জার্মান লুফৎহানসার ইঞ্জিনিয়ার ও মেকানিকরা অনেক সময় শুধু নিজের চোখ আর অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে জেট ইঞ্জিনগুলোকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেন, কোথাও কোনো ফাটল আছে কিনা৷
বিজ্ঞাপন
আকাশে বিমান চলাচলের কোনো অন্ত নেই৷ শুধু জার্মানিতেই প্রতিবছর ২০ লাখ বার হয় কোনো বিমান আকাশে উঠছে, অথবা আকাশ থেকে নামছে৷ বিমানগুলোর জন্যও এটা একটানা চাপ৷ বিমানের কোথাও কোনো কিছু খারাপ হয়েছে কিনা, তা জানার জন্য নিয়মিত চেক করা প্রয়োজন৷
হামবুর্গে লুফৎহানসার প্রযুক্তি বিভাগ, মানে ওয়ার্কশপ, অর্থাৎ কর্মশালা৷ ইঞ্জিনিয়ার আর মেকানিকরা এখানে জেট বিমানের ইঞ্জিনগুলো খুলে দেখেন, ভেতরে সব ঠিক আছে কিনা৷ ইঞ্জিনের অনেক ভেতরে কমবাশন চেম্বার; এটা হলো বিমানের সেই অংশ, ওড়ার সময় যার ওপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে৷ এই ‘দহনকক্ষ’-কে ২,০০০ সেন্টিগ্রেডের বেশি তাপমাত্রা সহ্য করতে হয়, তাও আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে৷ এখানে কোনো কিছু খারাপ হলে, গোটা ইঞ্জিনটাই বন্ধ হয়ে যেতে পারে৷ ওদিকে এই বহুমূল্য অংশগুলোকে যথেচ্ছ বদলে দেওয়া যায় না৷ কাজেই মেকানিকরা ক্ষয়ক্ষতি মেরামত করে নিলে অনেক সাশ্রয় হয়৷ এ কারণে মেকানিকরা ইঞ্জিনের প্রতিটি অংশ খুঁটিয়ে দেখেন৷ দেখেন কোথাও কিছু বিকল হয়েছে কিনা৷ তাঁদের অভিজ্ঞতার উপর বিমানযাত্রীদের নিরাপত্তা নির্ভর করবে৷
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ/অনিরাপদ এয়ারলাইন্সের তালিকা
২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৬০টি এয়ারলাইন্সের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে অনিরাপদ এয়ারলাইন্সগুলোর তালিকা করেছে জার্মানির জেএসিডিইসি ইনস্টিটিউট৷ তালিকাটি দেখে বোঝা যায় বিমানযাত্রায় বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে মানুষ৷
ছবি: Reuters/E. Su
অনিরাপদ চায়না এয়ারলাইন্স
২০১৬ সালে ৩৭০ কোটি যাত্রী তাদের বিমানে যাতায়াত করেছে৷ যাঁরা চায়না এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করেছেন তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে এটি একটি অনিরাপদ পরিবহন৷ তাই ৬০ টি এয়ারলাইন্সের তালিকায় তাইওয়ানিজ এয়ারলাইন সবচেয়ে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/X. Qintao
কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার বিকল্প নেই
গত ৩০ বছরের নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে ঐ তালিকা করা হয়েছে৷ বিমান কতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, কত যাত্রী নিহত হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে কিনা, এছাড়া কত কিলোমিটার যাত্রা করেছে এবং যাত্রী সংখ্যা কত- এসবের ভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে৷ এসবের ভিত্তিতে তাদের ০ থেকে ১.০০ পয়েন্ট দেয়া হয়েছে৷ কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার স্কোর দাঁড়িয়েছে ০.৯১৪৷ ২০১৬ সালের সবচেয়ে খারাপ বিমানের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান তাদের৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইন্দোনেশিয়ায় এয়ারলাইন্সে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি
গারুদা ইন্দোনেশিয়ার স্কোর ০.৭৭৭৷ খারাপ বিমানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়৷ ১৯৫০ সালে চলাচল শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই এয়াররলাইন্স ৪৭টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ৫৮৩ জন৷
ছবি: A.Berry/AFP/GettyImages
গবেষণা নিয়ে সমালোচনা
