বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্লগার, সাংবাদিক এবং অ্যাক্টিভিস্টদের উপর সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের হামলা গোটা বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে৷ এই বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে এক নতুন প্রচারণা শুরু করেছে ডয়চে ভেলে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানির বন শহরে গত জুনে অনুষ্ঠিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে এই প্রচারণার আওতায় এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়৷ প্রচারণাটির মাধ্যমে গোটা বিশ্বে বাকস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলোকে বিপদে থাকে অ্যাক্টিভিস্টদের আশ্রয় দেয়ার গুরুত্ব অনুধাবন করতে বলা হয়েছে৷
এই ফোরামে বাংলা ব্লগার এবং প্রকাশকদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনাকালে জার্মানির কেন্দ্রীয় সরকারের মানবাধিকার নীতি এবং মানবিক সহায়তা বিষয়ক কমিশনার ব্যার্বেল কফলার জানান, তিনভাবে পশ্চিমা দেশগুলো বিপদে থাকা অ্যাক্টিভিস্টদের সহায়তা করতে পারে৷ তিনি বলেন, ‘‘‘ফ্রিডম অনলাইন কোয়ালিশনে' আরো ২৯টি দেশের সঙ্গে সহায়তা করছে জার্মানি৷ এই কোয়ালিশনের লক্ষ্য হচ্ছে অ্যাক্টিভিজমের সঙ্গে সম্পৃক্তদের সহায়তায় আন্তর্জাতিক ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করা৷''
বাকস্বাধীনতা যেখানে যেমন
আপনার দেশে বাকস্বাধীনতা পরিস্থিতি কেমন? ডয়চে ভেলের দুই সাংবাদিক এই প্রশ্ন করেছিলেন সদ্য সমাপ্ত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে আগত বিভিন্ন দেশের ব্লগার, সাংবাদিক, অ্যাক্টিভিস্টদের৷
ছবি: DW/A. S. Brändlin
শাম্মী হক, অ্যাক্টিভিস্ট, বাংলাদেশ
‘‘বাংলাদেশের মানুষ তাদের মনের কথা বলতে পারেন না৷ সেখানে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই এবং প্রতিদিন পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে৷ একজন সামাজিক অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার হিসেবে আমি ধর্ম নিয়ে লেখালেখি করি, যা ইসলামিস্টরা পছন্দ করেনা৷ তারা ইতোমধ্যে ছয় ব্লগারকে হত্যা করেছে৷ ফলে আমি দেশ ছাড়তে বাধ্য হই৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ভেনেজুয়েলা
‘‘বাকস্বাধীনতা হচ্ছে এমন এক ধারণা যার অস্তিত্ব আমার দেশে নেই৷ সাংবাদিকরা জরিমানা আর নিজের জীবনের উপর ঝুঁকি এড়াতে সরকারের সমালোচনা করতে চায়না৷ সরকারের সমালোচনা করলে সাংবাদিকদের বিচারের মুখোমুখি হতে হয়৷ এরকম পরিস্থিতির কারণে অনেক সাংবাদিক দেশ ছেড়ে চলে গেছেন৷ দেশটির আশি শতাংশ গণমাধ্যমের মালিক সরকার, তাই সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রোমান দবরোখটভ এবং একাতেরিনা কুজনেটসোভা, সাংবাদিক, রাশিয়া
রোমান: ‘‘রাশিয়ায় সরকার আপনাকে সেন্সর করবে৷ আমাদের ওয়েবসাইটটি ছোট এবং লাটভিয়ায় নিবন্ধিত৷ ফলে আমি সেন্সরশিপ এড়াতে পারছি৷ তা সত্ত্বেও সরকার মাঝে মাঝে আমাদের সার্ভারে হামলা চালায়৷’’ একাতেরিনা: ‘‘রাশিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ইউরোপের মানুষ রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে স্বাধীন৷ আমি আশা করছি, রাশিয়ার পরিস্থিতিও বদলে যাবে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, সিরিয়া
‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় বাকস্বাধীনতার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ এমনকি আসাদের শাসনামল সম্পর্কে অনুমতি ছাড়া মতামতও প্রকাশ করা যায়না৷ এটা নিষিদ্ধ৷ কেউ যদি সেই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তাহলে খুন হতে পারে৷ আমি যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনামূলক কিছু লিখি, তাহলে বেশিদিন বাঁচতে পারবো না৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
আয়েশা হাসান, সাংবাদিক, পাকিস্তান
