‘কোনো ক্ষতি হবে না' – এই তত্ত্ব নিয়েই চলছিল রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ৷ পরে অবশ্য যুক্তি-তর্ক দিয়ে প্রমাণ করা গেল যে, কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে পরিবেশ দূষণ হবেই এবং এতে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবন৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তি দিয়ে যখন এই যুক্তির বিরোধিতা করা যাচ্ছে না, তখন প্রসঙ্গ আনা হলো, তাহলে কাথায় হতে পারে রামপালের বিকল্প জায়গা? বলা হলো, আন্দোলনারীরা বলে দিক রামপালে না হলে, কোথায় হবে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প? কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এটি কোথায় হতে পারে – তা নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা৷
১. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ কয়লা৷ এই কয়লা বাংলাদেশে নেই৷ তাই কয়লা আমদানি করে আনতে হবে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো দেশ থেকে৷ ভারত থেকেও কয়লা আমদানির কথা বলা হচ্ছে৷ যদিও ভারতে এত বিপুল পরিমাণ কয়লা নেই৷ ভারত নিজেও কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে৷ ভারত একবার আমদানি করবে, সেই কয়লা আবার বাংলাদেশ আমদানি করবে – এমন উদ্ভট পরিকল্পনা চলছে কিনা নিশ্চিত নই৷
সুন্দরবন ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে প্রতিক্রিয়া
বিদ্যুৎ অবশ্যই দরকার, বিশেষ করে গরিবদের তো আরো বেশি দরকার৷ তারপরও রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা হবে মর্মান্তিক৷ একদিকে দেশের-দশের প্রয়োজন, অন্যদিকে পরিবেশ বিপর্জয়ের ভয়৷ কী বলছে দেশের মানুষ?
ছবি: picture-alliance/dpa/Pacific Press/M. Hasan
মোশাহিদা সুলতানা, শিক্ষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালেয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা ঋতুর মতে, সুন্দরবনের পাশে এত বড় একটা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ঝুঁকির মধ্যে ফেলা কোনোভাবেই ঠিক হবে না৷ তাঁর মতে, সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই, কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প আছে৷
ছবি: DW
সায়েম ইউ চৌধুরী, পাখি ও বন্যপ্রাণী গবেষক
৪০ বারেরও বেশি সুন্দরবনে গেছেন সায়েম৷ তিনি জানান, সম্প্রতি চট্টগ্রামের একটি সার কারখানা থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ হয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়৷ পুকুরের মাছ, গাছপালা, প্রাণী – সব মারা পড়ে৷ এ রকম ছোট একটা সার কারখানার দুর্ঘটনা থেকে আমাদের পরিবেশ রক্ষা করার সক্ষমতা যেখানে নেই, সেখানে এত বড় একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রে কোনো দুর্ঘটনা হলে আমাদের সরকার কী-ই বা করার থাকবে?
ছবি: DW
মারুফ বিল্লাহ, স্থানীয় বাসিন্দা
মারুফ বিল্লাহর জন্ম রামপালেই৷ ছোটবেলা থেকেই তিনি সুন্দরবনকে ধ্বংস হতে দেখে আসছেন৷ আর এখন সুন্দরবন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করে একে ধ্বংসের আরেক পায়তারা করছে সরকার৷ তিনি জানান, সিডর আর আইলার পরে আমরা দেখেছি ঐ জনপদকে সে যাত্রায় বাঁচিয়েছিল সুন্দরবন৷ এখন যদি আমরাই তাকে মেরে ফেলি, তাহলে জনগণ কোথায় যাবে? তাই তাঁর প্রশ্ন, জীবন আগে, নাকি বিদ্যুৎ আগে?
