‘নিজেদের স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষ্য নেই’
১৯ জুন ২০২০![Bangladesch | Coronavirus | Suhrawardy Medical College and Hospital in Dhaka](https://static.dw.com/image/53867952_800.webp)
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি অ্যান্ড রাইটসের উপদেষ্টা ডা. আব্দুন নূর তুষার বলেছেন, আমাদের নিজেদের স্বাস্থ্য নিয়ে কোন লক্ষ্য কখনই ছিলো না, এখনো নেই৷ আমরা শুধু বিভিন্ন জনের প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করছি৷ এই কারণে সিস্টেমটা জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে৷
ডয়চে ভেলে : স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও কেন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের এই করুণ দশা?
ডা. আব্দুন নূর তুষার : আমাদের স্বাস্থ্যখাত কখনই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পরিচালিত হয়নি৷ স্বাস্থ্যখাতে মৌলিক লক্ষ্যগুলো নির্দিষ্ট করতে না পারার ফলে একটা জগাখিচুড়িতে পরিণত হয়েছে৷ এ দেশে বেসরকারি খাতে উচ্চমূল্যের হাসপাতাল যেমন আছে, তেমনি সরকারি খাতে প্রায় ফ্রি হাসপাতালও আছে৷ এখানে যেমন সরকার বিনামূল্যে ওষুধ দেয়, আবার অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা বেসরকারি জায়গা থেকে করতে হয়৷ অর্থাৎ এখানে সিস্টেমটা অনেকটা খিচুড়ির মতো৷ সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, এনজিও সবকিছু মিলিয়ে এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আপনাকে সেবা পেতে গেলে বিভিন্ন দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়৷ এই কারণে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার এই বেহাল অবস্থা৷
এই অবস্থার জন্য আপনি কাদের দায়ী করবেন?
এই অবস্থার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপক এবং বিভিন্ন সময় যারা স্বাস্থ্যকে নিয়ে কাজ করেছেন আমি তাদের দায়ী করবো৷ তারা এডহক ভিত্তিতে অর্থাৎ দিন এনে দিন খায় ভিত্তিতে স্বাস্থ্যকে পরিচালিত করেছে৷ টিকা দিতে হবে তাই টিকা দাও, পোলিও থামাতে হতে তাই থামাও, ভিটামিন খাওয়াতে হবে তাই খাওয়াও অর্থাৎ আমরা বিভিন্ন জায়গার প্রেসক্রিপশনকে শুধু ফলো করেছি৷ আমাদের নিজেদের কোন স্বাস্থ্য বিষয়ক লক্ষ্য ছিলো না এবং এখনো নেই৷
করোনা চিকিৎসায় আমরা সফল না ব্যর্থ?
করোনা চিকিৎসায় আমরা সফল৷ কারণ আমাদের যে উপকরণ আছে, অর্থাৎ যন্ত্রপাতি, অক্সিজেন বা ভেন্টিলেটরসহ যে সব উপকরণ আছে এবং তার যে সরবরাহ আছে সেই তুলনায় আমাদের হাসপাতালগুলোতে মৃত্যুর হার অনেক কম৷ আমি বলবো যে, আমাদের চিকিৎসকরা এই স্বল্প সুবিধার মধ্যে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সফলতা দেখাচ্ছেন৷ কিন্তু যেটা সমস্যা সেটা হল, জনসংখ্যা বেশি হওয়ার কারণে অধিক সংখ্যক মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মতো সক্ষমতা আসলে আমাদের হাসপাতালগুলোর নেই৷ আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা এত রোগীকে একসঙ্গে চিকিৎসা দেওয়ার সক্ষমতা রাখে না৷
প্রথমদিকে তো চিকিৎসকদের কাছে সুরক্ষা সামগ্রী ঠিকমতো পৌঁছেনি, আপনি নিজেও অভিযোগ করেছেন৷ এখন কি অবস্থা?
পুরো বাংলাদেশেই আসলে সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব ছিল৷ এটা বুঝতে পেরে আমরা কথা বলেছিলাম এই জন্য যে, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী এবং জরুরি সেবা প্রদানকারী যারা আছেন তাদেরকে সুরক্ষা দিতে না পারলে জনগণ সমস্যায় পড়বে৷ জনগণ সেবা পাবে না৷ আপনি যার কাছ থেকে সেবা পাবেন তাকে যদি সুরক্ষা দিতে না পারেন তাহলে সে তো সেবা দিতে পারবে না৷ আমি বলবো যে, আমরা বলবার পর অনেকখানি এগিয়েছে৷ তারপরও বাজারে বহু ভেজাল সুরক্ষা সামগ্রী আছে৷ সঠিক সুরক্ষা সামগ্রীর অভাব এখনো আছে৷
চিকিৎসকদের দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগও করছেন অনেকে৷ বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকেরা প্রথমদিকে কোন সেবাই দেননি?
