বিদেশে বাংলাদেশিদের সম্পদের ব্যাপারে দুদক কেন নীরব?
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৬ জানুয়ারি ২০২৩
দেশের বাইরে সম্পদ বা বাড়ি করা বাংলাদেশিদের ব্যাপারে দেশের উচ্চ আদালত বার বার দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়ে যাচেছন৷ কিন্তু দুদকের নিজের উদ্যোগে তদন্ত শুরুর নজির খুব কম৷ আর তদন্তে শেষ পর্যন্ত কী হয় তাও জানা যায় না৷
বিজ্ঞাপন
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের(টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘হাইকোর্টকে যে এই বার বার নির্দেশ দিতে হয় তাতে প্রমাণ হয় যে যাদের এই কাজ তারা ঠিকমত তাদের দায়িত্ব পালন করছে না৷
তবে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘আমাদের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে আইনি প্রক্রিয়ায় এগোতে হয়৷ এটা সময়সাপেক্ষ৷’’
দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ
সর্বশেষ দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির সম্পদ কেনার অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে দুদকসহ চার সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট৷ দুদক ছাড়াও সিআইডি, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) এই নির্দেশ দেয়া হয়৷
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রোববার এই আদেশ দেন৷ ৩০ দিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছেন আদালত৷ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য ধরে একটি রিটের শুনানিতে এই নির্দেশ দেয়া হয়৷
গত ১১ জানুয়ারি একটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হয় যে দুবাইয়ে ৪৫৯ বাংলাদেশির এক হাজারের মতো প্রপার্টি আছে৷ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তথ্য গোপন করে দুবাইয়ে প্রপার্টি কিনেছেন ওই ৪৫৯ বাংলাদেশি৷ ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি সম্পত্তি ক্রয়ের তথ্য পাওয়া গেছে৷ কাগজে-কলমে যার মূল্য সাড়ে ৩১ কোটি ইউএস ডলার৷
তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী: ড. ইফতেখারুজ্জামান
ওয়াসার এমডির ১৪ বাড়ি
এর কয়েকদিন আগে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক(এমডি) তাকসিম এ খানের যুক্তরাষ্ট্রে ১৪টি বাড়ি থাকার খবর প্রকাশিত হয় সংবাদমাধ্যমে৷ এরপর ৯ জানুয়ারি হাইকোর্টের একই বেঞ্চ ওই বাড়ির বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয় দুদককে৷ তবে ওয়াসার এমডি অবশ্য যুক্তরষ্ট্রে তার স্ত্রীর নামে একটি বাড়ি থাকার কথা স্বীকার করেন৷ আর সব সম্পদের কথা অস্বীকার করেছেন৷
এর আগে যারা দেশের বাইরে অর্থ পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়ে তুলেছেন তাদের একটি তালিকা দুদকের কাছে চায় হাইকোর্ট৷ গত বছরের ২৭ জানুয়ারি এরকম মোট ৬৭ জনের তালিকা হাইকোর্টে জমা দেয় দুদক তবে ওই তালিকায় বিস্তারিত তথ্য না থাকায় আদালত তখন অসন্তোষ প্রকাশ করেন৷ এর আগেও আদালতের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর ২৯ ব্যক্তি ও ১৪ প্রতিষ্ঠানের তালিকা দেয়৷
লন্ডনের অভিজাত এলাকায়ও বাংলাদেশিরা
হাইকোর্টের সর্বশেষ নির্দেশের পরও বিদেশে বাংলাদেশিদের অঢেল সম্পদ থাকার তথ্য প্রকাশ হয়েছে৷ ১৫ জানুয়ারি একটি বাংলা দৈনিক খবর দিয়েছে লন্ডনের অভিজাত এলাকায় বাড়ির মালিক বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন৷ খবরে বলা হয়, প্রাইম সেন্ট্রাল লন্ডনে প্রপার্টি ক্রেতাদের মধ্যে বিদেশি এখন ৪০ শতাংশ৷
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ধনীদের বিনিয়োগ কোটায় অভিবাসনসংক্রান্ত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্টনস এই তথ্য জানিয়েছে৷ তারা বলছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে ওই এলাকায় ৯৮টি লেনদেনের মাধ্যমে প্রায় ১২ কোটি ২৯ লাখ পাউন্ড মূল্যের প্রপার্টি কিনেছেন বাংলাদেশিরা৷ যা বাংলাদেশি মুদ্রায় এক হাজার ৫৬১ কোটি টাকা৷