ছবি: DW
সাইমুম জাহান হিয়া, শিক্ষার্থী
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাইমুম জাহান হিয়া মনে করেন, সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ বন৷ এর পাশে বিশাল আকারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে যে কখনো কোনো দুর্ঘটনা হবে না – এটা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজন আছে, এটা ঠিক, তবে সেটা সুন্দরবনকে ধ্বংস করে নয়৷
ছবি: DW
হাসিব মোহাম্মদ, শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাসিব মোহাম্মদ কয়েকবার সুন্দরবনে গেছেন৷ আসলে এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র তাঁকে সবসময় টানে৷ তাই এ বনের কোনোরকম ক্ষতি করে তিনি এর কাছাকাছি রামপালের মতো কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র চান না৷ গত বছরের কয়েকটি ছোট ছোট জাহাজ সুন্দরবনে ডোবার পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সে কথাও মনে করিয়ে দেন তিনি৷ তাঁর আশঙ্কা, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে জাহাজ চলাচল বেড়ে গিয়ে দুর্ঘটনাও বাড়বে৷
ছবি: DW
মিমু দাস, শিক্ষার্থী
লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র মিমু দাসও মনে করেন, সুন্দরবনের এত কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করা ঠিক হবে না৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার খবর পড়ে তাঁর মনে হয়েছে যে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করবে৷ মিমু বিদ্যুৎকেন্দ্র চান, তবে সেটা অন্য কোথাও৷
ছবি: DW
আদনান আজাদ আসিফ, মডেল ও অভিনেতা
মডেল ও অভিনেতা আদনান আজাদ আসিফ একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফারও৷ কয়েক বছর ধরে সময় পেলেই তিনি সুন্দরবনে ছুটে যান৷ বিশ্বের সবেচেয়ে বড় এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বেঙ্গল টাইগারের একমাত্র আবাসস্থল৷ তাঁর মতে, সুন্দরবন বাংলাদেশের ফুসফুস৷ আর এমনিতেই নানা কারণে এখানে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে হ্রাস পেয়েছে৷ তাই এর কাছাকাছি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এমন কোনো প্রকল্প করে এ বনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া ঠিক হবে না৷
ছবি: DW
আমিনুর রহমান, চাকুরিজীবী
ঢাকার একটি পরিবহন সংস্থায় কাজ করেন আমিনুর রহমান৷ তাঁর মতে, দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ দরকার৷ তাই বড় কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে দেশের জন্য ভালোই হবে৷ তাছাড়া তিনি শুনেছেন যে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে তা সুন্দরবনের কোনো ক্ষতিই করবে না৷
ছবি: DW
আব্দুল আজীজ ঢালী, মধু চাষি
সুন্দরবনে গত ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে মধু আহরণ করেন সাতক্ষীরার আব্দুল আজীজ ঢালী৷ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ বনের সঙ্গে থাকতে চান তিনি৷ সুন্দরবনে থাকলেও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে কিছুই জানেন না আব্দুল আজীজ৷
ছবি: DW
ভবেন বিশ্বাস, মাছ শিকারি
ভবেন বিশ্বাসের জীবিকার অন্যতম উৎস সুন্দরবন৷ উদবিড়াল দিয়ে এ বনে তিনি মাছ ধরেন ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে৷ তাঁর বাবা ও ঠাকুরদাদার এ পেশা এখনো তিনি ধরে রেখেছেন৷ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে এ খবর তিনি শুনে থাকলেও, এর ভালো বা খারাপের দিকগুলো – কিছুই জানা নেই তাঁর৷ তবে সুন্দরবনকে তিনি ভালোবাসেন, খুব ভালোবাসেন৷
ছবি: DW
10 ছবি1 | 10
এখানেই শেষ নয়৷ কয়লা আমদানি করতে হবে বড় বড় জাহাজে৷ এর জন্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি সমুদ্রবন্দর থাকতে হবে৷ রামপালের কাছাকাছি মংলা বন্দর আছে৷ যদিও বড় জাহাজ মংলা বন্দর পর্যন্ত আসবে না৷ গভীর সমুদ্র থেকে ছোট জাহাজে করে মংলায় আনা হবে কয়লা৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দের জন্যে প্রচুর পরিমাণ পানির জোগান থাকতে হবে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে পানির উৎস হিসেবে নদী থাকতে হবে৷
২. যুক্তি দিয়ে না পেরে সরকার সংশ্লিষ্টরা এখন যুক্তি দিচ্ছে, তাহলে কোথায় হবে বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্দোলনকারীরা তা বলে দিক৷ যত রকমের যুক্তি বা তর্ক আছে, সবচেয়ে বড় কু-যুক্তি বা তর্ক এটাই! কারণ জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আন্দোলনকারীদের বিষয় নয়৷ এটা সরকারের কাজ, গবেষণার কাজ৷ তাই সুবিধাজনক জায়গা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে এবং বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চাওয়া হোক না কেন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে৷ তার কারণ বাংলাদেশে জায়গা কম, মানুষ বেশি৷ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারের কথা-কাজের উপর জনগণের আস্থা না থাকা৷
সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য কি ধ্বংস হয়ে যাবে?
‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ নামের অয়েল ট্যাংকারটির তলদেশ ফেটে যাওয়ায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল শেলা নদী থেকে পশুর নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে৷ এদিকে স্থানীয় পদ্ধতিতে এ যাবৎ সামান্য পরিমাণ তেল অপসারণ করা সম্ভব হয়েছে৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
শ্বাসমূলীয় বন ও পশুপাখির জীবন বিপন্ন
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সুন্দরবনে তেলবাহী জাহাজডুবির ঘটনায় স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হবে৷ এর ফলে সুন্দরবনের গাছপালা, মাছ ও পশুপাখির প্রাণ বিপন্ন হতে পারে৷ এছাড়া তেল সরানোর কার্যকর ব্যবস্থা না নেয়া গেলে দীর্ঘ মেয়াদে শ্বাসমূলীয় বন ও বনের পশুপাখির জীবনে বিপর্যয় বয়ে আসতে পারে৷ অথচ নৌমন্ত্রী শাহজাহান খান দাবি করেছেন যে, তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের তেমন ক্ষতি হবে না৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
যে দুটি কাজ করা উচিত ছিল
সুন্দরবনে জাহাজ ডুবে সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি তেল নদীতে ছড়িয়ে পড়ার পর অন্তত দুটি কাজ দ্রুত করা উচিত ছিল বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷ প্রথমত, নদীতে ফ্লোটিং বুমের সাহায্যে ভাসমান তেল যেন ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা করা৷ দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণে আনা ভাসমান তেল তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা করা৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
মন্ত্রণালয়ের নীতি লঙ্ঘন
সাম্প্রতিক কালে ফার্নেস তেল আমদানি অন্তত ২০ গুণ বেড়েছে বাংলাদেশে৷ এ সব বিপজ্জনক পদার্থকে বলা হয় ‘হ্যাজম্যাট’ (হ্যাজারডাস ম্যাটেরিয়াল বা ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থ) এবং এর পরিবহনে প্রয়োজনীয় সতর্কতা নেওয়া সাধারণ রীতি৷ মন্ত্রণালয় এই রীতি লঙ্ঘন করেছে৷ কোনো দুর্ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার পূর্বপ্রস্তুতি তাদের ছিল না৷
ছবি: DW/M, Mamun
জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন
সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে যান্ত্রিক যান চলা দেশের ও আন্তর্জাতিক নিয়মের লঙ্ঘন৷ সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমোদন কেন দেওয়া হলো, সে বিষয়ে অনুসন্ধান করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন৷
ছবি: DW/M, Mamun
ডলফিনের মৃত্যু
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ দুর্ঘটনার পর সুন্দরবন এলাকা ঘুরে এসেছেন৷ তাঁদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কাঁকড়া, কচ্ছপ, ডলফিনসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী মরতে শুরু করেছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
জেলেদের কর্ম বিপর্যয়
সুন্দরবনে শেলা নদীতে তেল ছড়িয়ে বিপর্যয়ের পর সেখানকার কয়েক হাজারেরও বেশি জেলে পরিবারের দিন কাটছে অলস৷ নদী ও খালে তেল ভেসে থাকায় এসব জেলেরা জাল পেতে মাছ শিকার করতে পারছেন না৷ এর ফলে তাঁদের সংসার চালাতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
শেলা নদীতে ট্যাংকার দুর্ঘটনা
৯ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার ভোরের দিকে সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের কাছে শেলা নদীতে সাড়ে তিন লাখ লিটারের ফার্নেল ওয়েলবাহী ট্যাংকার ডুবির পর, ছড়িয়ে পড়েছে তেল৷ সুন্দরবনের ৩৪ হাজার হেক্টর এলাকায় এরই মধ্যে তেল ছড়িয়ে পড়েছে বলে বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
সরকার, সরকার সংশ্লিষ্টরা যা বলেন, মানুষ তা বিশ্বাস করেন না৷ মহেশখালীর মাতারবাড়িতে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা৷ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা৷ দু'টি জায়গাই মানুষের বসবাস, জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বাঁশখালী থেকে অনেকগুলো পরিবারকে সরিয়ে নিতে হবে৷ বাঁশখালীর এই মানুষগুলোর ভিটেমাটি, আবাদী জমি আছে এখানে৷ লবণ চাষ করে এখানে৷ জীবন-জীবিকা, ভিটেমাটির টানে তারা প্রতিবাদ করতেই পারেন৷ প্রতিবাদ করার আগেই সরকারের উচিত ছিল, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আলোচনা করা৷ তারা এখন যে জীবনযাপন করে, তার সমান বা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের সরিয়ে নেয়া হবে – এমন প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করলে, তাদের রাজি না হওয়ার কারণ ছিল না৷ সরকার তা করেনি৷
