বিদ্যুতের বাড়তি বিলে জেরবার কলকাতা
২১ জুলাই ২০২০বিদ্যুতের ভুতুড়ে বিলে ছাড় পাননি খোদ বিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাড়ির বিল এসেছে ১১ হাজার টাকার। মন্ত্রী, টলিউডের তারকা, পরিচালক থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ-- কোপ পড়েছে সকলের ওপরেই। বলা যেতে পারে, এখানে সাম্যর ধারণা কাজ করেছে। কেউ বাদ নেই। করোনা, আমফানের পর বিদ্যুতের বিলের ধাক্কায় কলকাতায় সাধারণ মানুষের কোমর ভেঙে যাওয়ার জোগাড়।
হঠাৎ কেন এই আকাশছোঁয়া বিল? কলকাতায় একটিমাত্র সংস্থা বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে। সেই সিইএসসি-র বক্তব্য, করোনা ও আমফানের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে মিটার রিডিং নেয়া সম্ভব হয়নি। আনলক শুরু হওয়ার পর তাঁরা রিডিং নিয়ে আসল বিল পাঠিয়েছেন। গত দুই-তিন মাস তাঁরা একটা গড় বিল পাঠিয়েছেন। অনেকের তো জিরো বিল এসেছিল। এমনিতে গরমকালে বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি হয়। তাই বিল বেশি আসে। এ বার তিন মাসের আসল বিদ্যুৎ খরচ যোগ হয়েছে, তাই বিলের পরিমাণ বেশি লাগছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু বিদ্যুৎক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এত বেশি টাকার বিল আসার কারণ অন্য। যোজনা কমিশনের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক ও বিদ্যুৎক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞ অমিতাভ রায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, যেটা করা উচিত ছিল তা হলো, গত বছর এই মাসগুলিতে যে বিল এসেছিল, তার সমান বিল পাঠানো। তা করা হয়নি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির গড় করে বিল পাঠানো হয়েছে। তখন এমনিতেই বিদ্যুতের খরচ কম থাকে। এ বার তিন মাসের যত ইউনিট খরচ হয়েছে, তার থেকে গত দুই মাসের বিলের অঙ্ক বাদ দেওয়া হয়েছে। তারপর বাকি পুরো ইউনিট একসঙ্গে নিয়ে বিল পাঠানো হয়েছে। কলকাতাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারের বিভিন্ন স্ল্যাব আছে। প্রতিটি স্ল্যাবে মাসুল আলাদা। ধরে নেওয়া যাক একশ ইউনিট খরচ হলো, তখন যে মাসুল দিতে হবে, ১১০ ইউনিটের জন্য মাসুল অনেক বেশি দিতে হবে। কারণ, একশ ইউনিটের পর থেকে নতুন স্ল্যাব চালু হয়ে যাচ্ছে। তিন মাসের ইউনিট একসঙ্গে করে বিল পাঠানো হয়েছে বলে তা উঁচু স্ল্যাবে পড়েছে, তার মাসুলঅনেক বেশি।
খুব স্বাভাবিকভাবে এই অঙ্কের বিল পেলে লোকের ক্ষোভ-বিক্ষোভ তুঙ্গে উঠবে। হয়েছেও তাই। টলিউডের অভিনেতা থেকে শুরু করে অনেকেই সামাজিক মাধ্যমে বিলের ছবি দিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন এরকম বিল এলো? পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় বিলের ছবি সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে বলেছেন, ''আমরা তিনজন থাকি। করোনার পর খুব হিসাব করে চলি। বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। খুব গরমে দুপুরে একটি ও রাতে দুইটি এসি চলে। সব এলইডি লাইট। তাও বারবার এরকম বিল। অসহায়। বিকল্প নেই। গতবার দিয়েছি ১৬ হাজার।'' এই বলে তিনি এ বার ১৯ হাজার ৯০০ টাকার বিলের ছবি দিয়ে দিয়েছেন।
অভিনেতা অঙ্কুশের বিল এসেছে ২১ হাজার ৪০০ টাকার। আরেক অভিনেতা যশের বিলের পরিমাণ ১৭ হাজার ৬৬০। অঙ্কুশ তো বন্ধু যশকে বলেছেন, টর্চ জ্বেলে কাজ করতে। না হলে এক লাখ টাকার বিল এসে যাবে। টর্চ জ্বেলে নিজের সেলফি তুলে তা সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেছেন তিনি। এই করোনাকালেও অনেক গ্রাহক বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা সিইএসসি-র অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন।
কৌশিক যে বিকল্প না থাকার কথাটা বলেছেন, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি-র প্রশ্নও সেটাই। কেন সিইএসসি-র একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে? কেন প্রতিযোগিতা থাকবে না? সিইএসসির ভুতুড়ে বিল নিয়ে হাইকোর্টে মামলা করে দিয়েছেন যুব বিজেপি নেতা সৌরভ শিকদার। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''কলকাতায় একটিই সংস্থা বিদ্যুৎ বিতরণ করে। সারা দেশের মধ্যে কলকাতায় ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের খরচ সব চেয়ে বেশি। এই সংস্থাই গ্রেটার নয়ডা বা রাজস্থানের একটা অংশে বিদ্যুৎ দিচ্ছে অর্ধেক দামে। আমরা চাই, সরকার গ্লোবাল টেন্ডার দিক। রাজ্যের জন্য সব চেয়ে কম খরচে যাঁরা বিদ্যুৎ দিতে পারবে, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হোক। সিপিএম সিইএসসি-কে নিয়ে এসেছিল। কেন মমতা বব্দ্যোপাধ্যায় এসে তা পরিবর্তন করলেন না? আমার করা জনস্বার্থ মামলার শুনানি একদিন হাইকোর্টে হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার শুনানি হবে।''
এই চাপ বাড়তে থাকায় রাজ্য সরকার সিইএসসি-কে বলেছে গ্রাহকদের স্বার্থরক্ষা করতে হবে। তারপর সিইএসসি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, শুধু জুন মাসের বিল দিলেই হবে। এপ্রিল ও মে মাসের বিল দেওয়া আপাতত স্থগিত থাকবে। এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো এবং তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্য়ায় টুইট করে বলেছেন, কলাতাবাসীর জয় হলো। মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, জুন মাসে নতুন করে বিল পাঠাবে সিইএসসি। তারপর সবাই বিল দিন। বিল না দিলে কারও কানেকশন কাটা যাবে না বলে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন।
এরপরেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। এপ্রিল ও মে মাসের বাড়তি বিলের কী হবে? সেটা কি গ্রাহকদের আর দিতে হেব না? না কি পরের বিলে সেই অঙ্ক যোগ করা হবে? এপ্রিল ও মে মাসের বিল কি প্রকৃত স্ল্যাবে ফেলা হবে, তখন কি দেয় টাকার পরিমাণ কমবে? মন্ত্রী বলেছেন, সিইএসসি কয়েকদিনের মধ্যে পুরো ব্যাখ্যা দেবে।
সেই ব্যাখ্যায় লোকে সন্তুষ্ট হলে ভালো, না হলে বিলকাণ্ডের জের অনেকদূর গড়াতে পারে। বিধানসভা ভোটের মাস নয়েক আগে এই ধরনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ শাসক দলের কাছে স্বস্তির নয় বলে বিশেষজ্ঞদের মত।