‘হাইকোর্টের সবশেষ দুইটি আদেশের সার্টিফায়েড কপি আমরা পাইনি’
মন্ত্রী জানে, দুদক জানে না
২০২১ সালের জুন মাসে খোদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল জানান যে কানাডায় ২৮ জন বাংলাদেশির বাড়ি কেনার তথ্য আছে তার কাছে৷ তিনি তখন জানান, ‘‘ওই ২৮ জনের চারজন মাত্র রাজনীতিবিদ, বাকিরা সরকারি কর্মকর্তা৷ কিন্তু দুদক সেই তথ্য নিয়ে আগে কাজ করেনি৷ সংবাদ মাধ্যমে এছাড়াও অষ্ট্রেলিয়া,মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের সম্পদের তথ্য ছাপা হয়৷ কানাডায় ‘বেগম পাড়া’ বলে পরিচিতি পেয়েছে বাংলাদেশিদের আবাসিক এলাকা৷ সেখানে বাংলাদেশি প্রবাসীদের একাংশ বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনেক দিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন৷ সম্প্রতি কানাডা বিদেশিদের বাড়ি কেনার ওপর দুই বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে৷
দুদক কী করে
দুদকের মানিলন্ডারিং অনুবিভাগ থেকে পাওয়া আংশিক তথ্য মতে, মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত এপর্যন্ত মোট ১১৭টি মামলা দায়ের হয়েছে, এর মধ্যে ৮৩টি মামলার তদন্ত চলছে৷ ৩২টি মামলায় চার্জশিট ও দুটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্টসহ ৩৪টি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে, তদন্তাধীন ৮৩টি মামলায় ১১ জন আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে৷
এই বিভাগের তথ্যে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, হংকং, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করা হয়েছে৷ পাচারের ধরনের ক্ষেত্রে দুদকের তিনটি মামলর ক্ষেত্রে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে ঋণ নিয়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাচার করার বিষয় তদন্তে পাওয়া গেছে৷ অন্যান্য ক্ষেত্রে হুন্ডি, ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিং না নগদ টাকা করা হয়েছে তা দুদক এখনো তদন্ত করে নির্ধারণ করতে পারেনি৷
তবে ২০২০ সালে হাইকোর্টে দাখিল করা দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, দুদক ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থ পাচারের অপরাধে ৪৭টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ও ৮৮টি মামলা তদন্ত করছে৷ পাচারের তুলনায় সামান্য অর্থ তারা ফেরতও এনেছে৷
সুইস ব্যাংকে টাকা পাচারকারী কারা?
55:44
দায় কার?
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘‘বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে৷ তবে শুধু দুদক নয়, এটা প্রতিরোধের দায়িত্ব বাংলদেশ ব্যাংক, এনবিআর, সিআইডির৷ হাইকোর্টের এইসব ঘটনা তদন্তে বার বার নির্দেশ দেয়া প্রমাণ করে যে, যাদের এটা প্রতিরোধের দায়িত্ব তারা ঠিকমত দায়িত্ব পালন করছেন না৷''
তার কথা, ‘‘এর অনেক কারণ থাকতে পারে৷ অর্থসংক্রান্ত অপরাধ ধরার মতো সক্ষমতা না থাকা আবার দুদক আইনেরও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে৷ এগুলো হয়তো যুক্তি হতে পারে৷ কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, দুবাইয়ের ঘটনায় যা দেখলাম যারা অর্থ পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়েছেন তারা সবাই প্রভাবশালী৷ তারা রাজনৈতিকভাবেও প্রভাবশালী৷ আইনে আছে, আন্তর্জাতিক আইনে আছে তারপরও তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ হয় না৷ বিষয়টি এখন ধরলে হাত পুড়ে যাবার মতো অবস্থা হয়েছে৷ ''
আর দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশিদ আলম বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যম তথ্য দিতে পারে৷ কিন্তু সেই সব তথ্য আমাদের সঠিকভাবে আইনগত প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ করতে হয়৷ দেশের বাইরের তথ্য আনতে হলে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স-এর আওতায় আনতে হয়৷ এটা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার৷''
