বিলুপ্ত কমিটির নেতাদের নিয়ে হেফাজতের নতুন কমিটি আসছে
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ আগস্ট ২০২৩
হেফাজতে ইসলামের কমিটি পুনর্গঠন হচ্ছে। ওই কমিটিতে ২০২০ সালের বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে স্থান দেয়া হবে৷ সামনের মাসেই সংবাদ সম্মেলন করে পুনর্গঠিত কমিটি ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন হেফাজত নেতারা৷
বিজ্ঞাপন
হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘গত ৫ আগস্ট শীর্ষ নেতাদের এক বৈঠকে বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে বর্তমান কমিটিতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ তবে তাদের পদবিন্যাস বা নির্ধারণের জন্য ১৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়৷’’
ওই কমিটির সদস্যরা ১৬ আগস্ট একটি বৈঠক করেছেন৷ পদবিন্যাস কমিটির সদস্য এবং হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি জানিয়েছেন, ‘‘কাকে কোন পদ দিয়ে কমিটি পুনর্বিন্যাস করা হবে তার একটা খসড়া প্রস্তাব আমরা মহাসচিবের কাছে দিয়েছি৷ এখন হোফাজতের আমির চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেই তা সংবাদ সম্মেলনের মাধমে প্রকাশ করা হবে৷’’
বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজি বলেন,‘‘মাওলানা মামুনুল হকসহ চার-পাঁচ জন এখন কারাগারে আছেন৷ যারা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন তাদের মধ্যে জোনায়েদ আল হাবিবসহ কয়েকজনকে এরইমধ্যে বিভিন্ন পদে দেয়া হয়েছে৷ আশা করা যায় সব পদবিন্যাস চূড়ান্ত করে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই জানানো হবে৷’’
কিছু নেতা সরকারঘেঁষা বলে অভিযোগ আছে: জাকারিয়া নোমান
হেফাজতের বর্তমান কমিটিতে আছেন ৬৫ জন৷ বিলুপ্ত কমিটিতে ছিলেন ২০১ জন৷ এবার সবাইকে নিয়েই কমিটি হচ্ছে৷ বর্তমান কমিটি বা বিলুপ্ত কমিটির কাউকে বাদ দেয়া হবে না৷ যারা কারাগার থেকে ছাড়া পেয়েছেন, এখনও কারাগারে আছেন সবাই কমিটিতে থাকছেন৷
২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর মাওলানা শাহ আহমদ শফী মারা যাওয়ার পর থেকেই হেফাজতের মধ্যে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব শুরু হয়৷ তার মৃত্যুর পর মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতের আমীর হন এবং মাওলানা আহমদ শফী পন্থীরা কোনঠাসা হয়ে পড়েন৷ জুনায়েদ বাবুনগরী সরকারবিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন৷ তার কমিটি ছিলো ২০১ সদস্যের৷ ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঢাকার সফরের বিরুদ্ধে হেফাজতের কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকাসহ সারাদেশে ব্যাপব সহিংসতা হয়৷ ওই বছরের ২৫ এপ্রিল হেফাজদের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন বাবুনগরী৷ তিনি আহ্বায়ক থেকে ৩৫ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করেন৷ ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট জুনায়েদ বাবুনগরী মারা যান৷
এরপর শাহ মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী হেফাজতের আমির হন৷ কমিটি হয় ৬৫ সদস্যের৷ বিলুপ্ত কমিটির কেউ এই কমিটিতে জায়গা পাননি তখন৷
হেফাজতের একাধিক নেতা জানিয়েছেন সরকারঘেঁষা অবস্থানের কারণে হেফাজতের বর্তমান কমিটির নেতারা অনেক দিন ধরেই চাপে ছিলেন৷ তারপরও গ্রেপ্তার হওয়া সব নেতা মুক্তি না পাওয়ায় হেফাজতের তৃণমূলের ক্ষোভ বাড়ছিলো৷ এমনকি হেফাজত ভেঙে গিয়ে আলাদা কমিটি গঠনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল৷ তাই সবকিছু সামাল দিতে বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে কমিটিতে ফিরিয়ে নিয়ে কমিটি পুনর্বিন্যসের সিদ্ধান্ত হয়৷
হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির প্রচার সম্পাদক জাকারিয়া নোমান ফয়েজি বলেন, ‘‘হেফাজতের তৃণমূল থেকে অনেক দিন ধরেই চাপ ছিল৷ বর্তমান কমিটি তেমন কোনো কাজ করতে পারছিল না৷ আর কিছু নেতা সরকারঘেঁষা বলে অভিযোগ আচে৷ তারা গ্রেপ্তারকৃত নেতাদের দ্রুত মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেননি৷ ফলে কমিটিতে বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ হেফাজত কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়৷ তাই আমরা সরকারঘেঁষা বা সরকারবিরোধী কোনোটাই হতে পারি না৷’’
বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে বর্তমান কমিটিতে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে: কেফায়েতুল্লাহ আজহারি
আর বর্তমান প্রচার সম্পাদক মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারি বলেন,"আগের কমিটির বিলুপ্ত করা হয়েছিলো৷ কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি৷ ফলে তাদের কমিটিতে ফিরয়ে নেয়ায় কোনো বাধা ছিল না৷ তাই এখন সবাইকে কমিটিতে নিয়ে হেফাজতকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে৷ বিলুপ্ত কমিটির সবাইকেই নতুন কমিটিতে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে৷ এখন শুধু পদ বিন্যাস করা হচ্ছে৷’’
তার কথা,"একটা পরিস্থিতির কারণে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। অনেক নেতারা জেলে ছিলেন। একটা পরিস্থিতির কারণে আমাদের অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এখন আমরা হেফাজতকে হেফাজতের মতো এগিয়ে নিতে চাই।”
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘একটি বিশেষ পরিস্থিতির কারণে হেফাজতের ভিতরে অনেক প্রশ্ন উঠেছে৷ বিভিন্ন ঘটনা বিভিন্নভাবে মূল্যায়ন হয়েছে৷ এগুলো ব্যক্তি কেন্দ্রিক মূল্যায়ন ও সমালোচনা৷ এর কোনো ভিত্তি নেই৷’’
হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিক মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানি বলেন, ‘‘বিলুপ্ত কমিটির সবাইকে কেন ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে তা আসলে সংগঠনের মহাসচিব বলতে পারবেন৷ আমাদের দায়িত্ব দেয়া দেয়া হয়েছিলো পদবিন্যাসের৷ আমরা তা করেছি৷ এখন বাকিটা আমিরের ওপর নির্ভর করে৷’’
দুনিয়ার কয়েকটি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল
বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে৷ এদের মধ্যে বিজেপি, জামায়াতে ইসলামিসহ কয়েকটি দলের বিরুদ্ধে সহিংসতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত৷
ছবি: DW/O. S. Janoti
জার্মানি
ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন বা খ্রিস্টিয় গণতন্ত্রী দল সিডিইউ জার্মানির সবচয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক দল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বেশিরভাগ সময় এই দলটি জার্মানির ক্ষমতায় রয়েছে৷ ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক মতাদর্শের দলটি বর্তমান বিশ্বে নিজেদের উদারনীতির জন্য পরিচিত৷ দলটি মধ্য-ডানপন্থি হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/M. Rietschel
অস্ট্রিয়া
এই দেশে ডানপন্থি আন্দোলনের নেতা ভিয়েনার মেয়র কার্ল লুগারের নেতৃত্বে ১৮৯৩ সালে গঠিত হয় ক্রিস্টিয়ান সোশ্যাল পার্টি(সিএসপি), বর্তমান নাম অস্ট্রিয়ান পিপলস পার্টি (ওভিপি)৷ খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক রক্ষণশীল এই দলটি বর্তমানে ক্ষমতায়, যাদের নীতি অভিবাসনবিরোধী৷
ছবি: Herbert Neubauer/APA/picture alliance
নেদারল্যান্ডস
দেশটির ধর্মভিত্তিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক আপিল (সিডিএ)৷ ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সিডিএ’র এর মূল আদর্শ: খ্রিস্টান গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ক্যানাডা
