বছর দশেক আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে এক কাজিনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে মজার দৃশ্য দেখেছিলাম৷ সেই কাজিনের দুটি মেয়ে আছে৷ তাদের দেখাশোনার জন্য বাসায় একজন বয়স্ক নারী ছিলেন৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু সমস্যা হলো, সেই নারী স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা বোঝেন না৷ আবার আমার কাজিনের বাসায় কেউ স্প্যানিশ ভাষা বোঝেন না৷ ভাষার এই দূরত্ব নিয়েই চলছিল তাদের প্রতিদিনের কাজ৷ কীভাবে? আমার কাজিন মোবাইলে ইংরেজিতে তার কথা লিখতেন৷ তারপর গুগল ট্রান্সলেটরে সেটি স্প্যানিশে অনুবাদ করে দিতো৷ এভাবেই তাদের যোগাযোগ৷ জরুরি কাজ হয়তো চলছিল৷ কিন্তু তাতে তাদের মধ্যে কোনো কার্যকর যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি৷ কারণ গুগল ট্রান্সলেটর যে হাস্যকর সব অনুবাদ করে তার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই সবারই কমবেশি আছে৷ আর গুগল ট্রান্সলেটরের দোষই বা দেই কেন, যুগ যুগ এক ভাষার সাহিত্য আরেক ভাষায় অনুদিত হচ্ছে; তাতে কি কখনো মূল সাহিত্যের রসটা পাওয়া যায়?
মূক ও বধিররা ইশারা ভাষায় কথা বলে বটে৷ কিন্তু মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ হয় ভাষায়৷ কে কোন ভাষায় কথা বলবেন, তা নির্ধারিত হয়; তিনি কোথায় জন্মেছেন, তার জাতীয়তা কী তার ওপর৷ আমরা কথায় কথায় বলি না- মাতৃভাষা৷ আসলে আমার মা যে ভাষায় কথা বলেন, আমি সে ভাষায়ই কথা বলবো৷ এটাই আমার মাতৃভাষা৷ বাংলাদেশে জন্ম নিলেও একজন চাকমা কিন্তু তার ভাষায় কথা বলতে শিখবে, বলবে৷ একটা কৌতুক বলি৷ সিলেটের এক লোক গেছে লন্ডনে৷ ফিরে এসে সবাইকে বলছে, কী কী দেখে এলো৷ তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, কী তাজ্জব, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও ফরফর করে ইংরেজি বলছে৷ এটা তার কাছে বিস্ময়কর লেগেছে, কারণ তিনি ইংরেজি জানেন না৷ আবার যুক্তরাজ্যের শিশুদের কাছে ইংরেজি তার মায়ের ভাষা৷ ভাষা কিন্তু জ্ঞান নয়, জ্ঞান অর্জনের একটি বাহন মাত্র৷ একটি ভাষা কাজ চালানোর মত করে শিখতে মাস ছয়েক লাগে৷ আবার সারাজীবন তপস্যা করেও অনেকে নিজের মায়ের ভাষার আসল রূপের দেখা পান না৷
বাংলা একাডেমি কতটা ডিজিটাল
সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পে বিভিন্ন খাতকে পর্যায়ক্রমে ডিজিটাল করছে। মুজিব জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমিকেও ডিজিটালাইজ করার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি। এ দাবি কতটা বাস্তবসম্মত? দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইনে স্টলের লটারি
বাংলা একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রন বিভাগের পরিচালক ডঃ জালাল আহমেদ জানান, অমর একুশে বইমেলার স্টল বন্টনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে অনলাইনে লটারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর ফলে অনিয়মের যে অভিযোগ ছিল, সেটি সম্পূর্ণ দূর হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
তথ্যকেন্দ্রের ডিজিটাল সহায়তা