জোর-জুলুম করেছে৷ গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে৷ পুলিশ-মাস্তান দিয়ে এলাকার মানুষের নানা প্রতিকূলতা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়৷ এই ভুল নীতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অনিবার্য৷ মাতারবাড়ির ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটছে৷
৩. রামপালের প্রকল্পটি কোথায় সরিয়ে নেয়া যেতে পারে, তা সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে৷ আন্দোলনকারীরা জায়গা নির্ধারণ করে দিতে পারবে না এবং যেখানেই তা করা হোক, কিছু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হবে৷ কাজটি করতে হবে, ধীরস্থিরভাবে৷ আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে আস্থায় নিতে হবে৷ জাপান-অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি....সব দেশেই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সুতরাং বাংলাদেশেও হবে৷ এগুলো খুব ভালো যুক্তি নয়৷ পৃথিবীর প্রতিটি দেশের প্রেক্ষাপট, সুবিধা-অসুবিধা ভিন্ন৷ উদাহরণ দেয়া দেশগুলোর সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে৷ সরকার যা বলে, জনগণ তা মোটামুটি বিশ্বাস করেন৷ সেসব দেশ অনেক বড়, অনেক খালি জায়গা আছে৷ বাংলাদেশে সরকারের কথা মানুষ বিশ্বাস করেন না, খালি জায়গাও নেই৷ সুতরাং অন্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক যুক্তি দিয়ে রামপাল প্রকল্প ‘জায়েজ' করা যাবে না৷
রামপাল প্রকল্পটি সরিয়ে নিতে হবে৷ তবে যেখানেই সরিয়ে নেয়া হোক, পরিবেশ দূষণ হবেই৷ বিদ্যুতের প্রয়োজনে সেই পরিবেশ দূষণ হয়ত মেনে নেয়া যাবে৷ কিন্তু বিদ্যুতের প্রয়োজনে সুন্দরবনের ক্ষতি মেনে নেয়া যাবে না৷
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷
বর্ষায় আরো সুন্দরী সুন্দরবন
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ‘ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট’ বা শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন৷ এই বনের প্রধান গাছটির নাম সুন্দরী৷ আর তার থেকেই সুন্দরবনের নামকরণ৷ ঋতুতে ঋতুতে এ বনের চরিত্র বদলায়৷ তবে সুন্দরবন সবচেয়ে বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বর্ষাকালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, ধান দিলাম মেপে’
বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে সুন্দরবনে বর্ষা আসে মে মাসে আর সেই বর্ষাকাল চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত৷ অবশ্য জুন মাসের মাঝামাঝি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যভাগ পর্যন্ত এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়৷ সুন্দরবন অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬৪০-২০০০ মিমি৷ তবে বনের পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে বৃষ্টিপাত তুলনামূলকভাবে বেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
দিনে দু’বার জোয়ার-ভাটা
প্রতিদিন দু’বার করে জোয়ার-ভাটা হয় সুন্দরবনে, যা কিনা বাংলাদেশ ও ভারত – প্রতিবেশী এই দুই দেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত৷ এখানে সবচেয়ে বড় জোয়ার হয় পূর্ণিমা ও অমাবস্যায়৷ তবে বর্ষাকালে জোয়ারের উচ্চতা থাকে সবচেয়ে বেশি৷ এ সময় বনের বেশিরভাগ অংশই প্লাবিত হয়, ডুবে যায় সবকিছু৷
ছবি: DW/M. Mamun
খাবারের সন্ধানে হরিণসাবক
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবন প্লাবিত হলে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গাগুলোয় আশ্রয় নেয়৷ এরপর জোয়ারের পানি নেমে গেলে খাবারের সন্ধানে নেমে পড়ে তারা৷ আর ঠিক সেই মুহূর্তটার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন বহু পর্যটক – বন্যপ্রাণী দেখবেন বলে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্ষার জন্য বিশেষ ‘প্যাকেজ’
