ভারত, বাংলাদেশের মতো দেশে এ ধরনের অপরাধচক্র নতুন নয়৷ কিন্তু জার্মানির মতো প্রথম বিশ্বেও? নির্মাণ সংস্থাগুলিকে ঘিরে এক বিশাল অপরাধচক্রের সন্ধান পেয়েছে জার্মান পুলিশ৷
বিজ্ঞাপন
বড়সড় দুর্নীতিচক্রের হদিশ মিলল জার্মানিতে৷ দেশের নর্থ রাইন ওয়েস্টফেলিয়া অঞ্চলে মঙ্গলবার ভোরে পুলিশ এবং কাস্টমসের দুর্নীতিদমন শাখার অফিসাররা অভিযান চালায়৷ অভিযোগ, অভিযান চালিয়ে একটি বিশাল আকারের অপরাধচক্রের সন্ধান মিলেছে৷ যারা জার্মানির বিভিন্ন নির্মাণ সংস্থায় বেআইনি ভাবে শ্রমিক নিয়ে আসে৷ এই শ্রমিকদের জার্মান আইন অনুসারে বেতন দেওয়া হয় না৷ বীমা এবং সামাজিক নিরাপত্তার নিয়মগুলিও পালিত হয় না৷ বহুদিন ধরেই পুলিশের কাছে এ বিষয়ে তথ্য ছিল৷ মঙ্গলবার সকালে এই অভিযান চালিয়ে মোট আটজনকে গ্রেফতার করা হয় বলে খবর৷
পুলিশ সূত্রে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার ভোরে অভিযানটি বা রেইড শুরু হয়৷ নর্থ রাইন ওয়েস্টফেলিয়া অঞ্চলের ৩১ টি শহরে মোট ১৪০টি নির্মাণ সংস্থায় রেইড চালানো হয়৷ যেখান থেকে উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ ভুয়ো কাগজপত্র, বেআইনি অস্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণ অর্থ৷ জানা গিয়েছে, নির্মাণ সংস্থাগুলি ভুয়ো বিল তৈরি করে অপরাধচক্রের হাতে দিত৷ সেই বিল ব্যবহার করে অপরাধচক্র বেআইনি ভাবে শ্রমিক আনার কাজটি করত৷ যে আটজনকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয়, তাদের মধ্যে দু'জন জার্মান, একজন বসনিয়ার, দু'জন সার্বিয়ার, একজন ইসরায়েলের৷ বাকি একজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি৷ এদের সকলের বয়স ৩১ থেকে ৭২ বছরের মধ্যে৷
জিএসজি ৯: জার্মানির সন্ত্রাসরোধী বিশেষ বাহিনী
সন্ত্রাসের ঝুঁকি বাড়ার কারণে ১৯৭২ সালে মিউনিখে এক ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হত্যাকাণ্ডের পর জিএসজি-৯ গঠন করা হয়৷
ছবি: picture alliance/dpa/Hannibal
‘সীমান্ত সুরক্ষা গোষ্ঠী ৯’
১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক চলাকালীন ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীদের হাত থেকে ইসরায়েলি পণবন্দিদের মুক্ত করতে ব্যর্থ হয় জার্মান পুলিশ৷ তখন এই বিশেষ কমান্ডো পুলিশ বাহিনী সৃষ্টির পরিকল্পনা নেওয়া হয় – যদিও তা অনেককে নাৎসি আমলের বাছাই এসএস বাহিনীর কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ও সেই কারণে বেশ কিছু বিতর্কের অবতারণা ঘটে৷
ছবি: picture alliance/dpa/Hannibal
সুনাম
জিএসজি ৯ স্কোয়াডের প্রথম অভিযানই তাদের সুনাম প্রতিষ্ঠা করে৷ ১৯৭৭ সালে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসীরা লুফৎহানসার একটি যাত্রীবাহী বিমান অপহরণ করে মোগাদিশুতে নিয়ে যায়৷ ‘ফায়ার ম্যাজিক’ নামের একটি অভিযানে জিএসজি-৯ গোষ্ঠীর কমান্ডোরা মাত্র সাত মিনিটের মধ্যে বিমানের যাত্রীদের মুক্ত করেন৷ অভিযানে আহত হন জিএসজি-৯-এর এক সদস্য ও একজন বিমানকর্মী৷ চারজন বিমান অপহরণকারীর মধ্যে তিনজন ঐ অভিযানে প্রাণ হারায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
‘মোগাদিশুর হিরো’
জিএসজি ৯ স্কোয়াডের প্রথম সদস্যদের একজন উলরিশ ভেগেনার৷ মোগাদিশুর অভিযানের পর তিনি জার্মান সরকারের অর্ডার অফ মেরিট সম্মানে ভূষিত হন৷ ‘মোগাদিশুর হিরো’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি৷ ভেগেনার ২০১৭ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ৮৮ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন৷
ছবি: imago/Sven Simon
জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে
অপহরণ, সন্ত্রাসী আক্রমণ বা বোমা সরানোর কাজে জিএসজি-৯ স্কোয়াডকে নিয়োগ করা হয়৷ তবে বিশেষ বিশেষ উপলক্ষ্যে কোনো স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজেও তারা মাঠে নামে৷ প্রয়োজনে জলেও নামে! ২০০৭ সালে জি-এইট গোষ্ঠীর শীর্ষবৈঠক অনুষ্টিত হয় উত্তর জার্মানির হাইলিগেনডাম সৈকতাবাসে৷ সেখানে উপকূল পাহারা দেয় জিএসজি-৯৷
ছবি: Getty Images/A. Hassenstein
মুখ দেখার উপায় নেই
জিএসজি-৯ স্কোয়াডের অধিকাংশ অভিযানই গোপনীয়৷ তবে প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই বিশেষ বাহিনী ১,৯০০-টিরও বেশি অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে৷ গোষ্ঠীর প্রধান কার্যালয় জার্মানির সাবেক রাজধানী বন শহরের কাছে সাংক্ত্ আউগুস্তিনে৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
প্রশিক্ষণ
জিএসজি ৯ স্কোয়াডের প্রশিক্ষণের খুব বেশি ছবি না থাকলেও, মাঝেমধ্যে স্কোয়াডের সদস্যরা কোনো বিশেষ উপলক্ষ্যে তাঁদের কর্মক্ষমতা প্রদর্শন করে থাকেন৷ যেমন, দড়িতে করে বহুতল বাড়ির গা বেয়ে মাটিতে নেমে আসা৷ উইসবাডেনে জার্মান অপরাধ দপ্তরের ‘মুক্ত দুয়ার দিবসে’ তার একটি নমুনা দেখাচ্ছেন জিএসজি-৯ সদস্যরা (ফাইল ছবি)৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হেলিকপ্টার থেকেও...