তার কথা, ‘‘আমরা প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করে তা যাচাই বাছাই করি৷ তথ্য সঠিক হলে আমরা অভিযোগ গঠন( মামলা) করি৷ তারপর আবার তদন্ত এবং চার্জশিট হয়৷ তথ্য প্রমাণ সঠিক না হলে তো মামলা প্রমাণ করা যায় না৷''
তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সংবাদ মাধ্যম থেকে যেরকম তথ্য পাই৷ তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকেও অভিযোগ পাই৷''
‘হাইকোর্ট সর্বশেষ যে দুইটি বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন সেই আদেশের সার্টিফায়েড কপি আমরা পাইনি৷ পেলে তদন্ত শুরু হবে৷ তবে আমি কমিশনকে মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি, জানান এই আইনজীবী৷
দুদকের সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান
২০০৪ সালে দুদক যাত্রা শুরু করে৷ ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ড. ইফতেখারুজ্জামানের দাবি, দুদক চুনোপুঁটিদের ধরে, রাঘব বোয়ালদের ধরে না৷ তবে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলমের দাবি, বিএনপিপন্থিরা এসব কথা বলেন৷
ছবি: bdnews24.com
দুদকের মামলায় খালেদা জিয়া কারাগারে
জিয়া এতিমখানা ট্রাস্টের দুই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে করা দুদকের মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার জজ আদালত৷ এরপর তাকে কারাগারে প্রেরণ করা হয়৷ ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়া হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
সাংসদ বদিকে কারাগারে প্রেরণ
২০০৮ ও ২০১৩ সালে নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা সম্পদের বিবরণে মিথ্যা তথ্য দেয়া ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে কক্সবাজারের সাংসদ আবদুর রহমান বদির বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে মামলা করে দুদক৷ এই মামলায় আত্মসমর্পণের পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল৷ তিন সপ্তাহ জেলে থাকার পর জামিন পান বদি৷ এরপর বিচার শেষে ২০১৬ সালে তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও দশ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়৷ সেবারও কদিন জেলে থেকে জামিন পান তিনি৷
ছবি: bdnews24
সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল
২০১৪ সালে দুদকের তদন্তে চার সচিব ও এক যুগ্ম-সচিবের ‘অবৈধ প্রক্রিয়ায়’ মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেয়ার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ এরপর তাদের সনদ বাতিল করা হয়৷ তারা হলেন নিয়াজ উদ্দিন মিয়া (স্বাস্থ্য সচিব), এ কে এম আমির হোসেন (পিএসসির সচিব), মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামান (বেসরকারিকরণ কমিশনের চেয়ারম্যান) এবং মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের দুই ওএসডি কর্মকর্তা মাসুদ সিদ্দিকী (সাবেক সচিব) ও আবুল কাসেম তালুকদার (সাবেক যুগ্ম সচিব)৷
ছবি: bdnews24.com
ফাঁদ মামলা
ঘুসখোর ও দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের হাতেনাতে ধরতে দুদক ফাঁদ পেতে থাকে৷ এভাবে ২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত ৭২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এরপর করোনার কারণে এমন অভিযান বন্ধ হয়ে যায়৷ ২০১৯ সালে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী ড. এস এম নাজমুল হককে (ছবি) ঘুস নেওয়ার সময় দুদক হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল৷ এছাড়া সাব রেজিস্ট্রার, ভূমি কর্মকর্তা, সিটি কর্পোরেশনের উপ-কর কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্মকর্তারাও এভাবে গ্রেপ্তার হন৷
ছবি: bdnews24
পুলিশ ও দুদকের সাবেক কর্মকর্তার জেল
