হাভানায় বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে দুইদিনব্যাপী শোক দিবস পালন করছে কিউবা৷ দেশটির প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াথ-কানেল বিমানদুর্ঘটনার কারণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
কিউবার রাজধানী হাভানায় শুক্রবার বোয়িং ৭৩৭ সিরিজের একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে প্রাণ হারান ১০৭ জন, তবে জীবিত আছেন তিন আরোহী৷ দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট রাউল কাস্ট্রো জানিয়েছেন, বিমান দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণে শনিবার থেকে রবিবার মধ্যরাত অবধি দেশব্যাপীয় শোকপালন করা হবে৷
দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির এই নেতা হাভানার হোসে মার্টি বিমানবন্দের কাছে একটি মাঠ পরিদর্শন করে যেখানে উড্ডয়নের পরপরই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল৷ এটিকে ‘সর্বনাশা দুর্ঘটনা' আখ্যা দিয়ে নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন কাস্ট্রো৷
কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনা ও তার কারণ
আজকের এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তির যুগেও কীভাবে একটি বিমান হারিয়ে যেতে পারে সেটা অনেকেই ভেবে পাচ্ছেন না৷ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ক্ষেত্রে হয়েছে সেটি৷ ছবিঘরে থাকছে কয়েকটি বিমান দুর্ঘটনার কথা ও তার কারণ৷
ছবি: AP
মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স
৮ই মার্চ, ২০১৪৷ মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ২৩৯ জন যাত্রী নিয়ে কুয়ালালামপুর থেকে বেইজিং যাওয়ার পথে হারিয়ে যায়৷ এখনো সেই বিমানের হদিশ মেলেনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এয়ার ফ্রান্স
বিমান হারানোর ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালের ১ জুনেও৷ সে সময় ব্রাজিল থেকে ফ্রান্স যাওয়ার পথে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে হঠাৎ করে হারিয়ে যায় এয়ার ফ্রান্সের একটি বিমান৷ প্রায় দু বছর পর সাগরের নীচে ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় এর খোঁজ পাওয়া যায়৷ এতে ২২৮ যাত্রীর সবাই নিহত হন৷ বিমান চালানোর অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কাজ না করায় বিমানটি দ্রুতগতিতে নীচে নেমে অ্যাটলান্টিকের পানিতে তলিয়ে যায় বলে পরবর্তীতে তদন্ত রিপোর্টে জানা গেছে৷
ছবি: dapd
ভোজা এয়ার
২০১২ সালের ২০শে এপ্রিল পাকিস্তানের বেসরকারি ‘ভোজা এয়ার’-এর একটি বিমান ল্যান্ডিং-এর সময় নামতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়লে ১২৭ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন৷ বৃষ্টিপাত ও ঝোড়ো হাওয়ার মধ্যে ইসলামাবাদ বিমানবন্দরে নামার চেষ্টাই দুর্ঘটনার কারণ বলে প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে৷ বোয়িং ৭৩৭-২০০ বিমানটি করাচি থেকে ইসলামাবাদ যাচ্ছিল৷
ছবি: Reuters
ইরান এয়ার
২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি ইরান এয়ারের একটি বোয়িং ৭২৭-২০০ বিমান তেহরান থেকে অরুমিয়ে যাওয়ার পথে নামতে গিয়ে খারাপ আবহাওয়ার কারণে দুর্ঘটনায় পড়লে ১০৫ জন যাত্রীর মধ্যে ৭৭ জন নিহত হন৷ বেঁচে যায় ২৮ জন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস
দুবাই থেকে ভারতের ম্যাঙ্গালোর বিমানবন্দরের রানওয়েতে নামার পর এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসের একটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ বিমান রানওয়ে থেকে ছিটকে দূরের পাহাড়ে গিয়ে আঘাত করলে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়৷ এতে ১৫৮ জন নিহত হন৷ আর বেঁচে যান আটজন৷ পাইলটের গাফিলতি দুর্ঘটনার কারণ বলে তদন্তে জানা যায়৷ ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালের ২২শে মে তারিখে৷
ছবি: AP
আফ্রিকিয়া এয়ারওয়েজ
পাইলটের ভুলের কারণে ২০১০ সালের ১২ মে আফ্রিকিয়া এয়ারওয়েজের একটি বিমান লিবিয়ার ত্রিপোলিতে ল্যান্ডিং-এর আগে দুর্ঘটনায় পড়লে ১০৩ জন যাত্রী নিহত হন৷ তবে অবিশ্বাস্যভাবে বেঁচে যায় হল্যান্ডের নয় বছরের এক ছেলে!
