বিদ্যুতের পরিবর্তন
১ জুন ২০১২জাপান তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে পারমাণবিক বিদ্যুতের ঝামেলা কতটা – আর সেটা কী মারাত্মক হতে পারে৷ কারণ গত বছরের সুনামির আঘাতে জাপানের ফুকুশিমা কাণ্ডের পর গোটা বিশ্বজুড়েই এখন আতঙ্কের ছড়াছড়ি৷ কবে কখন একখানা সুনামি বা মহাপ্রলয় মার্কা ঝড় বা বন্যা আঘাত হানবে আর পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর তীব্র বিকিরণ শুরু করে দেবে মানুষের শরীরে চরম প্রতিক্রিয়া, তা কে বলতে পারে? অতএব এই পারমাণবিক শক্তিকে বর্জন করার সিদ্ধান্ত অনেক দেশেরই৷
সেই অনেক দেশের মধ্যে সবার আগে যে দেশটি ঘোষণা করে দিয়েছিল, আমরা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেব, তারা হল জার্মানি৷ তো, ঘোষণা করলেই তো হলনা, সেই পরিকাঠামো তৈরি করা, তার জন্য ব্যবস্থাদি করা, ইত্যাদিতে অনেক সময় লাগবে৷ আর প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য সেই সময়টা দেওয়ার পাশাপাশি তৈরি করতে হবে এমন পরিকাঠামো, যাতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার যথাযথ হতে পারে৷ সেইসঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে, পারমাণবিক বিদ্যুতের থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহার চালু করার মাঝের যে ফাঁকটা, তাতে যেন জনজীবন স্তব্ধ না হয়ে পড়ে বিদ্যুতের ঘাটতিতে৷
তো, সেইসব হিসেবপত্তর এবার শুরু হয়ে গেছে৷ তাতে যা শোনা যাচ্ছে, তা এরকম৷ এই যে পরমাণু থেকে নবায়নের দিকে যাত্রা, তাতে জার্মানিকে আগামী কয়েক দশকে মোট ২০ থেকে ২৫ বিলিয়ন ইউরো খরচ করতে হবে৷ সে তো গেল পয়সাকড়ির হিসেব৷ বাকি রয়ে গেল আরেকটি দিক, তাহল এই বিদ্যুত পরিবহণের পরিকাঠামো৷ যেটাকে শক্তপোক্ত করে তৈরি করতে না পারলে সমস্যা অনেক বাড়বে বৈ কমবে না৷
মোটের ওপর এসব বিষয়ে যেসব সংস্থা কাজ করে থাকে, তাদের কাছে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে এক বিদ্যুৎ থেকে অন্য বিদ্যুতে ঘর বদল করতে ২,৫০০ মাইল বা ৪,০০০ কিলোমিটার সরবরাহ লাইন তৈরি করতে হবে প্রথমে৷ এখানেই শেষ নয়, জার্মানির মোট চারটি প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ সাধনের জন্য লাগবে ২,৭৩০ মাইল বা ৪,৪০০ কিলোমিটার হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন৷ তো, এই যে পরিকাঠামো, সেটা কাগজে কলমে শুনতে যতটা সহজ, কাজটা করতে গেলে দেখা যাবে, সেটা ঠিক ততটাই কঠিন৷
এদিকে আরও কিছু পরিকাঠামো অপেক্ষায় রয়ে গেছে তৈরি করার জন্য৷ উত্তর জার্মানির বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রয়েছে বাতাস থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উইন্ড টারবাইন প্রকল্প৷ জার্মানির মোট বিদ্যুতের চাহিদার বেশ কিছুটা মেটায় এই বাতাস থেকে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ৷ কিন্তু সমস্যা হল, যেহেতু হাই ভোল্টেজ লাইনের অভাব রয়েছে জার্মানিতে, তাই অনেক সময়ে ঝোড়ো বাতাসের দিনগুলিতে সেইসব উইন্ড টারবাইন বা বাতাস থেকে বিদ্যুৎ তৈরির পেল্লাই পেল্লাই কলগুলোকে বন্ধ করে রাখতে হয়৷ কারণ, কল চালালে এত উচ্চ ভোল্টেজের এবং এত বেশি পরিমাণে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে, যে সেটা সরবরাহ করা যাবে না৷ অর্থাৎ, সরবরাহ করতে গেলে বিদ্যুতের লাইন পুড়ে ঝামা হয়ে যাবে৷ সুতরাং, ঝোড়ো বাতাসের দিনগুলিতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজটাও আসলে ব্যাহত হচ্ছে, ওই পরিকাঠামোর অভাবে৷
তবে কিনা জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল এবং তাঁর সরকার এই নবায়নযোগ্য বিদ্যুত বা ব্যবহারের বিষয়ে যাকে বলে বদ্ধপরিকর৷ যে কারণে ম্যার্কেল স্বয়ং এই পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবহারের অন্ত ঘটানোর বিষয়ে তদারকি করছেন এবং এ বিষয়ে দ্রুত জরুরি পদক্ষেপও নিয়ে চলেছেন৷ বস্তুত যুগান্তকারী এই পরিবর্তন বা পারমাণবিক বিদ্যুৎ থেকে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতে জার্মানির যে অবস্থা বদল, সেটাকে সরকারের কর্তব্যের তালিকার একেবারে ওপরের দিকে স্থান দিয়েছেন তিনি নিজেই৷
পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঝক্কি বা অন্যদিকের সমস্যা ছাড়াও, এই কম খরচের বিদ্যুত উৎপাদন প্রকৃতিতে বেশ ভালো রকমের ক্ষতিকারক প্রভাব তৈরি হয়ে থাকে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের মাধ্যমে৷ সুতরাং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে এই বিদ্যুৎ যত কম উৎপাদন করা যায়, বিশ্বের পরিবেশের জন্য তা ততই সুরক্ষার বিষয়৷ আর পরিবেশের সুরক্ষার জন্যই শুধু নয়, সবুজ বিদ্যুৎ বা নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ব্যবহারের এই উদ্যোগ বিভিন্ন কারণেই প্রয়োজন৷ তাছাড়া জার্মানির অভ্যন্তরে পারমাণবিক বিদ্যুতের ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যাপকহারে গণমত দেখা গিয়েছিল ফুকুশিমা কাণ্ডের পরপরে৷ সুতরাং, জার্মান সরকার সেই গণ দাবিকেই বা অস্বীকার করবে কী করে!
প্রতিবেদন: সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় (রয়টার্স, এপি, এএফপি)
সম্পাদনা: সঞ্জীব বর্মন