এক নারীকে জোর করে বিয়ের পর নির্যাতন চালানোর অভিযোগে ২০১৯ সালে পুলিশের তৎকালীন ডিআইজি মিজানুর রহমানকে (ডানে) বরখাস্ত করা হয়৷ এর চার মাস পর তার সম্পদের অনুসন্ধানে নামে দুদক৷ সেই দায়িত্ব পেয়েছিলেন দুদকের তৎকালীন পরিচালক খন্দকার এনামুল বাছির৷ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই মিজান দাবি করেন, তার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা ঘুস নিয়েছেন বাছির৷ বুধবার মিজানের তিন বছরের কারাদণ্ড হয়৷ আর দুটি মামলার বাছিরের আট বছরের জেল হয়৷
কারাগারে ডেসটিনির এমডি
সম্পদের হিসাব জমা না দেওয়ার অভিযোগে দুদকের করা মামলায় ডেসটিনির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনকে ২০২০ সালে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে ২০ লাখের বেশি মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১২ সালে মামলা করেছিল দুদক৷ পরে ওই বছরের অক্টোবরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রফিকুল আমীনসহ কোম্পানির অধিকাংশ শীর্ষ কর্মকর্তা৷
ছবি: bdnews24.com
বেসিক ব্যাংকের বাচ্চুর দুর্নীতি পায়নি দুদক
জাতীয় পার্টির সাবেক সাংসদ শেখ আবদুল হাই বাচ্চু বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকার সময় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছিল৷ পরে চাপের মুখে ২০১৪ সালে তিনি পদত্যাগ করেন৷ অনুসন্ধানের পর ২০১৫ সালে ব্যাংকের ১৫৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক৷ কিন্তু এর মধ্যে বাচ্চুর নাম ছিল না৷ অথচ ২০১৬ সালে অর্থমন্ত্রী আব্দুল মুহিত দুটি সংস্থার প্রতিবেদনে অভিযোগের সঙ্গে বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারি
২০১০ থেকে ২০১২ সালের মার্চ পর্যন্ত হলমার্ক গ্রুপ সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকা সরায় বলে অভিযোগ ওঠে৷ গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে তা আমলে নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক৷ তারা ৩৮টি মামলা করে৷ বিচার প্রক্রিয়া এখনো চলছে৷ হল -মার্ক গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম, এমডি তানভীর মাহমুদ এখন আটক আছেন৷ এর মধ্যে ২০১৮ সালে দুদকে সম্পদের হিসাব দাখিল না করায় জেসমিন ইসলামের তিন বছরের জেল হয়েছে৷
ছবি: DW
সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডির কারাদণ্ড
২০১১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের হোটেল শেরাটন শাখা থেকে ডিএন স্পোর্টসের নামে ঋণ নিয়ে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে৷ এই ঘটনার তদন্ত করে ২০১৪ সালে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়৷ এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন এমডি হুমায়ুন কবীরও ছিলেন৷ গত ডিসেম্বরে কবীরসহ ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়৷ হল-মার্ক কেলেঙ্কারিতে দায়ের করা দুদকের বিভিন্ন মামলাতেও আসামি হুমায়ুন কবীর৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Nabil
ব্যাংক কর্মকর্তার যাবজ্জীবন
ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের দুই কোটি ২২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০১৩ সালে মামলা করে দুদক৷ বিচার শেষে ২০১৬ সালে ব্যাংকের এক কর্মকর্তাসহ তিনজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত৷ শাস্তিপ্রাপ্তরা হলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক সহকারী ব্যবস্থাপক সাইফুল হাসান, প্যারাগন নিট কম্পোজিট লিমিটেডের পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন ও পরিচালক সাইফুল ইসলাম৷ রায়ের সময় সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা পলাতক ছিলেন৷
ছবি: Felix Kästle/dpa/picture-alliance
বিনা দোষে জেল
অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের এক মামলায় ২০১৬ সালে পাটকল শ্রমিক জাহালমকে (বামে) গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ মামলায় অভিযুক্তের নামের সাথে মিল না থাকলেও তাকে সাজা দেয়া হয়েছিল৷ ঐ ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর তিন বছর জেল খাটার পর হাইকোর্টের নির্দেশে জাহালম মুক্তি পেয়েছিলেন৷ এছাড়া দুদকের ভুল তদন্তের কারণে ১৫ বছরের কারাদণ্ড পাওয়া নিরপরাধ মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের সাজা গতবছর জানুয়ারিতে বাতিল করে দিয়েছিল হাইকোর্ট৷
