পশ্চিমবঙ্গের চিরন্তন ধর্ম নিরপেক্ষতার আবহাওয়াকে বিষাক্ত করছে যারা, এই মিছিল ছিল তাদের বিরুদ্ধে৷ বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ডাকে ফের পথে নামল কলকাতা৷
ছবি: DW/S.Bandopadhyay
বিজ্ঞাপন
এর আগে এমন মিছিল হয়েছে নন্দীগ্রামে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, কামদুনির গণধর্ষণের বিরুদ্ধে৷ কিন্তু এবারের মিছিলের ইস্যু ছিল আরও গুরুতর৷ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক জমি দখল করতে চাইছে৷ সেই উদ্দেশ্যে তারা খুঁচিয়ে তুলছে হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-ভাবনা৷ প্ররোচনা জোগাচ্ছে সুপ্ত মুসলিমবিদ্বেষে৷ পশ্চিমবঙ্গে আমদানি করা হচ্ছে গনেশ চতুর্থী, রামনবমীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বাঙালিদের মধ্যে যার কোনো চল ছিল না৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে যেহেতু কেবল বাঙালিদেরই বাস নয়, অনেক অবাঙালি হিন্দুও এই রাজ্যে বাস করে, তাদের থেকে খুব সহজে প্রশ্রয় পাচ্ছে হিন্দি বলয়ের ওই ধর্মীয় উন্মাদনা৷ রামনবমীর শোভাযাত্রার নামে অস্ত্র হাতে মিছিল হচ্ছে৷ এমনকি শিশুদেরও সেই অস্ত্র মিছিলে সামিল করা হচ্ছে৷
চন্দন সেন
This browser does not support the audio element.
পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা, যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, সহাবস্থানে বিশ্বাসী, তাঁরা এই বদলাতে থাকা সংস্কৃতির গতি-প্রকৃতি দেখে প্রমাদ গুনছেন৷ কারণ এভাবে চলতে থাকলে পশ্চিমবঙ্গেও যে একদিন সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাত শুরু হয়ে যাবে না, এমনটা আর কেউ জোর দিয়ে বলতে পারছে না৷ সামাজিক পরিবেশের এই বিষিয়ে যাওয়া রুখতে, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের অভিসন্ধিমূলক প্রসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে তাই গণ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়েছিল৷ এই মিছিলের আহ্বায়ক, বিশিষ্ট নাট্য ব্যক্তিত্ব চন্দন সেন ডয়চে ভেলেকে জানালেন, এমন মিছিল শহর কলকাতা খুব কম দেখেছে৷ আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ততার কারণে জেলাগুলি থেকে অনেকেই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আসতে পারেননি৷ তার পরেও প্রায় হাজার পঁচিশেক মানুষ রাস্তায় নেমেছিলেন৷ যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা, নাট্যকর্মী, শিল্পী, গায়ক, সাহিত্যিকরা অংশ নিয়েছিলেন৷ প্রমুখ নামের মধ্যে ছিলেন নাট্য ব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, বর্ষীয়ান চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদার, নবীন পরিচালক অনীক দত্ত, চিত্রকর ওয়াসিম কাপুর৷ প্রবীণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেননি, কিন্তু তিনি একটি বার্তা পাঠান চন্দন সেনকে, যা পড়ে শোনানো হয়৷ সেই বার্তায় সৌমিত্র উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘শিশু-কিশোরদের হাতেও অস্ত্র তুলে দেওয়া হচ্ছে! এই বীভৎসতা আগে দেখিনি৷''
সাম্প্রদায়িকতা কীভাবে দূর করা যায়?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের আট নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে থাকছে তাঁদের কথা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সাদেকা হালিম, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরকে ঢেলে সাজাতে হবে৷ শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে৷ এছাড়া দেশের প্রতিটি মানুষকে যার যার অবস্থান থেকে একসঙ্গে কাজ করলে অসাম্প্রদায়িক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ে তোলা সম্ভব৷ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমেরও ভূমিকা আছে৷ আরেকটি বিষয় হলো, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সকল ধর্মের সবাই মিলে যার যার অবস্থান থেকে একযোগে কাজ করতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