বইমেলায় আগত দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি এবং সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে দুইটি তথ্যকেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেখানে দর্শনার্থীরা এসে স্টলের অবস্থান, বইয়ের প্রকাশক, লেখক এবং দাম সম্পর্কে অনলাইনে সহজেই তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন বলে জানিয়েছেন তথ্যকেন্দ্রের কর্মকর্তা রাজীব কুমার সাহা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন বইয়ের তালিকা হাল-নাগাদ নয়
ওয়েবসাইটে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের তালিকায় দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ, ফোকলোর, প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য, প্রাণিবিদ্যা, আইন শিক্ষা, সাংবাদিকতা ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা শাখায় বইয়ের তালিকা থাকলেও ২৬ মে, ২০২১-এর পর থেকে সেটি আর হাল-নাগাদ করা হয়নি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলার পৃথক ওয়েবসাইট
প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে অমর একুশে বইমেলাকে সামনে রেখে বাংলা একাডেমি একটি ওয়েবসাইট (ba21bookfair.com) চালু করেছে। এখানে বইমেলা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য প্রকাশ ও আর্কাইভ করা হচ্ছে। এই ওয়েবসাইটে ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের তালিকা, মেলার অনুষ্ঠানসূচি, ঘোষণা ইত্যাদি সন্নিবেশিত হয়েছে।
ছবি: www.ba21bookfair.com/Bangla Academy
‘আমাদের আধুনিকীকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে’
বাংলা একাডেমির বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগের পরিচালক ডঃ জালাল আহমেদ বলেন, “বাংলা একাডেমি ডিজিটালাইজেশনের কাজ আমরা অনেকদিন ধরেই করছি। তবে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এমনটা বলা যাবে না। অনলাইনে আমরা বই বিক্রির উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, আমাদের লাইব্রেরি ডিজিটালকরণের কাজ এগিয়ে চলেছে। সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যে এর সুফল ভোগ করছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই বাকি কাজগুলোও আমরা শেষ করতে পারবো।“
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন অভিধান নেই
১৯৫৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বাংলা একাডেমির বেশ কয়েকটি অভিধান বই আকারে থাকলেও এর কোনো অনলাইন সংস্করণ নেই। বাংলা একাডেমির সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান, বাংলা উচ্চারণ অভিধান, বাংলা-ইংরেজি, ইংরেজি-বাংলা অভিধানগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এর অনলাইন সংস্করণ এখনো ছাড়া হয়নি৷ তবে বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনাধীন আছে বলে জানান বাংলা একাডেমির একাধিক কর্মকর্তা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বাংলা একাডেমির নিজস্ব ওয়েবসাইট
বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত বাংলা একাডেমির রয়েছে একটি নিজস্ব ওয়েবসাইট (banglaacademy.gov.bd)৷ ওয়েবসাইটটিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ও ফেলোশিপ, অফিস আদেশ ও বিজ্ঞপ্তি, কর্মকর্তাদের তালিকা ও ফোন নম্বর, প্রকাশনা, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বইয়ের পিডিএফ সংস্করণ ইত্যাদি সন্নিবেশিত আছে। এছাড়া অমর একুশে বইমেলার হালনাগাদ তথ্যও এখানে পাওয়া যাবে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘অনলাইনে তথ্য থাকলে এতবার আসতে হতো না’
উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী শোয়াইব আহমেদ জানান, তিনি বইমেলায় ৪ বছর ধরে আসছেন। বইমেলা কতটুকু ডিজিটাল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবারই তিনি ৮-১০টি বই কিনেন, কিন্তু তথ্যের অভাবে একদিনে সব বই কিনতে পারেন না। এখন মানুষের হাতে হাতে ইন্টারনেট সুবিধা রয়েছে। সেক্ষেত্রে অনলাইনে যদি বইয়ের হাল-নাগাদ তথ্য দেওয়া থাকতো, তাহলে জ্যাম ঠেলে দূর থেকে বারবার এসে বই কিনতে হতো না।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বইমেলায় ডিজিটাল কেনাকাটার সুবিধা
বইমেলা ২০২২-এ অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা সংস্থা বাংলা প্রকাশ-এর বিক্রয় প্রতিনিধি সাদাত সিফাত বলেন, ‘‘গত ৩-৪ বছর যাবত আমাদের ক্রেতারা ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে বই কিনতে পারছেন। এখন যেহেতু মেলায় দর্শনার্থীদের প্রায় সবারই স্মার্ট ফোন আছে, তাই দেখা যায় বই কিনতে এসে টাকার সংকটে কাউকে পড়তে হয় না। এটি আমাদের ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়পক্ষের জন্যই সুবিধাজনক।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
‘অনলাইন-অফলাইন দুটোরই দরকার আছে’
অমর একুশে বইমেলা ২০২২ এর মেলায় অংশ নেওয়া সজিব বুক কর্ণারের স্বত্বাধিকারী আহমেদ সোবহান বলেন, “বইমেলার বইসহ সব তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া গেলে অবশ্যই ভালো৷ তবে বইয়ের সাথে যেহেতু মানুষের সম্পর্কটা আত্মার, তাই সশরীরে এসে বই ঘেঁটে দেখার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে বলে আমি মনে করি। বইমেলার স্টলে আসা, ঘোরাঘুরি, দোকানে ভিড়, আড্ডা এই বিষয়গুলো যথেষ্ট উপভোগ করার মতো বলেই বইমেলা প্রাণের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
অনলাইন টিকার সনদ
পাঞ্জেরি পাবলিকেশনের বিক্রয় প্রতিনিধি তানজিল আল-দ্বীন বলেন, ‘‘আমরা যারা স্টলে আছি, তাদের সবার কোভিড টিকা সনদের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আমরা সবাই আমাদের সনদের একটি কপি অফিস কর্তৃপক্ষকে জমা দিয়েছি, পাশাপাশি অনলাইন একটি কপিও আমরা সাথে রেখেছি যেন প্রশাসন চাইলে সাথে সাথে দেখাতে পারি।’’
ছবি: Mortuza Rashed/DW
11 ছবি1 | 11
বিশ্বে অনেক ভাষা আছে, যার অনেকগুলো আবার হারিয়েও গেছে৷ এমনকি বাংলাদেশেও বাংলা ছাড়া আরো অনেক ভাষা আছে, যার অনেকগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তপ্রায়৷ সবার কাছেই তার নিজের ভাষা সবচেয়ে পছন্দের৷ আমার কাছে যেমন বাংলা৷ আমি ভাষাবিদ নই৷ তাই নিশ্চিত করে বলতে পারবো না৷ তবে বাংলার মত এমন চমৎকার, ছন্দময় ভাষা খুব বেশি নেই৷ অনেক বিদেশি বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছেন৷ সম্প্রতি প্রয়াত কিংবদন্তি শিল্পী লতা মঙ্গেশকর বাংলাভাষী নন৷ কিন্তু বাংলার প্রতি তার ভালোবাসার প্রকাশে ছিলেন অকৃপণ৷ রোমান হরফে বাংলা লিখে বাংলা গান গেয়েছেন তিনি৷ কিন্তু শুনে বোঝার উপায় নেই, লতা বাংলাভাষী নন৷ পড়তে না পারলেও বা বুঝতে না পারলেও লতার কানে বাংলা সুধার মতই লাগতো৷ রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে, ‘মা, তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতো’ কিন্তু নিছক গানের কথা নয়, আবেগের কথা নয়; এটাই সত্যি৷