কিন্তু জেএসিডিইসি’র তালিকা কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েছে, কেননা, টেকনিক্যাল কোনো ত্রুটির কথা তারা উল্লেখ করেনি৷ এমনকি মানব আচরণের সমস্যার কথাও নেই সেখানে৷ আবহাওয়া বা সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ নেই, যেমন, সন্ত্রাসবাদ বিমানের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এর কারণে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিমন অ্যাশলে বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷
ছবি: AP
খারাপ আবহাওয়া
এছাড়া ভয়াবহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বহু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমান৷ সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার ১০ ভাগ দুর্ঘটনা তুষারপাত, কুয়াশা এবং ঝড়ের কবলে পড়ে হয়েছে৷
ছবি: dapd
প্রযুক্তিগত কারণ
বর্তমানের বিমানগুলো নতুন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ৷ দুর্ঘটনার ২০ ভাগ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মানব আচরণ
বিমানের চালকরা ঝুঁকির অন্যতম কারণ৷ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা হয় তাদের ভুলের কারণে৷ মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভুল থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া পাইলটের মানসিক অবস্থার উপরও দুর্ঘটনা নির্ভর করে৷
ছবি: picture alliance/ROPI
আকাশের হিরো
২০০৯ সালে হাডসন নদীতে ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে নেমে পড়েছিল বিমান৷ পাইলট ছিলেন চেসলে শুলেনব্যর্গার৷ কিন্তু তিনি পানিতে বিমানটি অবতরণ করাতে পারায় প্রাণে বেঁচেছিলেন যাত্রীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Day
দুর্ঘটনার শিকার বিমান
দুর্ঘটনার পর যেসব বিমান মেরামত করে আবার চালানো হয়, সেগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই উদ্বেগ থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলেন না যে দুর্ঘটনায় পড়া বিমান আদৌ নিরাপদ কিনা৷
ছবি: Reuters
এবং বিজয়ী
হামবুর্গভিত্তিক ঐ গবেষণা তালিকায় হংকংয়ের ক্যাথে প্যাসিফিক ২০১৬ সালের সবচেয়ে নিরাপদ এয়ারলাইন্স হয়েছে৷ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এয়ার নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় অবস্থানে চীনের হাইনান এয়ারলাইন্স৷ জার্মানির লুফৎহানসার অবস্থান তালিকায় দ্বাদশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে দুর্ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে
জেএসিডিইসি জানিয়েছে, গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় ৩২১ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ এ বছর যে বিমান দুর্ঘটনাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা হলো ৭২ জন যাত্রী নিয়ে বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া যাওয়ার সময় মেডেলিন বিমানবন্দরের কাছে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, যেখানে ব্রাজিলের শাপেকোইনসি রেয়াল ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও নিহত হন৷
ছবি: Reuters/F. Builes
11 ছবি1 | 11
ড. রাইনহোল্ড লেন্ডার বলেন, ‘‘ধাতুর উপর একটা চুলচেরা ফাটল বা ফাটা আবিষ্কার করায় মানুষের বদলে যন্ত্র ব্যবহার করার অনেক চেষ্টা হয়েছে৷ কিন্তু ওটা একটা ফাটল, নাকি একটা স্ক্র্যাচ বা আঁচড়, নাকি ওপরের কোনো অমসৃণ অংশ, একটা যন্ত্র কিংবা একটা কম্পিউটার প্রোগ্রামের পক্ষে তা নির্ধারণ করা অত্যন্ত শক্ত৷ মানুষ আরো অনেক দক্ষভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, ওটা একটা ফাটল কিনা৷’’
প্রায় সম্পূর্ণ অন্ধকারে ধাতুর ওপর সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতম ফাটলের খোঁজ চলে৷ সেজন্য প্রতিটি অংশের ওপর ফ্লুওরেসেন্ট – মানে আলো বিকীরণকারী তেল স্প্রে করা হয়৷ এই তেল এতই পাতলা যে, তা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতম ফাটলেও ঢুকে পড়ে৷ পরে তেলটা ধুয়ে ফেললেও, ফাটলের মধ্যে তার রেশ থেকে যায়, ফলে ফাটলটা দেখা যায়৷
