স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হতাশ নতুন প্রজন্ম। তারা মনে করে একটি বিভক্তির শক্ত দেয়াল আছে। সেই দেয়াল সরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
ছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে শাহবাগ এবং শাপলা চত্বরে তরুণদের মধ্যে যে দুই ধারা তা অস্বীকার করছেন না কেউই। তবে এর জন্য তারা দায় দিচ্ছেন যারা বিভিন্ন সময় স্বাধীনতার পর দেশ শাসন করেছেন তাদের ওপর। তারা মনে করেন সঠিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। শাসক গোষ্ঠী নিজেদের মত করে ইতিহাস রচনা করেছে। ফলে ইতিহাস নিয়ে নতুনেরা বার বার বিভ্রান্তিতে পড়েছে। এটাই দেয়াল তৈরির মূলে কাজ করেছে নতুন প্রজন্মের মধ্যে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও আছে স্বার্থের নানা ধরনের বিভক্তি। জাতীয় বিষয়গুলোতেও ঐকমত্যের অভাব প্রকট।
ঢাকার যাত্রাবাড়ি মাদ্রাসার ছাত্র মীর হাবিব আল মানজুর বলেন,"আমরা শাহবাগ আর শাপলা চত্বরে তরুণদের মধ্যে যে বিভক্তি দেখেছি তা হওয়ার কথা ছিল না, তবে ২০১৩ সালের পর এটা কমে এসেছে। কারণ তরুণদের মধ্যে ইন্টারঅ্যাকশন বেড়েছে। আমরা যে ব্যাকগ্রাউন্ডেরই হইনা কেন এখন আমরা পরস্পরকে বুঝতে চেষ্টা করছি। আমরা নানা মতের ভিন্নতাও অনুধাবন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এটা আরো অনেক আগে থেকেই হওয়া দরকার ছিলো। তাহলে জাতির মধ্যে যে বিভক্তি তা কমে আসত।”
মারজুক রায়না
This browser does not support the audio element.
স্বাধীনতার ৫০ বছরে তার উপলব্ধি,"আমরা বড় পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এখনো ছোট ছোট পরাধীনতার মধ্যে আছি। এখানে ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বাকস্বাধীনতা এখনো নিশ্চিত হয়নি। এগুলো নিশ্চিত হলেই আমরা প্রকৃত স্বাধীন হবো। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের পরস্পরের প্রতি দরদী হতে হবে। পরষ্পরের প্রতি সম্মান বোধ থাকতে হবে।”
সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র মামুন সোহাগ মনে করেন,"দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে। সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দেশ তথ্য প্রযুক্তিতে এগোচ্ছে সেটাও ভালো। কিন্তু দেশের ভিতরে বড় একটি বিভেদের দেয়াল দেখতে পাচ্ছি। তরুণেরা যেন এখন রাজনীতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। তাদেরও ভাগ করে ফেলা হচ্ছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, বইয়ে পড়েছি। জেনেছি তরুণেরাই প্রধানত মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছেন। দেশ স্বাধীন করেছেন যে তরুণেরা তারাই তো দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। কিন্তু তাদের সঠিক পথ দেখাতে হবে। দেয়াল রাখা চলবে না। রাজনৈতিক বিভক্তি কাউকে শাহবাগে কাউকে শাপলা চত্বরে নিচ্ছে। এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থাও দায়ী। তরুণদের বিভক্ত না করে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে দেশের উন্নয়নে লাগাতে হবে।”
মীর হাবিব আল মানজুর
This browser does not support the audio element.