বাংলা ভাষা আরেক কারণে সবার আগে৷ বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতি তার ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য জীবন দেয়নি৷ ৭০ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা্য় মানুষ পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দিলেও ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা আসলে মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা৷ তাই তো ২১ ফেব্রুয়ারি আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা৷ বাংলা এবং বাঙালি আজ সবাইকে পথ দেখিয়েছে৷
বাংলা শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাষা নয়৷ বিশ্বের অন্তত ৩০ কোটি বাঙালি বাংলা ভাষায় কথা বলেন৷ বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়, বিহার, উড়িষ্যাসহ বিভিন্ন রাজ্যে বালাভাষী মানুষ আছে৷ আর অভিবাসনসূত্রে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই খুঁজলে কম বেশি বাংলাভাষী মানুষ পাওয়া যাবে৷ তারপরও নেতৃত্বটা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেরই হাতে৷ কারণ বাংলা ভাষাভিত্তিক জাতির আর কোনো স্বাধীন দেশ নেই৷ পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী-সাহিত্যিকেরাও বলেন বাংলা ভাষার ভবিষ্যত বাংলাদেশেই৷ কিন্তু এত যে রক্ত, এত ত্যাগ, এত আন্দোলন, এত আবেগ, এত ভালোবাসা, এত পথ দেখানো, এত দায়িত্ব; সেই বাংলা ভাষার জন্য গত ৭০ বছরে, নিদেনপক্ষে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কী করেছি? ফেব্রুয়ারি এলেই সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন নিয়ে আমরা অনেক হই-হল্লা করি বটে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না৷ সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন মানে কিন্তু এই নয়, অন্য সব ভাষাকে আমরা ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবো৷ বিশ্ব এখন একটা গ্রামে পরিণত হয়েছে৷ সেই গ্রামে বাস করতে হলে, প্রয়োজনে আমাদের অন্য ভাষাও শিখতে হবে৷ ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা্, চাকরির প্রয়োজনে আমাদের অন্য ভাষা শিখতে হতে পারে৷ কেউ ইংরেজি শিখবে, কেউ ফ্রেঞ্চ, কেউ চায়নিজ, কেউ জাপানিজ; যার যেটা লাগে৷ কেউ চাইলে একাধিক বিদেশি ভাষাও শিখতে পারেন৷ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বা সৈয়দ মুজতবা আলীর মত বহু ভাষাবিদ বাঙালিকে নিয়েও তো আমরা গর্ব করি৷ আগেই যেমন বলেছি, একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন কিন্তু শুধু বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন নয়৷ এটি সকল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন৷ যতই বিদেশি ভাষা শিখি আর না শিখি; আগে তো বাংলা ভাষাটা শিখতে হবে ভালো করে, বাংলাকে ভালোবাসতে হবে৷ রবীন্দ্রনাথ যেমন বলে গেছেন, ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন৷’ কিন্তু আমাদের সেই গাঁথুনিটাই পোক্ত হয় না, তাই আমরা বারবার পিছিয়ে যাই৷ বছর বছর আমরা বলবো, লিখবো; কিন্তু সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন আদৌ কখনো হবে কিনা আমার সন্দেহ আছে৷ সন্দেহের কারণ হলো আমাদের হীনমন্যতা৷ ভিনদেশি কারো সাথে দেখা হলেই আমরা অস্থির হয়ে যাই, তার ভাষায় কথা বলতে৷ ভারতীয় কারো সাথে দেখা হলে ভুল হিন্দিতে, পাকিস্তানের কারো সাথে দেখা হলে ভুল উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করি৷ ইংরেজির কথা না হয় নাই বললাম৷ কিন্তু যার সাথে কথা বলছি, তিনি কি কখনো বাংলা বলার চেষ্টা করেন? এখানে আসলে দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্কের স্বার্থটা গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা তার ভাষায় কথা বলে শুরুতেই নিজেদের কম গুরুত্বপূর্ণ করে ফেলি৷ চীনের বেশির ভাগ মানুষই নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না, ইংরেজিও না৷ তাতে কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব দিতে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না৷ ব্যবসার দোহাই দিয়ে তাদের ইংরেজি শিখতে হচ্ছে না৷ বরং বাংলাদেশের মানুষ এখন ব্যবসার স্বার্থে চীনের ভাষা শিখছেন৷
কোন ভাষায় কত অক্ষর
সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভাষা৷ কিন্তু আমরা কি জানি, কোন ভাষায় কতগুলি করে অক্ষর? একনজরে দেখে নেওয়া যাক আজকের গ্যালারিতে৷
ছবি: Getty Images
তামিল ২৪৭
তামিল ভাষায় মূল অক্ষর ৩১টি৷ তবে যুক্তাক্ষর ধরলে সেখানে আরো ২১৬টি অক্ষর যুক্ত হয়৷ অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ২৪৭টি অক্ষর৷ বিশ্বের যে কোনো ভাষার চেয়ে বেশি অক্ষর তাই তামিলে৷
ছবি: Reuters/N. Bhalla
খামের ৭৪
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পুরনো দেশগুলির অন্যতম কম্বোডিয়া৷ খামের সংস্কৃতি বহু শতাব্দীর৷ খামের ভাষাও খুব সমৃদ্ধ৷ খামের ভাষায় ৭৪টি অক্ষর আছে, যার মধ্যে ৩৫টি ব্যাঞ্জনবর্ণ এবং ১৪টি স্বরবর্ণ৷ বাকি অক্ষরগুলি যুক্তবর্ণ৷ তবে ব্যাঞ্জনবর্ণের মধ্যে ৩৩টি এখন ব্যবহৃত হয়, ২টির কোনো ব্যবহার নেই৷
ছবি: Imago/blickwinkel
থাই ৭০
থাইল্যান্ডের ভাষা থাই৷ থাই ভাষায় সব মিলিয়ে ৭০টি অক্ষর, যার মধ্যে ৪৪টি ব্যাঞ্জনবর্ণ এবং ১৫টি স্বরবর্ণ৷ এই দুই অক্ষর মিলিয়ে বেশ কিছু যুক্তাক্ষরও তৈরি হয়৷
ছবি: Reuters/A. Perawongmetha
মালয়ালম ৫৮
দক্ষিণ ভারতের কেরলে মালয়ালম ভাষার প্রচলন আছে৷ এই ভাষায় মোট ৫৮টি অক্ষর, যার মধ্যে ১৩টি স্বরবর্ণ এবং ৩৬টি ব্যাঞ্জনবর্ণ৷ আর কিছু অন্তচিহ্ন আছে৷ ওই অঞ্চলের ছোট ছোট বেশ কয়েকটি ভাষাও মালয়ালম অক্ষরেই লেখা হয়৷
ছবি: UNI
তেলেগু ৫৬
ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশে তেলেগু মুখ্যভাষা৷ তেলেঙ্গানা প্রদেশেও৷ কন্নড় ভাষার সঙ্গে তেলেগু লিপির বহু মিল আছে৷ কারণ, দু’টি ভাষারই সৃষ্টি একই জায়গা থেকে৷ সব মিলিয়ে ৫৬টি অক্ষর আছে এই ভাষায়৷
ছবি: UNI
সিংহলী ৫৪
শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রভাষা ভাষা সিংহলী৷ অসামান্য সুন্দর এই ভাষার অক্ষর বিন্যাস৷ সব মিলিয়ে অক্ষরের সংখ্যা ৫৪৷ এই ভাষাতেও সংযুক্ত অক্ষরের প্রচলন আছে৷
ছবি: Reuters/D. Liyanawatte
বাংলা ৫২
বাংলায় সব মিলিয়ে ৩২টি অক্ষর৷তবে যুক্তাক্ষর ধরলে ৫২টি অক্ষর৷ দেবনাগরী লিপি না হলেও তার সঙ্গে বাংলা বর্ণের প্রচুর মিল৷ মূলত এই লিপির জন্ম ব্রাহ্মী থেকে৷
ছবি: DW/M. Mostafigur Rahman
কন্নড় ৪৯
দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৪টি ভাষার একটি কন্নড়৷ কর্ণাটকে মূলত এই ভাষা ব্যবহৃত হয়৷ কন্নড় ভাষায় ১৩টি স্বরবর্ণ আছে৷ তবে তার মধ্যে অনুস্বর এবং বিসর্গ নেই৷ কন্নড়ে ব্যাঞ্জনবর্ণের সংখ্যা ৩৬৷
ছবি: Jayalaxmi AgroTech
হিন্দি ৪৪
হিন্দিও স্বরবর্ণ এবং ব্যাঞ্জনবর্ণে বিভক্ত, যার মধ্যে ১১টি স্বরবর্ণ এবং ৩৩টি ব্যাঞ্জনবর্ণ৷ হিন্দি ভাষার উৎপত্তি দেবনাগরী থেকে৷ সংস্কৃতের প্রচুর প্রভাব আছে এই ভাষায়৷
ছবি: AP
হাঙ্গেরিয়ান ৪৪
