দিল্লির বায়ুদূষণের মাত্রা গড়ে ৪০০ একিউআই-য়ের আশপাশে। স্বাভাবিকের চেয়ে যা বহুগুণ বেশি। গলা এবং ফুসফুসের রোগ বাড়ছে।
বিজ্ঞাপন
দিল্লির দূষণ নিয়ন্ত্রণ বোর্ড জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহে দূষণের মাত্রা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই বরং তা আরো বাড়তে পারে। হাওয়ার গতিবেগ এবং অভিমুখের উপর দূষণের মাত্রা নির্ভর করে। দিল্লির ভিতর হাওয়া যেভাবে বইছে, তাতে দিল্লির ধূলিকণা বাইরে বের হতে পারছে না। আবহাওয়া আচমকাই অনেক শুকনো হয়ে যাওয়ার জন্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ধূলিকণা বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। সে কারণেই দূষণের মাত্রা একধাক্কায় এতটা বেড়ে গেছে। তার উপর দীপাবলির দূষণ আবহাওয়ার আরো ক্ষতি করেছে।
দিল্লির পরিবেশমন্ত্রী গোপাল রাই রোববার জানিয়েছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দিল্লি এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে সমস্ত বাড়ি তৈরি এবং বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ থাকবে। নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য ৫৮৬টি দল তৈরি করা হয়েছে। যারা গোটা দিল্লিতে ছড়িয়ে পড়বে। কোথাও বাড়ি তৈরির বা ভাঙার কাজ দেখলেই তারা পুলিশকে জানাবে এবং আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দূষণ থেকে রেহাই নেই দিল্লির
প্রতি শীতেই ঘুরেফিরে শিরোনামে উঠে আসে বিষাক্ত দিল্লির বাতাস৷ কেন বদলাচ্ছে না বাস্তবতা, জানুন ছবিঘরে...
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/I. Aditya
কতটা দূষিত দিল্লি?
দিল্লির বাতাসে নিশ্বাস নেওয়া আর দিনে ২৫টা সিগারেট খাওয়ার প্রভাব ফুসফুসের ওপর সমান৷ এতটাই দূষিত ভারতের রাজধানীর বাতাস যে তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যূনতম বিপজ্জনক বাতাসের মানের চেয়ে ২০ গুণ খারাপ৷ ভারতের কেন্ত্রীয় দুষণ নিয়ন্ত্রক সিপিসিবি জানাচ্ছে, বাতাসের মানের মাপকাঠিতে সবচেয়ে বেশি দূষণের মাত্রা হয় ৫০০৷ দিল্লির বাতাস সেই মাপকাঠিতে কখনোই ৪৫০ থেকে নামে না ও প্রায়ই ৫০০ ছুঁয়ে থাকে
নিকটবর্তী হরিয়ানা ও পাঞ্জাবের কৃষিবর্জ্য পোড়ানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত যানচলাচল দিল্লির বাতাসকে নিশ্বাসের অযোগ্য করে তুলেছে৷ এছাড়া, ভারতের অন্যান্য শহরের চেয়ে তুলনায় দিল্লিতে বেশি শীতের আবহাওয়া থাকায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে ও বিভিন্ন দূষকের কণা বাতাসে আটকে থাকে৷
ছবি: DW/Catherine Davison
ভৌগলিক কারণ
ক্লিন এয়ার এশিয়ার ভারত অঞ্চলের প্রধান প্রার্থনা বরা ডয়চে ভেলেকে জানান, অবস্থানগত কারণের জন্য দিল্লির এই সমস্যা গুরুতর হচ্ছে৷ আশেপাশে কোনো জলাধার না থাকায় ও আবহাওয়ার ধাঁচ শীতপ্রধান ও শুষ্ক হওয়ায় দূষিত বাতাস পালাবার জায়গা পায় না৷ এছাড়া, তীব্র বেগে চলা বাতাস প্রায়ই সাথে করে আরো বাড়তি ধুরো নিয়ে আসে, যা আরো খারাপ করে পরিস্থিতি৷
ছবি: Gaurav Menghaney
প্রভাব
সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের পরিচালক অনুমিতা রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রতি শীতেই আমরা বিভিন্ন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিশ্বাসজনিত ও হৃদরোগ-সম্পর্কিত রোগীদের বাড়ন্ত দেখতে পাই৷ দীর্ঘদিন ধরে দূষিত বাতাসে শ্বাস নেওয়া স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের বিকাশ রোধ করে৷ দিল্লিতে বর্তমানে প্রতি তিনজনে একজন শিশুর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ বহু শিশুর ফুসফুস সম্পূর্ণ বেড়ে ওঠে না ও সেখানে রক্তক্ষরণও হয়=তে থাকে৷’’
ছবি: DW/Catherine Davison
কোভিড, উৎসব ও দূষণ