এই কথাটা আসলে সর্বাঙ্গে সত্য নয়৷ আমাদের বুঝতে হবে যে, আমাদের বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে ছোঁয়াচে রোগের সেবা দেওয়ার সক্ষমতা নেই৷ সংক্রমিত রোগী আর সংক্রমণহীন রোগী আলাদা করার ব্যবস্থা অধিকাংশ হাসপাতালে নেই৷ কারণ হাসপাতালগুলো ভাড়া বাসায় বা অন্য কাজে তৈরি এমন ভবনে স্থাপিত৷ ফলে সংক্রমিত রোগী ভর্তি করলে সংক্রমণহীন রোগীর অনেক বেশি মৃত্যু হওয়ার বা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল৷ ডাব্লিউএইচও এবং জাতীয় গাইডলাইন মেনেই চিকিৎসকেরা রোগীদের কোভিড হাসপাতালে রেফার করেছেন৷ এটাকেই মানুষ বলেছেন আমরা সেবা পাচ্ছি না৷ তবে অধিকাংশ হাসপাতালে কোন রোগী এলে তিনি সম্ভাব্য কোভিড রোগী কি-না তা আলাদা করার ব্যবস্থা ছিলো না৷ এর একটি বড় কারণ হলো চিকিৎসা খাতে জনবলের অভাব আছে৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলো অধিকাংশই অর্ধেক জনবল দিয়ে পরিচালিত হয়৷ তাদের অধিকাংশ ডাক্তারও চুক্তিতে কাজ করেন৷ নিয়োগপত্র পান না৷ আমাদের এই ডাক্তারেরা অনেকেই দৈনিক টাকার ভিত্তিতে কাজ করেন৷ অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদের বেতন কেটে নিয়েছে, চাকরিচ্যুত করেছে এবং অনেককে দীর্ঘ মেয়াদি ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে৷ এইসব কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে৷ এটা কিন্তু স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ত্রুটি৷ চিকিৎসকদের ত্রুটি নয়৷ আমি নাম উল্লেখ না করেই বলি, একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে কোভিড রোগী ভর্তি হওয়ার পর চিকিৎসকেরা সুরক্ষা সামগ্রী দাবি করায় তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে, চাকরিচ্যুত করা হয়েছে৷ এমন অসংখ্য প্রমাণ আছে৷ এটা আসলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কোন শৃঙ্খলা না থাকা৷
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা সরকারি হাসপাতালের ডিউটির চেয়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখতে কেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
এই কথাটাও সত্য নয়৷ কোভিডের সময় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা প্রাইভেট চেম্বার বন্ধ করে দিয়েছেন৷ কারণ ওই চেম্বার থেকে সংক্রমণের সম্ভাবনা অনেক বেশি ছিল৷ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাইভেট চেম্বার কেন করেন? এই প্রশ্ন যদি করেন তাহলে বলবো, ১০ থেকে ১৫ বছর পড়াশোনা করে অসংখ্য প্রশিক্ষণের পর তিনি সরকারি চাকরিতে গ্রেড-৩ এর উপরে যেতে পারেন না৷ অর্থাৎ তার সরকারি চাকরির যে সীমানা সেটা সমসাময়িক অন্যান্য চাকরিজীবীদের চেয়ে নিচে ৷ আপনি আমাকে বলেন, সমপরিমাণ যোগ্যতা ও পদ থাকার পরও কেন একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে সরকার গাড়ি দেয় না৷ অথচ একজন উপ-সচিবকে দেয়৷
করোনার প্রেক্ষাপটে আমাদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা খাতে কি ধরনের অব্যবস্থাপনা ছিলো?
এটা একটা বৈশ্বিক মহামারী৷ এই মহামারি থেকে আমাদের যত আগে বের হয়ে আসতে পারবো তত আগেই সেটা করা উচিৎ ছিলো৷ সেই লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করার দরকার ছিলো৷ আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু দীর্ঘসূত্রিতা দেখেছি৷ অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে আমাদের মনে হয়েছে, এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে৷ সিদ্ধান্ত এসেছে, কিন্তু তার থেকে যে সুফল পাওয়ার দরকার ছিলো সেটা আমরা পুরোপুরি পাইনি৷ আরেকটা হলো, এই বৈশ্বিক মহামারীকে নিয়ন্ত্রণ করতে যে সচেতনতার দরকার ছিলো তা সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমরা সফল হইনি৷
সামনে কি করা উচিত, আপনার পরামর্শ কী?
সামনের দিনগুলোতে করোনা রোগটিকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনে কারফিউ, প্রয়োজনে চূড়ান্ত লকডাউন দেওয়া প্রয়োজন৷ পাশাপাশি টেস্ট বাড়িয়ে একটা মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দেওয়া৷ ১০০ দিন বা ১২০ দিনের পরিকল্পনা করে এর মধ্যেই বাংলাদেশকে করোনা মুক্ত করার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে পড়া৷ দ্বিতীয়, আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যদি অর্থনীতি বাঁচাতে চাই তাহলে এই রোগটিকে দূর করতেই হবে৷ সমাজে করোনা থাকা অবস্থায় লোকজন বিনিয়োগ করবে না, দোকান খুললে সেখানে ক্রেতা যাবে না- এমন একটি সমস্যা থেকে যাবে৷ অর্থনীতির চাকা ঘুরবে না, যদি মানুষ সুস্থ না থাকে৷ করোনা যদি অনেক ছড়িয়ে যায় তাহলে যতই আমরা দোকান পাট, রাস্তাঘাট খুলে দেই না কেন আমাদের অর্থনীতি কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে না৷ এই কারণে আগে করোনা দূর করতে হবে, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তাহলেই কেবল অর্থনীতি তার গতি ফিরে পাবে৷