লাতিন বর্ণমালা থেকেই হাঙ্গেরিয়ান বর্ণমালার উৎপত্তি৷ রোমান বর্ণমালার এ থেকে জেড ছাড়াও এই বর্ণমালায় আরো বেশ কিছু অক্ষর দেখতে পাওয়া যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Kisbenedek
অবখাজ ৪১
জর্জিয়ার কোনো কোনো অংশে এই ভাষায় কথা বলা হয়৷ অবখাজ ভাষায় ৪১টি অক্ষর৷ ১৮৮০ সালে এই ভাষার বর্ণমালা তৈরি করা হয়৷
ছবি: Filip Warwick
আর্মেনিয়ান ৩৯
আর্মেনিয়ার প্রধান ভাষা আর্মেনিয়ান৷ তাদের বর্ণমালায় মোট অক্ষরের সংখ্যা ৩৬৷ তবে কালে কালে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯৷
ছবি: Reuters/M. Sezer
রুশ ৩৩
আধুনিক রুশ বর্ণমালায় ৩৩টি অক্ষর৷ রুশ ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অক্ষর ঔ, এ, আ এবং ন৷ রুশ ভাষার সাহিত্য সারা পৃথিবীতেই এক সময় অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল৷
ছবি: picture alliance/Russian Look
আজারবাইজানি ৩২
আজারবাইজানে বলা হয় আজারবাইজানি ভাষা৷এই ভাষার অক্ষরবিন্যাসও তৈরি হয়েছে লাতিন বর্ণমালার উপর ভিত্তি করে৷ তবে লাতিনের চেয়ে কিছু আলাদা অক্ষরও তাদের বর্ণমালায় ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: picture alliance/AA /Stringer
ইংরেজি ২৬
ইংরেজিতে মোট ২৬টি অক্ষর আছে, যার মধ্যে ৫টি ভাওয়েল এবং ২১টি কনসোনেন্ট৷ সারা পৃথিবীতেই ইংরেজি ভাষার ব্যাপক ব্যবহার৷ মূলত রোমান স্ক্রিপ্ট থেকেই তৈরি হয়েছে ইংরেজির বর্ণমালা৷
ছবি: AP
গ্রিক ২৪
গ্রিক বর্ণমালায় মোট ২৪টি অক্ষর, যার প্রথম অক্ষর আলফা৷ আর শেষ হয় ওমেগা দিয়ে৷ বিজ্ঞান এবং গণিতের বহু ক্ষেত্রে এখনো গ্রিক অক্ষর ব্যবহার করা হয় সারা পৃথিবীতেই৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/P.Karadjias
হিব্রু ২২
আরবি, ফারসি কিংবা উর্দুর মতো হিব্রু ভাষাও বাঁ দিক থেকে ডানদিকে লেখা হয়৷ এই ভাষার বর্ণমালায় মোট ২২টি অক্ষর আছে৷ইজরায়েলের রাষ্ট্রভাষা হিব্রু৷ এই ভাষার ইতিহাসও কয়েক হাজার বছর প্রাচীন৷
ছবি: Getty Images
17 ছবি1 | 17
এই যে আমাদের মাতৃভাষার গাঁথুনিটা শক্ত নয়, এর দায় কিন্তু পুরোটাই আমাদের৷ বাংলাদেশের মত এমন বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বের আর কোথাও নেই৷ এখানে বাংলা ভার্সন আছে, ইংরেজি ভার্সন আছে, ইংরেজি মিডিয়াম আছে, আলিয়া মাদ্রাসা আছে, কওমি মাদ্রাসা আছে৷ এই নানামুখী শিক্ষা ব্যবস্থার স্রোত যখন উচ্চশিক্ষায় গিয়ে মেশে, তখন প্যাঁচ লেগে যায়৷ সন্তান কোনোরকমে স্কুল-কলেজ শেষ করেই উচ্চশিক্ষার নামে বিদেশে চলে যাবে, এটাই আমাদের গোপন লক্ষ্য৷ তাই ইংরেজি মিডিয়ামের চাহিদা বাড়ছে দ্রুত৷ আমরা মুখে গাই ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ আর সন্তানদের চড়া দাম দিয়ে ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াই৷ ‘আমার সন্তানের বাংলাটা ঠিক আসে না, ইংরেজিকে ফ্লুয়েন্ট’ এটা বলার সময় আমাদের চেহারায় গর্ব ফুটে ওঠে৷ কিন্তু এটা যে গর্ব নয়, লজ্জার সেটা বোঝার মত জ্ঞানও আমাদের নেই৷ অথচ আমরা যদি বলতে পারতাম, ‘আমার ছেলে চমৎকার বাংলা বলে, ইংরেজিটাও ভালো বলে’ তাহলে সেটা হতো সত্যিকারের শিক্ষা৷
শুরুতেই যে জট লাগানো বহুমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা, তার প্রভাব পরে পরবর্তীতে৷ শিক্ষা ব্যবস্থার দূরবস্থা বোঝাতে আমরা বলি, ‘অমুক শুদ্ধ করে তিন লাইন ইংরেজি লিখতে পারে না’৷ সেই অমুক কিন্তু শুদ্ধ করে তিন লাইন বাংলাও লিখতে পারেন না৷ ভুল বানান আর ভুল বাক্যের ছড়াছড়ি সর্বত্র৷ উচ্চ আদালতে যে ইংরেজিতে রায় লেখা হয়, সেটা কাদের জন্য? আমাদের আইনজীবীরা, বিচারকেরা কি বাংলায় লিখতে পারেন না?