কুইবেক রাজ্যে ২০০০ সালে রোমান ক্যাথলিকদের সহযোগিতায় গঠিত হয় ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি৷ পার্টির মূলনীতিতে বলা হয়েছে,‘‘অর্থোডক্স খ্রিষ্টীয় মতবাদ ও কুইবেক জাতীয়তাবাদের সমন্বয়ই হবে দলের প্রধান লক্ষ্য৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/C. Roussakis
অন্যান্য দেশে ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি
ডেনমার্ক, এস্তোনিয়া, আলবেনিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি, সুইজারল্যান্ড, লেবানন, নরওয়ে, সিরিয়া, সুইডেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, রোমানিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি, বলিভিয়া, হাইতি এসব দেশেও খ্রিস্টান ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি রয়েছে৷
ছবি: Alessandra Tarantino/AFP
তুরস্কের জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি
‘একে’ পার্টি নামে পরিচিত রক্ষণশীল এই দলের নেতা রিচেপ তাইয়েপ এর্দোয়ান৷ ২০০৩ সাল থেকে এর্দোয়ানের দল দেশ পরিচালনা করছে৷ ২০০১ সালে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়৷ তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং ইসলামি পরিচয় দিয়ে মুসলমান ভোটারদের সমর্থন পেলেও দলটি নিজেদের ইসলামভিত্তিক দল বলতে নারাজ৷ এর্দোয়ানের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দমনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Murat Cetinmuhurdar/AP/picture alliance
ভারত, বিজেপি
১৯৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত ভারতের হিন্দু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনসংঘ পরে জনতা পার্টি নামে দল গঠন করে৷ ১৯৭৭ সালে জনতা পার্টিতে মিশে যায় জনসংঘ৷ ১৯৮০ সালে সাবেক জনসংঘ সদস্যরা বেরিয়ে এসে ভারতীয় জনতা পার্টি গঠন করে৷ ১৯৯৬ সালে কট্টরপন্থি দলটি বৃহত্তম দলে পরিণত হয়৷ বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা, গুজরাট দাঙ্গায় উস্কানিসহ সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে দলটির বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Kumar
ভারত, শিব সেনা
১৯৬৬ সালে কার্টুনিস্ট বাল ঠাকরে এই হিন্দুত্ববাদী এই রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন৷ তাদের আধিপত্য মূলত মুম্বই কেন্দ্রিক হলেও বর্তমানে ক্ষমতাসীন দল বিজেপি’র সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে দলটির৷ শিব সেনা দলের প্রধান উদ্ধব ঠাকরে বর্তমানে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/R. Maqbool
নেপাল
আশি শতাংশেরও বেশি হিন্দু অধ্যূষিত দেশ নেপাল৷ সনাতন ধর্ম সমিতি, নেপালি জনতা পার্টি (বিজেপির নেপালি সংস্করণ) প্রধানতম ধর্মীয় দল,যা হিন্দুদের আম্ব্রেলা সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্য৷
ছবি: PRAKASH MATHEMA/AFP/Getty Images
পাকিস্তান
জামাত ই ইসলামী পাকিস্তানের বৃহত্তম ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল৷ পাকিস্তানকে একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে, শরিয়া আইন দিয়ে দেশ পরিচালনার লক্ষ্যে ১৯৪১ সালে দলটির প্রতিষ্ঠা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাংলাদেশ
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী (আগের নাম জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ)৷ ১৯৭৭ সালে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধর্মভিত্তিক দলটির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷ ২০০১ সালে বিএনপি’র সাথে জোট গঠন করে পার্লামেন্টে স্থান করে নেয় জামায়াত৷ মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত এই দলের শীর্ষ অনেক নেতা৷ এছাড়া বিভিন্ন সময় নাশকতার অভিযোগ আছে দলটির বিরুদ্ধে৷