নিকৃষ্ট বাতাসের মান দিল্লির বাসিন্দাদের সবল ফুসফুসকে বিকল করছে৷ এরসাথে উৎসবের মরসুমে আতশবাজির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার প্রতি বছর নভেম্বর মাস থেকে এই মান আরো নিচে নামাতে থাকে৷ অসমর্থ্য ফুসফুস কোভিড সংক্রমণ টেকাতে পারছে না, ফলে হু হু করে বাড়ছে দিল্লিতে দৈনিক সংক্রমণ, মনে করছেন অনেকে৷ সোমবার দিল্লিতে একদিনে সাত হাজার ৭৪৫টি নতুন সংক্রমণ দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/D. Talukdar
কর্তৃপক্ষের অভিমত
২০১৯ সালে কৃষিবর্জ্য পোড়ানো থামাতে আইনী নির্দেশ এলেও, তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি৷ জাতীয় সবুজ ট্রাইবুনাল নভেম্বর মাসে আতশবাজি পোড়ানো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা করছে বলে জানাচ্ছে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম৷ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল ‘গ্রিন অ্যাপ’ চালু করেছেন, যাতে করে দুষণবিষয়ক নাগরিক নালিশ নথিভুক্ত করা যায়৷
ছবি: DW/A. Ansari
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অনুমিতা রায়চৌধুরীর মতে, অবিলম্বে শহরে বিকল্প গণপরিবহণের কথা ভাবতে হবে, বাড়াতে হবে সাইকেলের মতো পরিবেশবান্ধব যানচলাচল৷ পুনর্ব্যবহারের বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন ও শিল্পক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার চালু করতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি৷ তবে এসবের কিছুই সরকারী তৎপরতা ছাড়া সম্ভব নয়, মনে করেন রায়চৌধুরী৷
ছবি: DW/A. Ansari
7 ছবি1 | 7
পরিবেশবিদরা জানাচ্ছেন, এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) ৫০ এর মধ্যে থাকলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়। ৫০ থেকে ১০০ মোটামুটি। ১০০ থেকে ২০০ একিউআই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। ২০০ থেকে ৩০০ খারাপ। ৩০০ থেকে ৪০০ অত্যন্ত খারাপ। ৪০০ থেকে ৫০০ একিউআই শ্বাস নেওয়ার যোগ্য নয়।
দিল্লির গড় বায়ু দূষণের মাত্রা এখন ৪০০ একিউআই-য়ের ধারেকাছে। একটি হিসেব দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। সোমবার সকালে দিল্লির পাঞ্জাবি বাগের একিউআই ছিল ৩৭৫। শাদিপুরের দূষণের মাত্রা ৪০৬। ওয়াজিরপুরের ৪০৪। এনএসআইটি দ্বারকা ৩৯৯। অশোক বিহার ৪০০। বিমানবন্দর ৩৫৫। রোহিনী ৩৯৮। নেহরু নগর ৩৯৭।
পরিবেশবিদ দীপায়ন দে-র বক্তব্য, ''দূষণের মাত্রা টানা বেশ কিছুদিন এমন থাকলে বাড়ি থেকে বার হওয়াই বিপজ্জনক। এর ফলে দ্রুত ফুসফুসের রোগ হতে পারে। গলার সমস্যা হবেই।'' দীপায়নের বক্তব্য, প্রতিবছরই দূষণের মাত্রা বাড়লে সরকার পদক্ষেপ নেয়। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধানের পথে হাঁটে না। বছরের এই সময়ের জন্য আগে থেকেই কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করে রাখলে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কিছুটা হলেও এড়ানো সম্ভব। দীপায়নের বক্তব্য, দিল্লির ভৌগোলিক অবস্থানও এই দূষণের জন্য খানিকটা দায়ী। তবে সচেতন থাকলে দূষণের মাত্রা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
শুধু দিল্লি নয়, পার্শ্বর্তী পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারেও বায়ুদূষণের মাত্রা আশঙ্কাজনক। উত্তরপ্রদেশের কোথাও কোথাও দূষণের মাত্রা ৫০০ পর্যন্ত ছুঁয়েছে।
দিল্লি-নয়ডা সীমানায় থাকেন চিকিৎসক বিষ্ণু দে। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''গত এক মাসে ফুসফুস এবং গলার সমস্যা নিয়ে রোগী আসার পরিমাণ ১০ গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।'' বিষ্ণুর বক্তব্য, সাময়িক স্বস্তির জন্য কিছু ওষুধ দিলেও রোগ সারানোর ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না। দূষণের মাত্রা না কমলে ওষুধেও কাজ হবে না। এই পরিস্থিতিতে যতটা সম্ভব বাড়ির ভিতর থাকলেই ভালো।