বাংলা নিয়ে যে আমাদের এত গর্ব, সেই বাংলাকে কম্পিউটারে সর্বজনীন করতে এক মেডিকেল ছাত্রের ‘অভ্র’ কি-বোর্ড আবিষ্কার পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে৷ কিন্তু এখনও আমরা একটা ডিজিটাল ডিকশনারি বানাতে পারিনি৷ আপনি ইন্টারনেটে একটি ইংরেজি অক্ষর লিখলেই সাথে সাথে অনেকগুলো শব্দের পরামর্শ চলে আসবে৷ ভুল বানান লিখলে কম্পিউটার সেটা শুধরে দেবে৷ কিন্তু বাংলা লিখতে হবে আপনাকে নিজের মত৷ মেডিকেল শিক্ষার্থী কি-বোর্ড বানিয়েছে, কিন্তু তেমন কেউ তো আরডিজিটাল ডিকশনারি বানাবেন না৷ সেটা করতে হবে বাংলা একাডেমিকেই৷
অনেকেই অভিযোগ করেন, বাংলা খুব জটিল ভাষা৷ বাংলায় তিনটা ‘র’, ‘ড়’, ‘ঢ়’ আছে; তিনটা ‘স’, ‘শ’, ‘ষ’ আছে; তিনটা ‘জ’, ‘ঝ’, ‘য’ আছে; দুইটা ‘ন’, ‘ণ’ আছে৷ উচ্চারণ কাছাকাছি হলেও প্রত্যেকটি অক্ষর দিয়ে আলাদা আলাদা শব্দ হয়৷ ‘নারী’ আর ‘নাড়ি’র মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক৷ মানুষ ঈদের সময় নাড়ির টানে বাড়ি যায়, নারীর টানে নয়৷ বাংলা একাডেমি কদিন আগে ‘ঈদ’কে ইদ বানানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে৷ ‘ঈদ’ দেখলেই হৃদয়ে আনেন্দের যে দোলা লাগে, কল্পচোখে দেখি বাঁকা চাঁদ; ‘ইদ’এ তা পাই না৷ ‘আষাঢ়’ লিখলে কল্পনায় যে ছবি ভাসে, কেউ ‘আসার' লিখলে তা কখনোই পাওয়া যাবে না৷ এই ছোট্ট ছোট্ট কাজই বাংলা ভাষার সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ৷ একজন ভালো আবৃত্তিকার যখন উচ্চারণ করবেন, ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে…’ তখন আপনার কল্পনার ঘোড়া আপনাকে অনেকদূর নিয়ে যাবে৷
ফেব্রুয়ারি, মার্চ আর ডিসেম্বরে, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গেয়ে কেঁদে বুক ভাসানোর নাম দেশপ্রেম নয়৷ বাংলাকে সত্যিকারের মর্যাদার আসনে বসানোটা দেশপ্রেম৷ তারচেয়ে বড় কথা হলো, নিজেদের আরো যোগ্য করে তোলা৷ বাংলাদেশের মানুষ যেমন ব্যবসার স্বার্থে চায়নিজ ভাষা শিখছে৷ তেমনি আমরা যদি নিজেদের তেমন যোগ্য করে তুলতে পারতাম, যে অন্য দেশের মানুষ তাদের স্বার্থেই বাংলা শিখে আমাদের কাছে আসবে৷ কিন্তু আমরাই যদি হীনমন্যতায় কুকড়ে গিয়ে গর্ব করে বলি, ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’, তাহলে কার ঠেকা পরেছে বাংলাকে মর্যাদা দেয়ার৷
আমি ভাষাবিদ নই, বহু ভাষাবিদ তো নয়ই৷ খলবলিয়ে বাংলায় কথা না বললে আমার মন ভরে না৷ প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ভাষায় আমি বলতে চাই, ‘আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে/করি বাংলায় হাহাকার/আমি সব দেখে শুনে খেপে গিয়ে/করি বাংলায় চিৎকার…৷’
ভাষা একটি প্রবহমান বিষয়৷ গ্রহণ-বর্জনেই এগিয়ে যায় ভাষা৷ অনেক বিদেশি শব্দ বাংলা ভাষায় ঢুকে গেছে সাবলিলভাবে৷ ভাষার দরজা বন্ধ করাও যেমন যাবে না, আবার একেবারে অর্গল খুলে দিয়ে এফএম রেডিওর আরজে'দের হাতে বাংলা ভাষাকে বিকৃত করার অধিকারও দেয়া যাবে না৷ হাজার বছর আগের ‘চর্যাপদ’ও বাংলায় লেখা; আবার হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ও বাংলায় লেখা৷ কিন্তু হাজার বছরে বাংলা ভাষা বদলে গেছে অনেক৷ এই ‘জলে’ আর ‘জ্বলে’র মধ্যে যে কাব্যিক মোচড়, এটাই বাংলার সৌন্দর্য্য৷
রামনিধি গুপ্তের জিজ্ঞাসা দিয়েই শেষ করি লেখা-
‘নানান দেশের নানান ভাষা৷
বিনে স্বদেশী ভাষা,
পুরে কি আশা?’