‘‘পাকিস্তানে ‘গণমাধ্যমের স্বাধীনতা’ শব্দ দু’টি খুবই বিপজ্জনক৷ এগুলোর ব্যবহার আপনার ক্যারিয়ার বা জীবন শেষ করে দিতে পারে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
রাবা বেন দউখান, রেডিও সাংবাদিক, টিউনিশিয়া
‘‘আমাদের অভ্যুত্থানের একমাত্র ফল হচ্ছে বাকস্বাধীনতা৷ আমরা এখন আমাদের সরকারের সমালোচনা করার ব্যাপারে স্বাধীন৷ এবং আমি যখন আমাদের অঞ্চলের অন্য দেশের বাসিন্দাদের বাকস্বাধীনতার কথা জিজ্ঞাসা করি, তখন একটা বড় ব্যবধান দেখতে পাই৷ আমাদের দেশে দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা আছে সত্যি, তবে বাকস্বাধীনতা কোনো সমস্যা নয়৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
খুসাল আসেফি, রেডিও ম্যানেজার, আফগানিস্তান
‘‘বাকস্বাধীনতা আফগানিস্তানে একটি ‘সফট গান৷’ এটা হচ্ছে মানুষের মতামত, যা সম্পর্কে সরকার ভীত৷ এটা চ্যালেঞ্জিং হলেও আমাদের প্রতিবেশীদের তুলনায় আমাদের অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
সেলিম সেলিম, সাংবাদিক, ফিলিস্তিন
‘‘ফিলিস্তিনে সাংবাদিকদের খুব বেশি স্বাধীনতা নেই৷ একটা বড় সমস্যা হচ্ছে, সাংবাদিকরা মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করতে পারে না৷ ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের গ্রেপ্তার করছে৷ তারা যদি ফেসবুকে তাদের মতামত জানায়, তাহলেও সরকার গ্রেপ্তার করে৷ তবে সিরিয়া বা ইরাকের চেয়ে অবস্থা ভালো৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
অনন্য আজাদ, লেখক, বাংলাদেশ
‘‘আমাদের দেশে কোনো বাকস্বাধীনতা নেই৷ আপনি ইসলাম বা সরকারের সমালোচনা করে কিছু বলতে পারবেন না৷ ইসলামী মৌলবাদীরা ঘোষণা দিয়েছে, কেউ যদি ইসলামের সমালোচনা করে, তাহলে তাকে হত্যা করা হবে৷ আমি একজন সাংবাদিক এবং গত বছর আমাকে ইসলামিস্ট জঙ্গিরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ফলে আমাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে৷’’
ছবি: DW/A. S. Brändlin
9 ছবি1 | 9
দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল যুগে গোপনীয়তার অধিকার সংক্রান্ত একটি ঘোষণাপত্র মানুষের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য একজন বিশেষ প্রতিনিধি নিয়োগ করেছে জাতিসংঘ৷ রাজনীতিবিদ কফলারের ভাষায়, ‘‘জার্মানি ‘ওপেন অবজারভেটরি অফ নেটওয়ার্ক ইন্টারফেস' নামক একটি সফটওয়্যারের জন্য অর্থায়ন করছে, যা কিনা ইন্টারনেটে সেন্সরশিপ, নজরদারি এবং ট্রাফিক মেনিপুলেশনের মতো বিষয়গুলো শনাক্ত করতে সক্ষম৷''
গ্লোবাল মিডিয়া ফোরামে কফলারের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নেন প্রকাশক আহমেদুর রশীদ চৌধুরী এবং ব্লগার শাম্মি হক এবং অনন্য আজাদ৷ এঁরা সবাই বাংলাদেশি৷ হক এবং অনন্যকে জার্মানি রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে আর চৌধুরী আশ্রয় পেয়েছেন নরওয়েতে৷
২০১৫ সালে নিজের ব্যবসা এবং বাড়ি, যা তৈরিতে প্রায় বিশ বছর সময় লেগেছিল, ছেড়ে ইউরোপে চলে আসতে বাধ্য হন৷ তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ খোলা চোখে মনে হতে পারে, এটি একটি গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে কোনো গৃহযুদ্ধ নেই, কোনো সমস্যা নেই৷ অথচ তারপরও ব্লগার এবং অন্যান্যদের ওপর হামলা হচ্ছে এবং অনেকেই খুন হচ্ছেন৷ এই অবস্থায় কিছু মানুষ নিজের বাড়িতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন৷ কেউ কেউ পর্যটক ভিসা নিয়ে আশেপাশের দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন৷ অবস্থা এমন যে, তাঁরা পুলিশের কাছে গেলে পুলিশ সহায়তা দেয়ার বদলে তাঁদের বিদেশে চেলে যেতে বলে৷ বলে বাংলাদেশ মুক্তমনাদের দেশ নয়৷''
দেশত্যাগ যেমন সহজ কোনো ব্যাপার নয়, তেমনি উগ্র ইসলামপন্থিদের কালো তালিকায় থাকা অনেক অ্যাক্টিভিস্টের জন্য খোলামেলা বাঁচাও সহজ নয়৷ ‘‘আমি সাতমাস আগে দেশত্যাগ করেছি৷ আমার কয়েকজন বন্ধুও তাঁদের পরিবারসহ ভারত এবং নেপালে চলে গেছে'', বলেন আজাদ৷ তবে তিনি মনে করেন, নির্বাসিত জীবনের সঙ্গে বাংলাদেশে তাঁর যে জীবন ছিল তার সঙ্গে তুলনা চলে না৷