অর্থনৈতিক উন্নয়ন হলেও সামাজিক বৈষম্য এবং রাজনীতিতে আদর্শহীন স্বার্থের দ্বন্দ্ব দেখতে পাচ্ছেন ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষার্থী মারজুক রায়না। তার কথা,"এখানে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বা বিরোধিতা আদর্শিক নয়। স্বার্থের জন্য। তার প্রভাব পড়ছে তরুণদের মধ্যে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিলো তা হয়নি। আমরা এখনো একটা জাতি হতে পারিনি। ধর্মের ভিত্তিতে ছোট ছোট জাতিতে বিভক্ত হয়ে পড়ছি।”
তিনি আরো বলেন,"দুর্নীতি, অর্থপাচার বেড়েছে। যারা ক্ষমতাবান তাদের হাতে সব কিছু চলে যাচ্ছে। স্বাধীনতার চেতনা এটা নয়।” একজন তরুণ হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চান।
তার কথা," মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সেই বাংলাদেশ তরুণেরাই গড়তে পারবে। তাই বিভক্ত করার সব অপচেষ্টা রোধ করা দরকার। শিক্ষায় তার প্রতিফলন থাকতে হবে। থাকতে হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থায়।”
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুকাইয়া জহির মনে করেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার নারী হলেই নারীরা ভালো আছেন সেই উপসংহারে যাওয়া যায় না। দেশের সাধারণ নারীরা কেমন আছেন সেটাই বড় প্রশ্ন। তার কথা,"সাধারণ পর্যায়ে তো দূরের কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এখনো নির্যাতন, হত্যার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়েছে, কমেনি। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে।” তার অভিমত দেশের উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে,"সুশাসন, মানবাধিকার, ন্যায় বিচার এগুলো জরুরি। সবচেয়ে দরকার সামাজিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার। আর প্রয়োজন স্বার্থের বিভক্তি দূর করা। আমরা একটি বিভক্তিহীন রাষ্ট্র দেখতে চাই।”
৫০ বছরেও ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র না পাওয়ার আক্ষেপ
বিশ্বের বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্থান করে নেয়ার ৫০ বছর পূর্তিতে এ দেশের অগ্রযাত্রায় মুক্তিযোদ্ধারা আনন্দিত৷ কিন্তু অনেকে মনে করেন এখনো ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, এখনো গন্তব্য বহুদূর৷
ছবি: picture alliance/Pacific Press Agency/B. H. Rana
‘সঠিক ইতিহাস প্রজন্ম যেন জেনে নেয়’
বরিশালের সৈয়দ আবদুল মালেক একাত্তরে যুদ্ধ করেন নয় নম্বর সেক্টরে৷ ডান পায়ে গুলি লাগে৷ এখনও স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না৷ ১৯৭৩ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দেন পটুয়াখালিতে, দীর্ঘ কর্মজীবন শেষে অবসরে যান সচিব হিসেবে৷ তিনি বলেন, ’’দেশের জমি কমেছে, মানুষ বেড়েছে, তবুও খাদ্যে স্বয়ংসম্পন্ন আমরা৷ কর্মসংস্থান ও আয় বেড়েছে৷ এগুলো দেখলেই তৃপ্ত হই৷ তবে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসটা প্রজন্ম যেন জেনে নেয়৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘বাংলাদেশ পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া’
সাব-সেক্টর কমাণ্ডার মাহফুজ আলম বেগ ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের এলিট কমান্ডো৷ একাত্তরে কৌশলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন৷ স্বাধীনতার পর চাকরি জীবন শুরু করেন, সবশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন৷ এখনও স্বপ্ন দেখেন দেশকে নিয়ে৷ বললেন, ‘‘বাংলাদেশ পেয়েছি, এটাই বড় পাওয়া৷ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এর চেয়ে বড় সফলতা আর কী আছে!’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ এখনো হয়নি’
রমা রানী দাস ট্রেনিং নেন ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগের কাছে৷ নয় নম্বর সেক্টরের অধীনে সাতক্ষীরা, ভোমরা, আসাশুনিতে গুপ্তচরের ভূমিকা পালন করতেন৷ স্বাধীনতার পর ঝালকাঠি হরচন্দ্র সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে সুনামের সঙ্গে শিক্ষকতা করেন৷ দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত৷ তবে রমা রানী বলেন, ‘‘স্বাধীন দেশে ভালো আছি৷ তবে অসাম্প্রদায়িক দেশের স্বপ্ন দেখেছিলাম৷ সেটা এখনও হয়নি৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘ধর্মনিরপেক্ষতা বাধার মুখে পড়েছে’