ছবি: dnews24.com
বিসমিল্লাহ গ্রুপ
একাধিক ব্যাংক থেকে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি, মুদ্রা পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৩ সালে বিসমিল্লাহ গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাসিব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক খাজা সোলায়মান চৌধুরীসহ ৫৪ জনের বিরুদ্ধে এক ডজন মামলা করেছিল দুদক৷ এর মধ্যে এক মামলায় ২০১৮ সালে খাজা সোলেমান চৌধুরী, নওরিন হাসিবসহ নয়জনকে দশ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত৷
ছবি: YAY Images/imago images
অর্থ পাচার বিষয়ে দুদকের ভূমিকায় আদালতের অসন্তোষ
২০২০ সালে অর্থ পাচার সংক্রান্ত দুদকের এক প্রতিবেদন দেখে হাইকোর্ট অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল৷ জ্যেষ্ঠ বিচারক নজরুল ইসলাম তালুকদার সেইসময় বলেছিলেন, ‘‘বিদেশে এত লোক টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে৷ ক্যানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে কারা নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের নামও পাননি! উই ওয়ান্ট টু সি দুদক কয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে৷ আপনারা অন্ততপক্ষে এটা দেখান যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে৷’’
ছবি: bdnews24.com
এ ব্যাপারে দুদক আইনজীবীর বক্তব্য
বাংলাদেশের কে কত টাকা পাচার করেছে- হাইকোর্ট জানতে চাওয়ার নয় মাস পর গত ডিসেম্বরে কর ফাঁকি সংক্রান্ত পানামা ও প্যারাডাইস কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা বাংলাদেশের ৪৩ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা দিয়েছিল দুদক৷ সেই সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেছিলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন সংশোধন হওয়ায় কেবল ঘুস ও দুর্নীতি থেকে উদ্ভূত (সরকারি কর্মচারীসংশ্লিষ্ট) অর্থ পাচারের অভিযোগ দুদক কর্তৃক অনুসন্ধানযোগ্য৷
ছবি: DW
কোকোর টাকা ফিরিয়ে আনা?
২০১২ ও ২০১৩ সালে তিন দফায় খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিদেশে পাচার করা অর্থ থেকে প্রায় সাড়ে ২১ কোটি টাকা দেশে ফেরতে আনার কথা জানিয়েছিল দুদক৷ সেই সময় বিএনপির তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, কোকো ও বিএনপিকে হেয় প্রতিপন্ন করতেই কথিত পাচার করা অর্থ ফেরত আনার কথা বলা হচ্ছে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণা সূচক ২০০৪-এ বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ও হাইতি যৌথভাবে সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ বলে বিবেচিত হয়েছিল৷ আর ২০২২ সালের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ আছে ১৪৭ নম্বরে৷ ২০২১ সালেও একই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ৷
ছবি: DW
রাঘব বোয়ালদের ধরা হচ্ছে না?
সম্প্রতি রাঘব বোয়ালদের বিরুদ্ধে তদন্তে নেমে চাকরি হারিয়েছেন দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিন (ছবি)৷ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, ‘‘রাঘব বোয়ালদের ধরতে গেলে চাকরি হারাতে হয়, যা দুদক গঠনের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত৷’’ তিনি বলেন, ‘‘দুদক যে উদ্দেশ্যে গঠন করা হয়েছিল তা সফল হয়নি৷’’ তবে দুদকের আইনজীবী আ্যাডভোকেট খুরশীদ আলমের দাবি, ‘‘এসব কথা বলছেন বিএনপিপন্থিরা৷’’
ছবি: Privat
সাজার হার কেমন?
দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ দাবি করেন, ‘‘আমাদের মামলায় শাস্তি পাওয়ার হার শতকরা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ৷ ভবিষ্যতে এটা আরো বাড়বে৷ কারণ দুদকের তদন্তে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে৷ ফরেনসিক ল্যাব করা হচ্ছে৷ ফলে তদন্তে দক্ষতার যে ঘাটতি আছে, তা অনেকটা দূর হবে৷’’