ছবি: AP
প্রেসিডেন্টের মৃত্যু
২০১০ সালের ১০ই এপ্রিল পোল্যান্ডের বিমানবাহিনীর একটি বিমান দুর্ঘটনায় পড়লে দেশটির সে সময়কার প্রেসিডেন্ট সহ ৯৬ জন যাত্রীর সবাই নিহত হন৷ পোল্যান্ডের সরকারি তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনার জন্য পাইলটকে দায়ী করা হয়৷ বলা হয়, খারাপ আবহাওয়ায় ল্যান্ডিং এর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ছিল না পাইলটের৷
ছবি: AP
ইয়েমেনিয়া
ল্যান্ডিং এর আগে ইয়েমেনের এয়ারলাইন্স ‘ইয়েমেনিয়া’-র একটি বিমান সাগরে ভেঙে পড়লে ১৫৩ জন যাত্রীর ১৫২ জনই মারা যান৷ শুধু বেঁচে যায় ১২ বছরের একটি মেয়ে৷ দুর্ঘটনার কারণ পাইলটের ‘ঝুঁকিপূর্ণ ম্যানুভার’৷
ছবি: AP
8 ছবি1 | 8
তদন্ত শুরু হয়েছে
কিউবার রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থা ‘কিউবানা'-র পক্ষে পরিচালিত ‘দ্য গ্লোবাল এয়ার' বিমানসংস্থার উড়ালটি হাভানা থেকে দেশটির পূর্বাঞ্চলের শহর হলগেনে যাচ্ছিল৷ উড়ালটিতে থাকা অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন কিউবার নাগরিক৷ বিদেশি পাঁচ যাত্রীর মধ্যে দুই আর্জেন্টিনার নাগরিক ছিলেন৷ বিমানটির ছয় ক্র ছিলেন মেক্সিকোর নাগরিক৷
বিমানটি দুর্ঘটনায় পড়ার কারণ এখনো পরিষ্কার হয়নি৷ প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াথ-কানেল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, ৪০ বছর বয়সি বোয়িং ৭৩৭ বিমানটি কেন বিধ্বস্ত হয়েছে তা জানতে তদন্ত শুরু হয়েছে৷
এদিকে, মেক্সিকো জানিয়েছে, বিমান দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে নিযুক্ত তদন্তকারী দলকে সহায়তায় বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে দেশটি৷
শোকবার্তা
রাশিয়ার প্রেসিডেন্টি ভ্লাদিমির পুটিনসহ ল্যাটিন আমেরিকার অনেক নেতা বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন৷ ভেনেজ্যুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো এক শোকবার্তায় লিখেছেন, ‘‘হাভানায় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের প্রতি আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি৷ তারা এই কঠিন বেদনা কাটিয়ে ওঠার শক্তি অর্জন করুক৷ তাদের প্রতি আমাদের সব ধরনের সহায়তা থাকবে৷''
বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ/অনিরাপদ এয়ারলাইন্সের তালিকা
২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৬০টি এয়ারলাইন্সের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ এবং সবচেয়ে অনিরাপদ এয়ারলাইন্সগুলোর তালিকা করেছে জার্মানির জেএসিডিইসি ইনস্টিটিউট৷ তালিকাটি দেখে বোঝা যায় বিমানযাত্রায় বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে মানুষ৷
ছবি: Reuters/E. Su
অনিরাপদ চায়না এয়ারলাইন্স
২০১৬ সালে ৩৭০ কোটি যাত্রী তাদের বিমানে যাতায়াত করেছে৷ যাঁরা চায়না এয়ারলাইন্সে যাতায়াত করেছেন তাঁদের অনেকেরই মনে হয়েছে এটি একটি অনিরাপদ পরিবহন৷ তাই ৬০ টি এয়ারলাইন্সের তালিকায় তাইওয়ানিজ এয়ারলাইন সবচেয়ে অনিরাপদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/X. Qintao
কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার বিকল্প নেই
গত ৩০ বছরের নিরাপত্তার উপর ভিত্তি করে ঐ তালিকা করা হয়েছে৷ বিমান কতবার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, কত যাত্রী নিহত হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে কিনা, এছাড়া কত কিলোমিটার যাত্রা করেছে এবং যাত্রী সংখ্যা কত- এসবের ভিত্তিতে তালিকা করা হয়েছে৷ এসবের ভিত্তিতে তাদের ০ থেকে ১.০০ পয়েন্ট দেয়া হয়েছে৷ কলম্বিয়ার অ্যাভিয়াঙ্কার স্কোর দাঁড়িয়েছে ০.৯১৪৷ ২০১৬ সালের সবচেয়ে খারাপ বিমানের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থান তাদের৷
ছবি: AFP/Getty Images
ইন্দোনেশিয়ায় এয়ারলাইন্সে বিধ্বস্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি
গারুদা ইন্দোনেশিয়ার স্কোর ০.৭৭৭৷ খারাপ বিমানের তালিকায় এর অবস্থান তৃতীয়৷ ১৯৫০ সালে চলাচল শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এই এয়াররলাইন্স ৪৭টি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে, দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে মোট ৫৮৩ জন৷