ডা. মোহাম্মদ সিরাজুল হক একাত্তরে ধলেশ্বরীতে জোনাল কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন৷ স্বাধীনতার পর যোগ দেন চিকিৎসা পেশায়৷ স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রথম ট্রেজারার তিনি৷ সব মিলিয়ে তৃপ্ত হলেও একটা আক্ষেপ আছে তার, ‘‘বঙ্গবন্ধু টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া মুসলমানদের নিয়েই একটা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার দিকটা বাধার মুখে পড়েছে৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়টাই যেন বড় হয়
সিলেটের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রুহুল আহম্মদ বাবু একাত্তরে ট্রেনিং নেন আসামে৷ চার নম্বর সেক্টরে দিলখুশা চা বাগান অপারেশনে সাবমেশিন গানের গুলিতে তার বাম পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়৷ স্বাধীনতার পর ব্যবসা শুরু করেন৷ এখন সানি স্যোলার লিমিটেড নামক একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি দেখতে চাই না– তুমি হিন্দু কি মুসলমান৷ দেখতে চাই, তুমি মানুষ কিনা, তুমি বাংলাদেশকে ভালবাসো কিনা, তুমি বাঙালি কিনা৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘গণতন্ত্রের নামে যেন রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হয়’
মো. সাইফুল আলম আট নম্বর সেক্টরে গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন৷ স্বাধীনতার পর আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন৷ সহকারি জজ, জেলা জজের দায়িত্ব শেষে দুদকের মহাপরিচালক হিসাবে অবসরে যান৷ তিনি বলেন, ‘‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ৷ গণতন্ত্রের নামে যেন পরোক্ষ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা না পায় সেদিকেও খেয়াল রাখা দরকার৷ ফাইনান্সিয়াল অফেন্স, আর সেক্সচুয়াল অফেন্স কমিয়ে আনতে না পারলে সোনার বাংলা হবে না৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরতে হবে’
অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন একাত্তরে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেন দুই নম্বর সেক্টরে৷ নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক ছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা, উপ-উপাচার্য ছিলেন চার বছর৷ অবসরের পরও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনারারি প্রফেসর হিসেবে কাজ করছেন৷ বললেন, ‘‘তৃণমূলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে আনাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সরকারকেই নিতে হবে৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
‘মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক’
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে করিমপুর ইয়ুথ ক্যাম্পের সঙ্গে সহকারি প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হন যুদ্ধ-আলোকচিত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হামিদ রায়হান৷ পরে বাংলাদেশ ভলান্টারি সার্ভিসেস কোর-এর আলোকচিত্রী হিসেবে যোগ দেন৷ মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ও ঘটনা ক্যামেরায় ধরে রেখেছেন৷ এই আলোকচিত্রী বলেন, ‘‘মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলো প্রজন্ম দেখুক৷ ছবি দেখে প্রজন্ম ভাবুক কত কষ্ট আর ত্যাগের বিনিময়ে আমার স্বাধীনতা পেয়েছি৷’’
ছবি: Salek Khokon/DW
8 ছবি1 | 8
তিতুমীর কলেজের আরেকজন শিক্ষার্থী আল ইমরান মনে করেন. স্বাধীনতার এই ৫০ বছরেও তরুণদের একাংশের মধ্যে স্বাধীনতার গুরত্ব নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। চিন্তায় পার্থক্য আছে। জানাশোনায় পক্ষপাতিত্ব আছে। ফলে কারো কারো কাছে হয়তো মনে হচ্ছে এটা গুরুত্বহীন। তবে তার কথা, "এই দায় তরুণদের দিলে চলবে না। যাদের দায়িত্ব ছিলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা, তরুণদের মাঝে সঞ্চারিত করা তারা তা করেননি। তারা ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও দলীয় স্বার্থে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আর বাক স্বাধীনতাও সংকুচিত হয়ে পড়ছে।”
তারপরও ইমরান মনে করেন," বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অনেক সংকট নিয়েও। একদিন হয়তো বিশ্বে রোল মডেলও হবে। আর সেটা হবে তরুণদের হাত ধরেই।”