
পরবর্তীতে বাবার সঙ্গে কথা বলার সময়ও তিনি একই ধরনের পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান ইমিন৷ তিনি তাঁকে কোনো ধরনের অ্যাক্টিভিজমে না জড়াতে পরামর্শ দেন৷ ‘খারাপ লোকেদের’ কথা না শুনতেও মেয়েকে পরামর্শ দেন বাবা সায়দিন৷
বাবার এমন কথাবার্তায় মেয়ে ইমিনের মনে হচ্ছে, বাবা আসলেই মুক্ত কিনা৷
এবারই প্রথম নয়
বিদেশে বসবাসরত উইগুরদের শায়েস্তা করতে শিনজিয়াংয়ে থাকা আত্মীয়স্বজনদের দিয়ে এমন ভিডিও রিলিজের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে৷
উইগুর হিউম্যান রাইটস প্রজেক্টের কর্মকর্তা পিটার আরউইন ডয়চে ভেলেকে বলেন, শিনজিয়াংয়ে থাকা মানুষদের দিয়ে বিদেশে থাকা তাদের পরিবারের সদস্যদের ফোন করতে বলছে সরকার৷ ফোনে তাদের চীনে ফিরে আসতে বলার পরামর্শ দিতে বলা হয়েছে৷
চীন সরকার ইমিনের মতো ঘটনা কাজে লাগিয়ে বিদেশে থাকা উইগুরদের মুখ বন্ধ করতে চাইছে বলেও মন্তব্য় করেন আরউইন৷
উইলিয়াম ইয়াং, তাইপে/জেডএইচ
মুসলিমদের শিবির যেভাবে চালায় চীন
চীনের শিনজিয়াং রাজ্যে মুসলমানদের ‘পুনরায় শিক্ষিত’ করতে অনেকগুলো ক্যাম্প পরিচালনা করা হয়৷ এই প্রশিক্ষণ ‘ঐচ্ছিক’ বলে দাবি করে সরকার৷ কিন্তু প্রকাশিত নথি বলছে অন্য কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/File
নির্দেশনা
চীনের শিনজিয়াং রাজ্যের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় দশ লাখ মুসলমান বন্দি রয়েছেন৷ এসব ক্যাম্প কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে ২০১৭ সালে একটি নির্দেশনা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ৷ রবিবার ১৭টি গণমাধ্যমে একযোগে সেটি প্রকাশিত হয়েছে৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র ‘ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস’ আইসিআইজে-কে এই নির্দেশনাটি দিয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/AP Photo/File
স্বেচ্ছায় নয়, বাধ্য করা হয়
চীন সরকারের দাবি, এসব ক্যাম্পে মুসলমানরা স্বেচ্ছায় প্রশিক্ষণ নিতে যান৷ কিন্তু প্রকাশিত নির্দেশনা বলছে, ক্যাম্পে বন্দিদের প্রথমে আদর্শ ও আচরণগত প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে তাঁদের মনোজগতে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়৷ এরপর অন্য জায়গায় তাঁদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Z. Shuai
নিরাপত্তা ব্যবস্থা
বন্দিদের কেউ যেন পালাতে না পারেন সেজন্য ২৪ ঘণ্টাই তাঁদের নজরে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে ক্যাম্প কর্মীদের৷ এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও তাঁদের নজরে রাখতে বলা হয়েছে৷ এছাড়া নিরাপত্তা টাওয়ার নির্মাণ, ডাবল-লক দরজা, অ্যালার্ম ও প্রবেশ দরজাসহ সব জায়গায় ভিডিও নজরদারির ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Baker
বন্ধুত্ব করা নিষেধ
বন্দিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে ক্যাম্পের কর্মীদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে৷ এছাড়া গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে কর্মীরা মোবাইল ফোন কিংবা ক্যামেরা নিয়ে ক্যাম্পে ঢুকতে পারেন না৷
ছবি: Reuters/T. Peter
ক্যাম্পের বাসিন্দা যাঁরা
মূলত উইগুর মুসলমান৷ এছাড়া কাজাখসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুসলমানদেরও এসব ক্যাম্পে রাখা হয়েছে৷ ছবিতে একটি শ্রেণিকক্ষ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুরুর কথা
বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে প্রায় বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন উইগুর সম্প্রদায়ের মানুষ৷ ২০০৯ সালে শিনজিয়াং-এর রাজধানী উরুমকিতে বিক্ষোভে প্রায় ২০০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন৷ এরপর ২০১৪ সালে উইগুর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছুরি হামলায় ২৯ জন নিহত হন৷ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের জন্য ক্যাম্প চালু করে চীন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অস্বীকার
প্রকাশিত নথির তথ্য ঠিক নয় বলে দাবি করেছেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গেং শুয়াং৷ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে চীনের লড়াইকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করায় গণমাধ্যমের সমালোচনা করেন তিনি৷