বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ দিয়ে বিহার জিততে চান নীতীশ কুমার?
১৭ জুলাই ২০২৫
আগামী অক্টোবর বা নভেম্বরে বিহারে বিধানসভা নির্বাচন হতে পারে। তার আগে একের পর এক জনমোহিনী ঘোষণা করছেন বিহারে বিজেপি-জেডিইউ জোটের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার। ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া নীতীশ এর আগে সরকারি চাকরিতে নারীদের জন্য ৩৫ শতাংশ সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করেছিলেন। বিহারের স্থায়ী বাসিন্দা নারীরা এই সুযোগ পাবেন। এবার তিনি বিহারের এক কোটি ৬৭ লাখ পরিবারকে ১২৫ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দেয়ার কথা ঘোষণা করলেন।
বৃহস্পতিবার নীতীশ কুমার সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ পোস্ট করে বলেছেন, ''আমরা শুরু থেকেই সবাইকে সস্তায় বিদ্যুৎ দিতে চেয়েছি। এখন আমরা ঠিক করেছি, জুলাই মাসের যে বিল ১ অগাস্ট আসবে, সেখানে সব ঘরোয়া বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবহারের জন্য কোনো টাকা দিতে হবে না। এর ফলে রাজ্যে এক কোটি ৬৭ লাখ পরিবারের লাভ হবে।''
নীতীশ জানিয়েছেন, ''আমরা এটাও ঠিক করেছি, আগামী তিন বছরে পরিবারের সম্মতি নিয়ে বাড়ির ছাদে বা সরকারি জায়গায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। গরিবদের ক্ষেত্রে পুরো খরচ সরকার দেবে। অন্যদের যথোচিত সাহায্য করা হবে। আগামী তিন বছরে ১০ হাজার মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার এগোচ্ছে।''
অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পথে
দিল্লিতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল 'বিজলি হাফ, পানি মাফ'-এই স্লোগান তুলে ভোটে জিতেছিলেন। পরে তিনি দিল্লিতে দুইশ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিলে কোনো পয়সা না নেয়ার পরিকল্পনা কার্যকর করেন। ২০১ থেকে চারশ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ মাসুলের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ ছাড় দেয়ার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়।
ফলে দিল্লিতে গরিবদের সচরাচর বিদ্যুতের বিল দিতে হয় না। শীতের সময় অনেকেই এই সুবিধা পান। দিল্লির ৪৯ লাখ ৪০ হাজার পরিবারের জন্য বিদ্যুৎ ভর্তুকি দিতে ২৩-২৪ সালের বাজেটে তিন হাজার ২৫০ কোটি টাকা ধার্য করা হয়েছিল। বিজেপি সরকারও এই প্রকল্প চালু রেখেছে।
কেজরিওয়াল যে পরপর তিনবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন, তার জন্য এই প্রকল্প বহুলাংশে দায়ী বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। এরপর পাঞ্জাবেও আপ এই প্রতিশ্রুতি দেয়। কর্ণাটকে এই ধরনের জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছিল। এবার বিহারে নীতীশ কুমারও সেই কেজরিওয়ালের পথে হাঁটলেন।
কয়েকদিন আগেই বিহারে আরজেডি নেতা তেজস্বী যাদব ঘোষণা করেছিলেন, তারা ক্ষমতায় এলে বিহারে দুইশ ইউনিট ফ্রি বিদ্যুৎ দেয়া হবে, 'মেরি বহন, মা' যোজনায় নারীদের মাসে আড়াই হাজার টাকা করে দেয়া হবে, পাঁচশ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার দেয়া হবে।
আরজেডির প্রতিক্রিয়া
বিহারে আরজেডি নেতা শক্তি যাদব বলেছেন, ''বিরোধী নেতা তেজস্বী যাদবের চাপে পড়ে নীতীশ কুমার এই ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। তেজস্বী দুইশ ইউনিট ফ্রি বিদ্যুৎ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই চাপের মুখে পড়ে নীতীশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার নিজের কোনো দূরদৃষ্টি নেই। বিহারের মানুষ জানে, এর কৃতিত্ব তেজস্বী যাদবের।''
জেডি ইউ নেতা রাজীব রঞ্জনের দাবি, ''নীতীশ কুমার বিহারকে উপহার দিয়েছেন। ১২৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ করলেও এক পয়সা দিতে হবে না। এতে মানুষের মাসিক খরচ কম হবে।''
কত খরচ হবে?
