যাত্রী বা পণ্যবাহী বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ সহজ কাজ নয়৷ দুর্ঘটনার আশঙ্কা এড়াতে সেগুলির নিয়মিত ও বিস্তারিত পরীক্ষার প্রয়োজন৷ জার্মানির ফ্রাংকফুর্ট ও হামবুর্গ শহরে এমন জটিল কাজের জন্য এলাহি ব্যবস্থা রয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
বিশাল মাপের বিমান এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যাত্রী ও পণ্য পরিবহণ করে৷ প্রযু্ক্তির ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে অবিরাম পরিবহণের এই প্রক্রিয়া নিরাপদ রাখা হয়৷
ফ্রাংকফুর্ট বিমানবন্দরে ‘লিমা চার্লি ইন্ডিয়া’ নামের পণ্যবাহী বিমান অবতরণ করেছে৷ প্রায় ৭,২০০ ঘণ্টা ওড়ার পর বোয়িং এমডি১১ মডেলের বিমানটির খোলনলচে পরীক্ষা করতে হবে৷ এমন খুঁটিনাটি পরীক্ষার মাধ্যমেই বিমান চলাচলের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়৷ লুফৎহানসা বিমান সংস্থার বিশাল হ্যাঙারের মধ্যে মিস্ত্রীরা প্রায় ৫,০০০ ঘণ্টা ধরে প্রত্যেকটি যন্ত্রাংশ খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন৷ সীমিত সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে হয়৷
বিমানের ডানার ফ্ল্যাপগুলির দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হয়৷ ঘণ্টায় ৩০০ কিলোমিটার বেগে এই বোয়িং পরিবহণ বিমানটি অবতরণ করে, যা বেশিরভাগ বিমানের তুলনায় অনেক বেশি৷ সে সময়ে বিমানের কোনো অংশের ক্ষতি হলে চলবে না৷ অবতরণের সময়ে পিছনের ইঞ্জিনও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ সবকিছু নিখুঁতভাবে চললে ইঞ্জিনিয়াররা সন্তুষ্ট হন৷
গোটাবিশ্বে যাত্রীবাহী বিমান বাড়ছে
বিশ্বব্যাপী যাত্রীবাহী বিমানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে৷ শুধু ২০১৬ সালে এই বৃদ্ধি আগের তুলনায় ৬ দশমিক তিন শতাংশ বেশি৷ তবে এই বৃদ্ধির সুফল সবাই পাচ্ছে না, অন্তত সমানভাবে তো নয়ই৷ আর বড় আয় হচ্ছে অন্য কোথাও৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Meissner
জনাকীর্ণ আকাশ
আরো যাত্রী মানে আরো বিমান৷ ২০৩৫ সাল নাগাদ এশিয়ায় যাত্রীবাহী বিমানের সংখ্যা দ্বিগুন বেড়ে ১৭,০০০ হবে৷ উত্তর আমেরিকায় এই সংখ্যা হবে ৯,৮০০ এবং ইউরোপে ৭,৯০০৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Becker
বৈমানিকদের চাহিদা বাড়ছে
আরো বিমান মানে আরো বৈমানিক দরকার৷ বোয়িংয়ের হিসেব অনুযায়ী, ২০৩৫ সাল নাগাদ অন্তত ৬১৭,০০০ নতুন বৈমানিক দরকার হবে, বিশেষ করে এশিয়ায়৷ মোটের উপর, ৬৭৯,০০০ নতুন রক্ষণাবেক্ষণকর্মী এবং ৮১৪,০০০ জন বাড়তি ফ্লাইট অ্যাসিস্ট্যান্টের দরকার হবে৷
ছবি: AFP/Getty Images/G. Bouys
সবচেয়ে বড় হাব
বিমানযাত্রীর সংখ্যা বিচারে ইউরোপের সবচেয়ে বড় হাবগুলো হচ্ছে লন্ডনের হিথ্রো, প্যারিসের শার্ল দ্য গল এবং জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর৷ ২০১৪ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর থেকে দুই মিলিয়ন টন কার্গো পরিবহণ করা হয়েছে৷ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিমানবন্দরের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টায়, সেখানে ২০১৫ সালে ১০০ মিলিয়ন বিমানযাত্রী ছিল৷
ছবি: picture alliance/dpa/F. Rumpenhorst
বাজেট এয়ারলাইন্সগুলো রক্ষা করছে
জার্মানির বিমান শিল্পে বৃদ্ধি অবশ্য জার্মান বিমানসংস্থাগুলোর কারণে খুব একটা হয়নি৷ বরং বিদেশি বিভিন্ন বিমানসংস্থার অবদান এতে বেশি৷ জার্মানির বিমানসংস্থাগুলোর দূরপাল্লার উড়ালের সংখ্যা গত ছয় বছর ধরে ধারবাহিকভাবে কমছে৷ অন্যদিকে, অতিরিক্ত সুবিধাহীন বাজেট এয়ারলাইন্সগুলোর, যেমন রাইনএয়ার এবং ইজিজেট, উড়ালের সংখ্যা ১৪ শতাংশ বেড়েছে৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ধর্মঘট কর্মসূচি
জার্মান পতাকাবাহী বিমানসংস্থা লুফৎহানসা গত বছর এক দশমিক আট বিলিয়ন ইউরো মুনাফা করতে সক্ষম হয়, যা আগের বছরের তুলনায় বেশি, যদিও বিমান সংস্থাটিকে একের পর এক ধর্মঘটের মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ পাইলটদের ইউনিয়নের ধর্মঘটের কারণে লুফৎহানসার ২০১৪ সাল থেকে প্রায় আধা বিলিয়ন ইউরোর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে৷ ইতোমধ্যে, অবশ্য ম্যানেজমেন্ট এবং পাইলটদের মধ্যে একটি সমঝোতা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