বর্ষায় সুন্দরবনে পর্যটকের আনাগোনা বেশ কম৷ এ বনে পর্যটনের মৌসুম মূলত নভেম্বর থেকে মার্চ৷ তবে বর্ষার সুন্দরবনকে দেখতে কিছু কিছু ভ্রমণপিয়াসী মানুষ এখানে আসেন বটে৷ আর সেই সব পর্যটকদের চাহিদার কারণেই সম্প্রতি দু-একটি বেসরকারি ভ্রমণ সংস্থা বর্ষাকালে সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যবস্থা করছে, দিচ্ছে বিশেষ ‘প্যাকেজ’৷
ছবি: DW/M. Mamun
তারপরেও পরিত্যক্ত বহু এলাকা
বর্ষা মৌসুমে প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের একটি পর্যটক ট্রেল৷ এ সময়ে পর্যটকের যাতায়াত না থাকায় এই হাঁটা পথের ওপরে জমা হয়েছে বিভিন্ন গাছের ফল৷ আসলে ম্যানগ্রোভ অরণ্য হলেও, বেশ কিছু ফল গাছও আছে সুন্দরবনে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরী বন সুন্দরবন
জোয়ারের পানিতে সুন্দরবনের এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় ভেসে আসে এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী গাছের ফল৷ ভেসে যায় আশেপাশের কোনো এলাকায়৷ তবে সুন্দরী গাছের বন সুন্দরবনে এমন একটা দৃশ্যের দেখা পাওয়া যায় কেবলমাত্র বর্ষাকালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
জঙ্গলের বিস্তার, সুন্দরেরও
জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরী ফলের অংশ বিশেষ ভাটার সময় জঙ্গলে থেকে যায়৷ তারপর সেখান থেকেই অঙ্কুর গজায়, গাছ হয়, ফুল ফোটে, ফল দরে৷ এভাবেই বিস্তার ঘটে সুন্দরী গাছ এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সুন্দরবনের৷ প্রকৃতির এ নিয়মেই বেড়ে উঠেছে সুন্দরবনের বেশিরভাগ বনাঞ্চল৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরবনের বানর
সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা বানর৷ ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূলীয় এই বনে বেড়াতে গেলে তাই এদের চোখে পড়বেই৷ কখনও একা একা, আবার কখনও দঙ্গল বেধে ঘুরে বেড়ায় এরা৷ তবে বৃষ্টির সময় এদের গাছের ডালেই আশ্রয় নিতে দেখা যায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
চলে লুকোচুরির খেলা...
বর্ষাকালে সুন্দরবনে চলে রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি৷ ঝকঝকে রোদের মধ্যে হঠাৎ করেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখা যায় এখানে৷ গাড় হয়ে ওঠে নদীর জল, বনের সবুজে পড়ে ছায়া৷ কখনো কখনো মেঘের ভেতর থেকেই সূর্য উঁকি মারে, অসাধারণ দৃশ্যের অবতারণা হয় বনজুড়ে৷
ছবি: DW/M. Mamun
‘লাল-নীল-সবুজের মেলা বসেছে’
কখনও আবার তুমুল বৃষ্টিপাতের মধ্যে হঠাৎ করেই ঝকঝকে নীলাকাশ দেখা যায় সুন্দরবনে৷ বৃষ্টিধৌত বনে সূর্যের আলো তখন ভিন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করে৷ ঝলমল করে ওঠে নদী, বনের গাছ৷ বৃষ্টি একটু ধরলে আস্তে আস্তে নদীর ধারে চড়তে আসে বানর, হরিণ, এমনকি বাঘ মামাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্ষার এক ভিন্ন চিত্র
সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া বন্যপ্রাণী অভয়রাণ্যে বৃষ্টিস্নাত এক ‘গ্রেটার ইয়োলোনেইপ’ বা বড় হলদেসিঁথি কাঠঠোকরা৷ নানা রকম পাখির নিরাপদ আবাসস্থল এই সুন্দরবন৷ প্রায় ৪০০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি রয়েছে সুন্দরী গাছের এ বনে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সুন্দরবনের সুন্দরী হাঁস
সুন্দরবনের কটকা বনাঞ্চলের বড় কটকার খালে চোখে পড়ে ‘মাস্কড ফিনফুট’ বা সুন্দরী হাঁস৷ এর আরেক নাম কালোমুখ প্যারা পাখি৷ বাংলাদেশের সুন্দরবন ও মিয়ানমারে এ হাঁসের বিচরণ সবচেয়ে বেশি৷ সারা পৃথিবীতে বর্তমানে এ পাখির সংখ্যা এক হাজারেরও কম৷ লাজুক স্বভাবের সুন্দরী হাঁসের বৃহত্তম আবাসস্থলও সুন্দরবন৷
ছবি: DW/M. Mamun
জেলেদের জীবন
সুন্দরবনের পার্শ্ববর্তী জয়মনি জেলে পল্লীর পাশে পশুর নদীতে চিংড়ি পোনা সংগ্রহ করছেন জেলেরা৷ সুন্দরবনের পাশে গড়ে ওঠা ভ্রাম্যমাণ এ জেলে পল্লীর জেলেরা সুন্দরবন ও তার আশেপাশে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের পর...
সুন্দরবনের শেলা নদীতে চলছে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী জাহাজ৷ গত ডিসেম্বরে প্রায় ৫৮ হাজার লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে জাহাজ ডুবির পরও এ রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি৷ এছাড়া সাম্প্রতিক বাঘশুমারিতে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে কমে যাওয়ার কারণ হিসেবেও এই নৌ-রুটটিকে দায়ী করা হচ্ছে৷