গোলাম কুদ্দুস, সভাপতি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
কোনো ধর্মই মানুষের অকল্যাণের কথা বলে না৷ পৃথিবীর সব ধর্মই মানুষের কল্যাণের কথা বলে৷ তাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেউ যাতে ধর্মের অপব্যাখ্যা করে তাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে৷ দেশের প্রতিটি মানুষকে যদি প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলেও দেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
আইনুন নাহার সিদ্দিকা, আইনজীবী
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সব রকমের রাজনৈতিক উস্কানি বন্ধ করতে হবে৷ আমরা যেন এক ধর্মের মানুষ আরেক ধর্মের পেছনে কখনো না লাগি৷ সবাই সবার ধর্মকে সম্মান করি৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
শেখ শাফায়াতুর রহমান, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কখনো শক্তি আর অস্ত্র দিয়ে লড়াই করা যাবে না৷ আমাদেরকে আমাদের বুদ্ধি আর মেধা দিয়ে লড়াই করতে হবে৷ গ্রামে-গঞ্জে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ছড়িয়ে দিতে হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
রেখা শাহা, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে দেশের সর্বত্র সকল ধর্মের উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ সবাই যেন সবার ধর্মীয় উৎসবগুলোতে অংশ নিতে পারেন, সে পরিবেশ তৈরি করতে হবে৷ এছাড়া সবাই মিলে একটি দুর্নীতি, অন্যায়, অত্যাচারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে পারলে সাম্প্রদায়িকতাও দেশ থেকে দূর হবে৷
ছবি: DW/M.M.Rahman
খরাজ মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা, পশ্চিমবঙ্গ
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ৮৫ শতাংশ মেকআপ আর্টিস্টই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের৷ কই, আমাদের তো সমস্যা হয় না! আমরা মন থেকে কোনও বিভেদে বিশ্বাস রাখি না৷ তাই নিজেদের মধ্যেও বিভেদ জন্মায় না৷ মনের অন্ধকার দূর করাটাই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বড় হাতিয়ার৷
সত্যিকারের জ্ঞান মনের সংকীর্ণতা দূর করে৷ তাই শুধু ডিগ্রি দিয়ে লাভ নেই৷ জ্ঞানের আলো জ্বালাতে প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে৷ সেটাই হবে আদর্শ জ্ঞাননির্ভর সমাজ৷ সেই সমাজ এমন মানুষ তৈরি করবে, যার মধ্যে উগ্রতা থাকবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
পতিতপাবন রায়, পিয়ারলেস, পশ্চিমবঙ্গ
ব্যক্তিগতস্তরে ধর্মীয় অনুশাসন মানতে অসুবিধে নেই৷ কিন্তু সমষ্টিগতস্তরে মানতে হবে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন৷ দেওয়ানি বিধির অধীনে সবাইকে রাখতে হবে৷ রাজনীতির অনুপ্রবেশ রুখে সবার জন্য সমান আইন প্রণয়ন দরকার৷ তবেই রাস্তা আটকে নামাজ পড়া বা মণ্ডপ তৈরি নিয়ে দাঙ্গা হবে না বা রক্তও ঝরবে না৷
ছবি: DW/P. Samanta
8 ছবি1 | 8
তবে রবিবার, কলকাতার ধর্মতলা থেকে রবীন্দ্রসদন পর্যন্ত এই মিছিল যে কারণে আরও স্মরণীয় হয়ে রইল, তা প্রবীণ কবি শঙ্খ ঘোষের উপস্থিতির কারণে৷ অসুস্থ শঙ্খ ঘোষ আসতে পারবেন না, দূর থেকেই সমর্থন জানাবেন, এমনটাই জানা গিয়েছিল৷ কিন্তু প্রবল সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই, অশক্ত শরীরে চলে আসেন শঙ্খ ঘোষ এবং মিছিলের কিছুটা পথ হাঁটেনও৷ যদিও হাঁটতে পারছিলেন না, দু'দিক থেকে দু'জন ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁকে, কিন্তু সর্বজনশ্রদ্ধেয় এই বাঙালি কবির ওই প্রতিবাদদৃপ্ত পদক্ষেপ একটা পর্যায়ে যেন প্রতীকী মাত্রা ধারণ করল৷ মিছিলে তখন স্লোগান উঠছে — বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত৷