সবচেয়ে বেশি আয় যাদের
এভিয়েশন সামগ্রিকভাবে একটি লাভজনক ব্যবসা৷ তবে কিছু সংস্থা অন্যদের চেয়ে বেশ এগিয়ে৷ যদিও বিমান সংস্থাগুলো সাধারণত বিনিয়োগকৃত মূলধনের চার শতাংশ মুনাফা করতে পারে৷ জার্মানির বিমান বন্দর অপারেটর এবং বিমান উৎপাদনকারী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে লাভের পরিমান ৬ থেকে ৭ শতাংশ৷ এছাড়া এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল এবং বুকিং সেবাদাতাদের লাভের পরিমাণ বিশ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
আমাদের জন্য কী আছে?
ক্লান্ত যাত্রীদের জন্য বিছানা, মাসাজ, পায়ের কাছে বেশি জায়গা, চাইল্ডকেয়ার সেবা এবং বারসহ গোসলের ব্যবস্থা৷ হ্যাঁ, বিমানে এসব কিছুই অদূর ভবিষ্যতে পাবেন সাধারণ যাত্রীরা৷
ছবি: Jörg Hackemann/Fotolia
7 ছবি1 | 7
অলিভার গেবাউয়ার এই বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কাজ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমডি-১১ এক থ্রি-জেট বিমান৷ লুফৎহানসা কার্গো এটিকে পরিবহণের কাজে লাগায়৷ একে ‘আকাশের রানি’ বলা হয়৷ বিশাল আকারের এই বিমান অনেক মালপত্র নিয়ে দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিতে পারে৷’’
হামবুর্গ শহরে লুফৎহানসা কোম্পানির কারিগরি শাখার হ্যাঙারে এয়ারবাস ৩৪০ বিমানের আপাদমস্তক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে৷ ছ'বছর আগে প্রথম উড়ালের পর থেকে ‘গল্ফ ট্যাংগো’ নামের এই যাত্রীবাহী বিমান ২ কোটি কিলোমিটারের বেশি যাত্রা করেছে৷ বিমানটি এখনো ‘ফিট’ আছে কিনা, তা জানতে অনেক পরীক্ষা করতে হবে৷ বিশ্বের অন্য কোথাও এমন ব্যবস্থা নেই৷ এখানে ইঞ্জিনগুলিকে পূর্ণ শক্তিতে চালানো হয়৷ দেখা গেলো, এই বিমানের ইঞ্জিন ভালোভাবেই চলছে৷
তেলের ট্যাংকের মধ্যে একটা ফাটল শনাক্ত করা গেছে৷ সেটি দ্রুত মেরামত করতে হবে৷ বিমানের মিস্ত্রী ওলাফ সিব কাজে নেমে পড়েছেন৷ বেশ কসরত করে ট্যাংকের মধ্যে প্রবেশ করতে হয়৷ এমন কাজের পরিবেশ সহজ নয়৷ যে আধারে কয়েক টন এভিয়েশন ফুয়েল ভরা হয়, সেখানে মিস্ত্রীদের অতি সাবধানে কাজ করতে হয়৷ বাতাস তেলের বাস্পে ভরা, অতএব বিস্ফোরণের আশঙ্কা রয়েছে৷ বিমানের মিস্ত্রী ওলাফ সিব বলেন, ‘‘ট্যাংকের মধ্যে এমন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হয়, যা বিস্ফোরণ ঘটাবে না৷ যেমন উপরে বিশেষ ধরনের বাতি জ্বলছে৷ যে কোনো আলো নিয়ে ট্যাংকে নামা চলে না৷’’
ফাটলের মেরামতির কাজ শেষ৷ কোনো বিপদ ঘটেনি৷ এদিকে ফ্রাংকফুর্টের হ্যাঙারে আট দিন ধরে বিস্তারিত রক্ষণাবেক্ষণের পর পরিবহণ বিমানটি আবার উড়ালের জন্য প্রস্তুত৷ শেষ বার সব যন্ত্রাংশ পরীক্ষা করে সব স্টিকার দূর করা হচ্ছে৷
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ/অনিরাপদ এয়ারলাইন্সের তালিকা
২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৬০টি এয়ারলাইন্সের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে অনিরাপদ এয়ারলাইন্সগুলোর তালিকা করেছে জার্মানির জেএসিডিইসি ইনস্টিটিউট৷ তালিকাটি দেখে বোঝা যায় বিমানযাত্রায় বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে মানুষ৷
ছবি: Reuters/E. Su
অনিরাপদ চায়না এয়ারলাইন্স
২০১৬ সালে ৩৭০ কোটি যাত্রী তাদের বিমানে যাতায়াত করেছে৷ যাঁরা চায়না এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করেছেন তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে এটি একটি অনিরাপদ পরিবহন৷ তাই ৬০ টি এয়ারলাইন্সের তালিকায় তাইওয়ানিজ এয়ারলাইন সবচেয়ে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/X. Qintao
কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার বিকল্প নেই