ছবি: A.Berry/AFP/GettyImages
গবেষণা নিয়ে সমালোচনা
কিন্তু জেএসিডিইসি’র তালিকা কিছুটা সমালোচনার মুখে পড়েছে, কেননা, টেকনিক্যাল কোনো ত্রুটির কথা তারা উল্লেখ করেনি৷ এমনকি মানব আচরণের সমস্যার কথাও নেই সেখানে৷ আবহাওয়া বা সন্ত্রাসী হামলার উল্লেখ নেই, যেমন, সন্ত্রাসবাদ বিমানের নিরাপত্তার জন্য বর্তমানে সবচেয়ে বড় হুমকি৷ এর কারণে ১০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে৷ বিমান নিরাপত্তা বিশ্লেষক সিমন অ্যাশলে বলেছেন, সন্ত্রাসের ভয় দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ৷
ছবি: AP
খারাপ আবহাওয়া
এছাড়া ভয়াবহ খারাপ আবহাওয়ার কারণে বহু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমান৷ সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দুর্ঘটনার ১০ ভাগ দুর্ঘটনা তুষারপাত, কুয়াশা এবং ঝড়ের কবলে পড়ে হয়েছে৷
ছবি: dapd
প্রযুক্তিগত কারণ
বর্তমানের বিমানগুলো নতুন প্রযুক্তি সমৃদ্ধ৷ দুর্ঘটনার ২০ ভাগ যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Eisele
মানব আচরণ
বিমানের চালকরা ঝুঁকির অন্যতম কারণ৷ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা হয় তাদের ভুলের কারণে৷ মানুষ ও যন্ত্রের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভুল থেকেও দুর্ঘটনা ঘটে৷ এছাড়া পাইলটের মানসিক অবস্থার উপরও দুর্ঘটনা নির্ভর করে৷
ছবি: picture alliance/ROPI
আকাশের হিরো
২০০৯ সালে হাডসন নদীতে ১৫৫ জন যাত্রী নিয়ে নেমে পড়েছিল বিমান৷ পাইলট ছিলেন চেসলে শুলেনব্যর্গার৷ কিন্তু তিনি পানিতে বিমানটি অবতরণ করাতে পারায় প্রাণে বেঁচেছিলেন যাত্রীরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/S. Day
দুর্ঘটনার শিকার বিমান
দুর্ঘটনার পর যেসব বিমান মেরামত করে আবার চালানো হয়, সেগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময়ই উদ্বেগ থাকে৷ বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে কখনোই প্রশ্ন তোলেন না যে দুর্ঘটনায় পড়া বিমান আদৌ নিরাপদ কিনা৷
ছবি: Reuters
এবং বিজয়ী
হামবুর্গভিত্তিক ঐ গবেষণা তালিকায় হংকংয়ের ক্যাথে প্যাসিফিক ২০১৬ সালের সবচেয়ে নিরাপদ এয়ারলাইন্স হয়েছে৷ দ্বিতীয় অবস্থানে আছে এয়ার নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় অবস্থানে চীনের হাইনান এয়ারলাইন্স৷ জার্মানির লুফৎহানসার অবস্থান তালিকায় দ্বাদশ৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যে দুর্ঘটনা সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে
জেএসিডিইসি জানিয়েছে, গত বছর বিমান দুর্ঘটনায় ৩২১ জন প্রাণ হারিয়েছে৷ এ বছর যে বিমান দুর্ঘটনাটি সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে, সেটা হলো ৭২ জন যাত্রী নিয়ে বলিভিয়া থেকে কলম্বিয়া যাওয়ার সময় মেডেলিন বিমানবন্দরের কাছে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা, যেখানে ব্রাজিলের শাপেকোইনসি রেয়াল ফুটবল দলের খেলোয়াড়রাও নিহত হন৷
ছবি: Reuters/F. Builes
11 ছবি1 | 11
স্পেনের রাজা চতুর্থ ফেলিপে ফোর এবং রানি লেটিথিয়া একই ধরনের শোকবার্তা প্রদান করেছেন৷
দুর্বল রেকর্ড
কারিগরি সমস্যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে কিউবানা বিমানসংস্থাটি নিজেদের বেশ কয়েকটি বিমান ব্যবহার থেকে বিরত থাকে৷ দেশটির ‘এয়ার সেফটি রেকর্ড' দুর্বল৷ দেশটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷ সেসময় কিউবানার হাভানা থেকে ইটালির মিলানগামী বিমানটি ১২৬ জন যাত্রী নিয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল৷
কিউবার মানুষদের কাছে কিউবানার বেশ দুর্নাম রয়েছে৷ বিমানসংস্থাটি উড়াল বিলম্ব এবং বাতিলের জন্য আলোচিত৷ তবে কিউবান কর্তৃপক্ষের দাবি, কিউবার উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বিমানের যন্ত্রাংশ এবং বিমানের স্বল্পতা সৃষ্টি হওয়ায় উড়াল বিলম্ব এবং বাতিলের অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে৷ এমনকি শুক্রবারের দুর্ঘটনার একদিন আগে বৃহস্পতিবার কিউবানার সেবার মান বাড়াতে এক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়৷