ভারতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার মাস তিনেকের মধ্যেই কি মোদী ঢেউ থমকে গেল? চারটি রাজ্যের ১৮টি বিধানসভা আসনের উপ-নির্বাচনে বিজেপি পেয়েছে মোট সর্বমোট ৮টি আসন৷ অন্যদিকে, অ-বিজেপি জোট পেয়েছে ১০টি আসন৷
বিজ্ঞাপন
গত সংসদীয় নির্বাচনে বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে দিল্লির মসনদ দখল করে৷ কিন্তু এ ঘটনার ১০০ দিনের মাথায় বিহার, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক ও পাঞ্জাবে মোট ১৮টি বিধানসভা আসনে উপ-নির্বাচনের ফলাফল বিজেপিকে সতর্ক হবার বার্তা দিয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই৷
ভারতে মোদী-ঢেউ এরই মধ্যে থমকে গেছে – এ কথা বলা না গেলেও, অ-বিজেপি জোট বিজেপির দাপট সামান্য হলেও যে রুখে দিতে সক্ষম হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই৷ বিহারের ১০টি আসনের ফলাফল এক্ষেত্রে উল্লেখ্য৷ রাজ্যে গত লোকসভা ভোটে ৪০টি আসনের মধ্যে বিজেপি জোট যেখানে পেয়েছিল ৩১টি আসন, সেখানে বিজেপির ভোট-ব্যাংক কমে যাবার কারণ কী? কারণ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী শাসক দল নীতীশ কুমারের জেডি-ইউ, লালু প্রসাদের আরজেডি এবং কংগ্রেসের মহাজোট বিজেপির বিজয় রথের গতি থামাতে সব শত্রুতা ভুলে গলা জড়াজড়ি করে উপ-নির্বাচনের ময়দানে দু'দশক পর নামে শুধু জল মাপতে৷ দেখা গেল, তাদের রাজনৈতিক সমীকরণ সন্তোষজনক হয়েছে৷ ১০টি আসনের মধ্যে ছয়টিতে জিতেছে তারা৷ অর্থাৎ হারানো জমি কিছুটা হলেও উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে৷ জেডি-ইউ এবং আরজেডি নেতারা তাঁদের চিরাচরিত যাদব, দলিত, মুসলিম ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির ভোট-ব্যাংক নিজেদের দিকে টানতে সফল হয়েছে৷
মহাজোটের নেতাদের মতে, মোদীর ‘বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি' থেকে মুখ ঘোরাতে শুরু করেছে দেশের মানুষ৷ কথা হলো, তিন মাসের মধ্যে এমন কী ঘটলো যে বিজেপির গতি মন্থর হয়ে গেল? বিজেপির রাজ্য নেতারা মনে করেন, বিহারে জাত-পাতের রাজনীতিই এর কারণ৷ দ্বিতীয়ত, রাজ্যের স্থানীয় ইস্যু এবং জাতীয় ইস্যু আলাদা৷ স্থানীয় ইস্যুতে মোদী ফ্যাক্টর কাজ করেনি৷ ২০১৪ সালের সংসদীয় ভোটের পর গত জুলাই মাসে হিমালয় রাজ্য উত্তরাখন্ডে বিধানসভার তিনটি আসনের উপ-নির্বাচনে সব কটি আসনই হাতছাড়া হয় বিজেপির৷ অথচ সংসদীয় ভোটে রাজ্যের পাঁচটি আসনই পেয়েছিল বিজেপি-জোট৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
উপ-নির্বাচনে নীতীশ-লালু প্রসাদের জোটের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বিজেপির বিকল্প শক্তি হিসেবে অন্যান্য দলগুলিও এগিয়ে আসতে পারে৷ উত্তর প্রদেশে মুলায়েম সিং-এর সমাজবাদী পার্টি এবং মায়াবতির বহুজন সমাজ পার্টি হাত মেলাতে পারে৷
তবে মোদীর ঝড় একেবারে থেমে গেছে – এ কথা বলার সময় এখনো আসেনি৷ আগামী কয়েক মাসের মধ্যে হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ঝাড়কন্ড ও জম্মু-কাশ্মীর – এই চারটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন৷ এছাড়া বিহার বিধানসভার ভোট ২০১৫ সালে৷ সেটা হবে বিজেপি সরকারের আর একটা বড় পরীক্ষা৷ বলা বাহুল্য, দলের নতুন সভাপতি অমিত শাহের ম্যাজিক কতটা কাজ করে, এবার সেটাই দেখার৷
বিজেপিকে অবশ্য মনে রাখতে হবে আত্মসন্তুষ্টির কোনো অবকাশ নেই৷ কারণ মোদী সরকারকে এখনও কাজ করে দেখাতে হবে সুশাসন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে৷