গত ৩০ বছরের নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে ঐ তালিকা করা হয়েছে৷ বিমান কতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, কত যাত্রী নিহত হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে কিনা, এছাড়া কত কিলোমিটার যাত্রা করেছে এবং যাত্রী সংখ্যা কত- এসবের ভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে৷ এসবের ভিত্তিতে তাদের ০ থেকে ১.০০ পয়েন্ট দেয়া হয়েছে৷ কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার স্কোর দাঁড়িয়েছে ০.৯১৪৷ ২০১৬ সালের সবচেয়ে খারাপ বিমানের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান তাদের৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইন্দোনেশিয়ায় এয়ারলাইন্সে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি
গারুদা ইন্দোনেশিয়ার স্কোর ০.৭৭৭৷ খারাপ বিমানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়৷ ১৯৫০ সালে চলাচল শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই এয়াররলাইন্স ৪৭টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ৫৮৩ জন৷
ছবি: A.Berry/AFP/GettyImages
গবেষণা নিয়ে সমালোচনা
কিন্তু জেএসিডিইসি’র তালিকা কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েছে, কেননা, টেকনিক্যাল কোনো ত্রুটির কথা তারা উল্লেখ করেনি৷ এমনকি মানব আচরণের সমস্যার কথাও নেই সেখানে৷ আবহাওয়া বা সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ নেই, যেমন, সন্ত্রাসবাদ বিমানের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এর কারণে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিমন অ্যাশলে বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷
ছবি: AP
খারাপ আবহাওয়া
এছাড়া ভয়াবহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বহু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমান৷ সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার ১০ ভাগ দুর্ঘটনা তুষারপাত, কুয়াশা এবং ঝড়ের কবলে পড়ে হয়েছে৷
ছবি: dapd
প্রযুক্তিগত কারণ
বর্তমানের বিমানগুলো নতুন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ৷ দুর্ঘটনার ২০ ভাগ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মানব আচরণ
বিমানের চালকরা ঝুঁকির অন্যতম কারণ৷ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা হয় তাদের ভুলের কারণে৷ মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভুল থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া পাইলটের মানসিক অবস্থার উপরও দুর্ঘটনা নির্ভর করে৷
ছবি: picture alliance/ROPI
আকাশের হিরো
২০০৯ সালে হাডসন নদীতে ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে নেমে পড়েছিল বিমান৷ পাইলট ছিলেন চেসলে শুলেনব্যর্গার৷ কিন্তু তিনি পানিতে বিমানটি অবতরণ করাতে পারায় প্রাণে বেঁচেছিলেন যাত্রীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Day
দুর্ঘটনার শিকার বিমান
দুর্ঘটনার পর যেসব বিমান মেরামত করে আবার চালানো হয়, সেগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই উদ্বেগ থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলেন না যে দুর্ঘটনায় পড়া বিমান আদৌ নিরাপদ কিনা৷
ছবি: Reuters
এবং বিজয়ী
হামবুর্গভিত্তিক ঐ গবেষণা তালিকায় হংকংয়ের ক্যাথে প্যাসিফিক ২০১৬ সালের সবচেয়ে নিরাপদ এয়ারলাইন্স হয়েছে৷ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এয়ার নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় অবস্থানে চীনের হাইনান এয়ারলাইন্স৷ জার্মানির লুফৎহানসার অবস্থান তালিকায় দ্বাদশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে দুর্ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে
জেএসিডিইসি জানিয়েছে, গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় ৩২১ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ এ বছর যে বিমান দুর্ঘটনাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা হলো ৭২ জন যাত্রী নিয়ে বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া যাওয়ার সময় মেডেলিন বিমানবন্দরের কাছে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, যেখানে ব্রাজিলের শাপেকোইনসি রেয়াল ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও নিহত হন৷