হক, যিনি হত্যার হুমকি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করেন, যোগ করেন, ‘‘এখানে বসবাস করা খুবই কঠিন, কেননা আমি অনেক নিঃসঙ্গ বোধ করি৷''
চলতি বছর ‘দ্য বব্স’ পুরস্কার জিতেছে যারা
চলতি বছর বাংলা ভাষার তিনটিসহ বিশ্বের ১৪টি ভাষার বেশ কয়েকটি অনলাইন প্রকল্প এবং ব্লগ ‘দ্য বব্স’ অ্যাওয়ার্ড জয় করেছে৷ চলুন সেসবের মধ্য থেকে জুরি অ্যাওয়ার্ড এবং বাংলা ভাষার বিজয়ীদের দেখে নেই৷
ছবি: germanprobashe.com
সামাজিক পরিবর্তন: স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাক
ভারতে অ্যাসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে চালানো প্রচারণা ‘স্টপ অ্যাসিড অ্যাটাকস’ বা এসএএ সংগঠন দ্য বব্স-এর ‘সামাজিক পরিবর্তন’ বিভাগে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছে৷ অ্যাসিড হামলার শিকারদের সঙ্গে সমাজের মধ্যকার যোগসূত্র স্থাপনে কাজ করছে সংগঠনটি, কেননা হামলার শিকাররা অধিকাংশক্ষেত্রে সমাজ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন৷ এর কারণ তারা মুক্ত পরিবেশে চলাফেরার শক্তি হারিয়ে ফেলেন৷
ছবি: stopacidattacks.org
প্রগতির জন্য প্রযুক্তি: গেরশাদ অ্যাপ
ইরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশের নজর এড়াতে তৈরি এক অভিনব অ্যাপ এটি৷ এই পুলিশ বাহিনী রাস্তায় মেয়েরা হিজাবসহ ‘ইসলামিক পোশাক’ পরেছে কিনা তা লক্ষ্য করে এবং প্রয়োজনে শাস্তি দেয়৷ যখনই কোনো রাস্তায় এই পুলিশ বাহিনী চেকপোস্ট বসায়, অ্যাপের মাধ্যমে তা অন্যরা জেনে যায়৷ ফলে সহজেই পুলিশি হয়রানি এড়াতে সেই চেকপোস্ট পরিহার করে চলা সম্ভব হয়৷ অ্যাপটির ব্যবহারকারীরাই তথ্য দিয়ে অ্যাপটিকে সমৃদ্ধ করে৷
ছবি: gershad.com
শিল্প এবং সংস্কৃতি: ‘সেন্ট্রুম ফর পলিটিশে শ্যোনহাইট’
শিল্প এবং রাজনীতির সীমান্তে প্রতিবাদের আয়োজন করে জার্মানিতে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেছে ‘সেন্টার ফর পলিটিক্যাল বিউটি’৷ উদ্দীপক প্রতিবাদের পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে প্রকল্পটি৷ ডয়চে ভেলের দ্য বব্স প্রতিযোগিতায় কোনো জার্মান প্রতিযোগীর জুরি অ্যাওয়ার্ড জয় এক বিরল ঘটনা৷
ছবি: ZPS
নাগরিক সাংবাদিকতা: রেজর’স এজ
বাংলাদেশে উগ্রপন্থিদের ধারাবাহিক হামলায় মুক্তমনাদের নিহতের ঘটনা তুলে ধরে তৈরি ভিডিও তথ্যচিত্র ‘‘রেজর’স এজ’’ দ্য বব্সের ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ বিভাগে ‘জুরি অ্যাওয়ার্ড’ জয় করেছে৷ ছদ্মনামে ব্লগ লেখা ব্লগার ‘নাস্তিকের ধর্মকথা’ এবং তাঁর স্ত্রী তথ্যচিত্রটি তৈরি করেছেন, যেখানে ব্লগার এবং মুক্তমনাদের হত্যার পেছনের নোংরা রাজনীতি তুলে ধরা হয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
পিপল চয়েস বিজয়ী: জিএমবি আকাশের ইন্সটাগ্রাম পাতা
এছাড়া বাংলাদেশের আলোকচিত্রী জিএমবি আকাশ ছবিকে তাঁর নিজের ভাষা মনে করেন, যার মাধ্যমে তিনি গোটা বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন৷ তাঁর ইন্সটাগ্রাম পাতাটি চলতি বছর দ্য বব্সের ‘শিল্প এবং সংস্কৃতি’ বিভাগে ‘পিপল চয়েস’ পুরস্কার জয় করেছে৷ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভোটের ভিত্তিতে এই পুরস্কার দেয়া হয়৷
ছবি: GMB Akash/instagram
পিপল চয়েস বিজয়ী: জার্মান প্রবাসে
জার্মানিতে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালিদের মধ্যে এক মেলবন্ধন তৈরি করছে জার্মান প্রবাসে ওয়েবসাইটটি৷ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ভোটে এই সাইটটি দ্য বব্স প্রতিযোগিতার বাংলা ভাষা বিভাগে ‘পিপল চয়েস’ পুরস্কার জয় করেছে৷ বব্স বিজয়ী অন্যান্য প্রকল্পগুলো সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন ‘আরো’ বাটনে৷