ভাষা নিয়ে সাত মজার তথ্য
ইউনেস্কোর হিসেবে পৃথিবীর মানুষ প্রায় ছয় হাজার ভাষায় কথা বলে৷ এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ভাষায় কথা বলা মোট মানুষের সংখ্যা এক লাখেরও কম৷
মোট ভাষা
ইউনেস্কো বলছে, পৃথিবীর মানুষ প্রায় ছয় হাজার ভাষায় কথা বলে৷ এর মধ্যে কমপক্ষে ৪৩ শতাংশ ভাষা বিলুপ্তির আশঙ্কায় রয়েছে৷ আরেক হিসেব বলছে, ছয় হাজার ভাষার মধ্যে ৯০ শতাংশ ভাষায় কথা বলা মোট মানুষের সংখ্যা এক লাখেরও কম হতে পারে৷ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এসআইএল ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশনা ‘এথনোলোগ’-এর হিসেবে, বিশ্বে বর্তমানে ভাষার সংখ্যা ৭,১৩৯৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Meissner
সবচেয়ে বেশি ভাষার দেশ
পাপুয়া নিউ গিনির জনসংখ্যা প্রায় আশি লাখ৷ এথনোলোগের হিসেবে, সে দেশের মানুষ ৮৪০ ভাষায় কথা বলে! তবে অফিসিয়াল ভাষা তিনটি- ইংরেজি, টক পিসিন ও হিরি মটু৷ এই তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় ভাষার সংখ্যা ৭১২৷ এরপর ক্রমান্বয়ে আছে নাইজেরিয়া (৫২২), ভারত (৪৫৪) ও যুক্তরাষ্ট্র (৩২৬)৷
ছবি: picture- alliance/AP Photo/UN/S. Aupong
মহাকাশে ঘুরছে বাংলা
সৌরজগৎ নিয়ে গবেষণা করতে ১৯৭৭ সালে নাসা ভয়েজার ১ ও ২ মহাকাশযান প্রেরণ করে৷ প্রতিটিতে একটি করে সোনালি ডিস্ক রয়েছে৷ এতে পৃথিবীর বিভিন্ন শব্দ ছাড়াও আছে ৫৫ ভাষায় বলা শুভেচ্ছা বার্তা৷ এরমধ্যে বাংলাও আছে৷ সুব্রত মুখার্জি বলছেন, ‘‘নমস্কার, বিশ্বের শান্তি হোক৷’’ মহাকাশযান দুটি এখনও মহাকাশে সক্রিয় আছে৷
ছবি: picture alliance/Jet Propulsion Lab via AP/dpa
ইংরেজি ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত বর্ণ
২০১৮ সালে রিডার্স ডাইজেস্টের এক প্রতিবেদন জানায়, ‘কনসাইস অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি’তে থাকা প্রায় ২৪ হাজার শব্দে যত বর্ণ ব্যবহৃত হয়েছে তার মধ্যে ‘ই’ বর্ণের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১১ শতাংশ৷ এরপরেই আছে ‘এ’৷ ‘ই’ এর চেয়ে প্রায় ছয় হাজার শব্দে পিছিয়ে আছে ‘এ’ বর্ণ৷ নরওয়েজিয়ান, ফিনিশ, ফ্রেঞ্চ ও ইটালিয়ান ভাষায়ও ‘ই’ এর অনেক ব্যবহার আছে৷
সবচেয়ে নতুন ভাষা লাইট ওয়ার্লপিরি
অস্ট্রেলিয়ার উত্তরাঞ্চলে ওয়ার্লপিরি আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস৷ তারা ‘ওয়ার্লপিরি’ ভাষায় কথা বলে৷ তাদের সংখ্যা ৩-৪ হাজার৷ ৭০/৮০-র দশকে ওয়ার্লপিরি বাবা-মা সন্তানদের সঙ্গে কথা বলার সময় ইংরেজি ও ‘ক্রিয়ল’ ভাষার শব্দ ব্যবহার করতেন৷ এই তিন ভাষা শোনা বাচ্চারা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় আলাদা এক ভাষার জন্ম হয়, যা ‘লাইট ওয়ার্লপিরি’ নাম পেয়েছে৷ ঐ বাচ্চারা এতদিনে বড় হয়েছে৷ এখন তাদের সন্তানরাও এই ভাষা ব্যবহার করছে৷
জার্মানির ‘লাইবনিৎস ইনস্টিটিউট ফর দ্য জার্মান ল্যাঙ্গুয়েজ’ জানিয়েছে, ২০২০ সালে প্রায় ১,২০০ নতুন জার্মান শব্দ তৈরি হয়েছে৷ সাধারণত গড়ে প্রতিবছর প্রায় ২০০ নতুন জার্মান শব্দ তৈরি হয়৷ কিন্তু করোনার কারণে গতবছর রেকর্ড সংখ্যক শব্দ পাওয়া গেছে৷ যেমন করোনাম্যুডে (করোনায় ক্লান্ত), করোনাফ্রিজুয়া (করোনা হেয়ারস্টাইল), ইম্ফনাইড (টিকা পাওয়া ব্যক্তিদের প্রতি ঈর্ষা) ইত্যাদি৷
ছবি: Jürgen Fromme/firo/picture alliance
বানানো ভাষা
গেম অফ থ্রোনসের যাযাবর গোষ্ঠী ডোথরাকির সদস্যরা ডোথরাকি ভাষায় কথা বলেন৷ এই টিভি সিরিজের জন্য ডোথরাকি ভাষাটি তৈরি করেন ল্যাঙ্গুয়েজ ক্রিয়েটর ডেভিড পিটারসন৷ এমন প্রায় দুশোর মতো ভাষার সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলো বিভিন্ন বই, ফিল্ম ও টিভি সিরিজের প্রয়োজনে বানানো হয়েছে৷