বিহারে শহরের দিকে একশ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের মাসুল হলো সাত টাকা ৪২ হয়সা। তারপর প্রতি ইউনিট আট টাকা ৯৫ পয়সা। গ্রামের দিকে বিদ্যুতের মাসুল সাত টাকা ৪২ পয়সা। এছাড়া সরকার বিদ্যুতে ১৫ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি দেয়। তার উপর ১২৫ ইউনিট বিদ্যুৎ এক কোটি ৬৭ লাখ পরিবারকে বিনা পয়সায় দেয়ার ফলে বিপুল অন্ততপক্ষে দেড় হাজার কোটি টাকার আর্থিক বোঝা চাপবে।
জনমোহিনী পরিকল্পনার আর্থিক বোঝা
পশ্চিমবঙ্গে মেয়েদের জন্য লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্প চালু করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১ সালে এই প্রকল্প চালু হয়। সমাজকল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা বিধানসভায় একটি প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত দুই কোটি ১৫ লক্ষ ৮৮ হাজার ৭৭৫ জন নারী এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছেন। রাজ্য সরকারের খরচ হয়েছে ৪৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা।
২০২৪-২৫ সালের বাজেটে এর জন্য ১৪ হাজার চারশ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত খরচ হয় ১৯ হাজার ৩৮৫ কোটি। মধ্যপ্রদেশে মেয়েদের জন্য লাডলি বহেনা যোজনায় ২০২৫-২৬ সালে ১৮ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মহারাষ্ট্রে এই যোজনার জন্য বরাদ্দ ৩৬ হাজার কোটি টাকা।
কর্ণাটকে গৃহলক্ষ্মী যোজনায় মেয়েদের মাসে দুই হাজার টাকা দেয়া হয়। সেজন্য ২৫-২৬ অর্থবর্ষে ২৮ হাজার ৬০৮ কোটি টাকা রাখা হয়েছে।
এই ধরনের আরো প্রচুর প্রকল্প কমবেশি সব রাজ্যেই আছে। এই প্রকল্পের অধীনে কোনো কাজ না করেও সরাসরি সরকারি অর্থ প্রাপকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে যায়। ভোট এলেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে এই জনমোহিনী প্রতিশ্রুতির লড়াই শুরু হয়, যেমন হচ্ছে বিহারে।
এর ফল কী হচ্ছে?
অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার এবং সাবেক সাংসদ জহর সরকার ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমি বিষয়টিকে কল্যাণকর প্রকল্প হিসাবে দেখি। এই ভর্তুকির রাজনীতি যদি না থাকত, তাহলে ভারতবর্ষে বিপ্লব হয়ে যেত। অঘটন ঘটে যেত। আগে যেখানে মানুষ খেতে পারত না, সেখানে পাঁচ কিলো খাদ্যশস্য তারা পাচ্ছে। যারা একটু ভালো অবস্থায় আছে, তারা সেটা বিক্রি করে বেশি দামে চাল-গম কিনে নেয়। এটা হবে। খাদ্য সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। এখন জোর করে হোক, করোনার জন্য হোক বা দানাশস্যের পরিমাণ বেশি হয়ে যাচ্ছে বলে হোক এই খাদ্যসুরক্ষা চালু হলো।''
জহর সরকারের বক্তব্য, ''আমি বিষয়টিকে অন্যভাবে দেখছি। খাদ্য ভর্তুকির জন্য এক দশমিক আট থেকে দুই লাখ কোটি টাকা খরচ হয়। ঝাড়খণ্ডের বাজেট দুই লাখ কোটি।একটা রাজ্যের সারা বছরের খরচ খাদ্য ভর্তুকির পিছনে খরচ হচ্ছে। আর কেউ তা তুলতে পারবে না। ফুড সিকিউরিটি অ্যাসিওরড। এরপর আসছে অন্য আরো কিছু দেয়ার ঘটনা। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার শুধু মেয়েদের হাতে টাকা তুলে দেয় তাই নয়, পরিবারের দুস্থ বা কম রোজগারের নারীকে একটা পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদাও দিলো।''
তিনি বলেছেন, ''কিছু সাবসিডি স্টেবিলাইজ করে। ব্রিটেনে বিশ্বযুদ্ধের ফলে ন্য়াশনাল হেলথ সার্ভিস শুরু হয়। সেটা কিছু বদল হতে পারে, কিন্তু উঠবে না। আমাদেরও প্রবীণদের দেয়া ভর্তুকি কেউ সরাতে পারবে না।''
আবার প্রবীণ সাংবাদিক এবং দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার দিল্লির সাবেক বিজনেস এডিটর জয়ন্ত রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এই যে টাকাটা খরচ করা হচ্ছে, সেটা প্রডাকটিভ হচ্ছে না। তাছাড়া দেখতে হবে, রাজ্যগুলির কাছে এই ভর্তুকি দেয়ার টাকা আছে কিনা। না থাকলে তারা হয় ঋণজালে জড়িয়ে পড়বে বা উন্নয়নের জন্য অর্থ থাকবে না।''
অর্থনীতির দিকটা ছেড়ে দিলেও এর একটা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া আছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''এর ফলে একটা অদ্ভূত অবস্থা তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক দায়বদ্ধতির দিক থেকে নজর সরে যাচ্ছে, সরকারের কাজ আর গুরুত্ব পাচ্ছে না, প্রশাসন গুরুত্ব পাচ্ছে না। ভোটের আগে ও পরে জনমোহিনী কাজ করে দলগুলি সরকারে এসে যাচ্ছে। আর কোনো দলই এটাকে অস্বীকার করতে পারছে না। সকলেই এই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।''
শুভাশিস বলেছেন, ''বিহারের ক্ষেত্রেও আজজেডি, কংগ্রেস, বাম দলগুলির মহাজোট দুইশ ইউনিট বিদ্যুৎ বিনা পয়সায় দেবে বলেছিল। নীতীশ আগেভাগে ১২৫ ইউনিট দিয়ে দিলেন। ফলে কেউই পিছিয়ে থাকছেন না।''
প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''যে যার মতো করে জনমোহিনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং তা রূপায়ণ করেছে। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদব পড়ুয়াদের ল্যাপটপ দিয়েছিলেন। দক্ষিণের রাজ্যে রঙিন টিভি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। দিল্লিতে মেয়েরা বাসে বিনা পয়সায় চড়তে পারেন। দেশজুড়ে কৃষকদের কেন্দ্রীয় সরকার টাকা দেয়। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প চালু আছে। এই ধরনের প্রকল্প যে ভোটের ন্যারেটিভ বদলে দিতে পারে তা অতীতে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে।''