বাংলাদেশে যেসব এয়ারলাইন্স সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছাড়েন৷ প্রায় একই সংখ্যক যাত্রী দেশে প্রবেশ করেন৷ বাংলাদেশ বিমান-এর দেয়া বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/K. Doherty
বাংলাদেশ বিমান
বাংলাদেশে মোট যাত্রীর ২০ থেকে ২১ ভাগ পরিবহন করে বাংলাদেশ বিমান৷ ফলে প্রতিদিন ৩ হাজারের মতো যাত্রী বাংলাদেশ বিমানের মাধ্যমে অন্য দেশে যায়৷ প্রতিদিন ৬ থেকে ৭টি ফ্লাইট পরিচালনা করে বাংলাদেশ বিমান৷ ১৬টি রুটে বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট চলাচল করে৷ এর মধ্যে লন্ডনসহ কয়েকটি রুটে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট যায়৷ অন্য রুটগুলোতে সপ্তাহে অন্তত দু’টি ফ্লাইট চলাচল করে৷
ছবি: picture alliance/Asian News Network
এমিরেটস এয়ারলাইন্স
বাংলাদেশ বিমানের পরই এমিরেটস এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে সবচেয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করে৷ সপ্তাহে ২১টি ফ্লাইট পরিচালনা করে তারা৷ প্রতিদিন এ সব ফ্লাইট ১২শ’ থেকে সাড়ে ১২শ’ যাত্রী পরিবহন করে৷
ছবি: C. Furlong/Getty Images
সৌদিয়া
এমিরেটস-এর পরেই রয়েছে সৌদিয়া এয়ারলাইন্স৷ তারা সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করে৷ প্রতিদিন আটশ’ থেকে সাড়ে আটশ’ যাত্রী পরিবহন করে এসব ফ্লাইট৷
ছবি: Reuters/S. Perez
কাতার এয়ারলাইন্স
চতুর্থ অবস্থানে আছে কাতার এয়ারলাইন্স৷ এরা সপ্তাহে ১৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করে৷ প্রতিদিন প্রায় আটশ’ যাত্রী পরিবহন করে এই এয়ারলাইন্স৷
ছবি: AP
ইতিহাদ এয়ারওয়েজ
ঢাকা থেকে ইতিহাদ প্রতিদিন একটা করে ফ্লাইট পরিচালনা করে৷ প্রতিদিন তারা প্রায় পাঁচশ’ যাত্রী পরিবহন করে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/K. Jebreili
জেট এয়ারওয়েজ
জেট এয়াররওয়েজ প্রতিদিন তিনটি ফ্লাইট পরিচালনা করে৷ তবে তাদের ফ্লাইটগুলো ছোট হওয়ায় যাত্রী পরিবহন হয় প্রতিদিন চার থেকে পাঁচশ’৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jet-Airways
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স
সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বড়৷ তবে তারাও প্রতিদিন ঢাকা থেকে প্রায় পাঁচশ’ যাত্রী পরিবহন করে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/C. Ena
7 ছবি1 | 7
ইঞ্জিনিয়ার ও মেকানিকদের ভালো হাতের কাজ জানা থাকা চাই৷ একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে তাদের শেখানো হয়েছে যে, কাজের চাপ আর ক্লান্তির ফলে তাদের কাজের মান কমে যেতে পারে৷
আবার শার্লক হোল্মস
তারপর শুরু হয় শার্লক হোল্মসের কাজ৷ অতিবেগুনি রশ্মির আলোয় কমবাশন চেম্বারের উপরিভাগটা পরীক্ষা করে দেখা হয়, কোথাও ফ্লুওরেসেন্ট তেলের কোনো চিহ্ন আছে কিনা৷ মিলিমিটার মিলিমিটার করে খুঁটিয়ে দেখেন, ভরসা শুধু নিজের চোখ আর বহু বছরের অভিজ্ঞতা৷ এখানে যারা কাজ করেন, তাদের ওপর অনেক দায়িত্ব৷
ড. রাইনহোল্ড লেন্ডার জানালেন, ‘‘কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে, বা কোনো বিমানের ইঞ্জিনে কিছু খারাপ হলে, আমরা সেটা বোধ করি বৈকি৷ সব সহকর্মীই ভাবেন, ব্যাপারটা আমার কোনো ভুলের জন্য ঘটেনি তো? সেক্ষেত্রে সবাই যার যার দায়িত্বের কথা খুব ভালোভাবেই জানেন বলে আমার ধারণা৷’’
কোনো একটা সন্দেহজনক অংশ খুঁজে পেলেই পরীক্ষক সেই অংশটিকে একটা ব্রাশ দিয়ে পরিষ্কার করে দেখেন৷ তার পরেও যদি রঙের হদিস থেকে যায়, তাহলে তিনি একটি ফাটল খুঁজে পেয়েছেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ সাথে সাথে লাল রঙ দিয়ে ফাটলটিকে চিহ্নিত করেন৷ এ কাজের জন্য সর্বোচ্চ মনঃসংযোগ দরকার৷ প্রতি ৫০ মিনিট অন্তর কর্মীদের বিরতি থাকে৷