বন শহরে সাবেক চ্যান্সেলরের দপ্তরের সামনে উড়ন্ত হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে মাটিতে নেমে দেখাচ্ছেন জিএসজি-৯ সদস্যরা (ফাইল ছবি)৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মহড়া
জিএসজি-৯ সদস্যদের প্রশিক্ষণের কোনো অন্ত নেই৷ ছবিতে তাঁদের একটি রেলওয়ে স্টেশনে সন্ত্রাসী আক্রমণের পর আহতদের উদ্ধার করার মহড়ায় অংশ নিতে দেখা যাচ্ছে৷ অবশেষে জিএসজি-৯ গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ বাড়িয়ে বার্লিনে স্কোয়াডে আরো একটি মুখ্য কার্যালয় খোলার পরিকল্পনা চলেছে৷ গোষ্ঠীর সদস্যসংখ্যা গোপন রাখা হলেও তা আপাতত প্রায় ৪০০ বলে মিডিয়ার অনুমান৷
ছবি: picture alliance/dpa/J. Carstensen
8 ছবি1 | 8
সূত্রের খবর, শুধু বেআইনি শ্রমিক নিয়ে আসাই নয়, অপরাধচক্রটি নির্মাণ সংস্থাগুলির ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার কাজেও সাহায্য করতো৷ পুলিশ এবং কাস্টমস অফিসারদের দাবি, এ ধরনের এত বড় অপরাধচক্রের সন্ধান এর আগে জার্মানিতে পাওয়া যায়নি৷ মঙ্গলবারের অভিযান নিয়ে তারা আশাবাদী৷ তাদের বিশ্বাস, কান টানলে মাথা আসে৷ গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই সংক্রান্ত আরো তথ্য মিলবে৷ সন্ধান পাওয়া যাবে রাঘব বোয়ালদের৷ তবে এতদিন কী করে এই অপরাধচক্র কাজ চালালো তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই৷
পুলিশ জানিয়েছে, এই অপরাধচক্রের হাত বহু দূর বিস্মৃত বলেই তাদের ধারণা৷ ভিনদেশের অপরাধচক্র এর সঙ্গে জড়িত হলেও অবাক হওয়ার কারণ নেই৷ পুলিশ এবং আইনজ্ঞদের ধারণা, অপরাধ প্রমাণিত হলে গ্রেফতার হওয়া প্রত্যেক অভিযুক্তের অন্তত ১০ বছরের কারাবাস হবে৷ সঙ্গে বিপুল টাকা ক্ষতিপূরণও দিতে হবে৷
গায়ক থেকে জঙ্গি হওয়া সেই জার্মানের মৃত্যু
জার্মানির সবচেয়ে পরিচিত জিহাদি ডেনিস কুসপার্ট সিরিয়ায় মারা গেছেন বলে জানিয়েছে ইসলামিক স্টেটপন্থি একটি ওয়েবসাইট৷ সাইটটিতে তার মৃতদেহের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে৷ চলুন জেনে নিই কে এই ডেনিস কুসপার্ট৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ব়্যাপার থেকে জিহাদি
যখন মিউজিক করতেন তখন লোকে চিনত ‘ডেসো ডগ’ নামে৷ বার্লিনে জন্মগ্রহণ করা কুসপার্ট ২০০৯ সালে সঙ্গীত ছেড়ে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সালাফিদের সঙ্গে মেশা শুরু করেন৷ ২০১২ সালে মিশর থেকে সিরিয়া গিয়ে নিরুদ্দেশ হন৷ প্রথমে আল কায়েদার অনুসারী আল নুসরায় যোগ দেন৷ পরে ২০১৪ সালে আইএসের সঙ্গে যুক্ত হন৷
ছবি: imago/S. Lambert
আকর্ষণীয় বক্তা কুসপার্ট
‘বিদেশি ভ্রাতাদের’ আইএস-এ আকৃষ্ট করতে বিশেষ ভুমিকা পালন করেন কুসপার্ট৷ ওয়াফা জানায়, আইএস-এর মিডিয়া ডিভিশন তৈরি করতেও ভুমিকা রেখেছেন তিনি৷
ছবি: twitter.com
জঙ্গি হামলার ডাক
ইউরোপে জঙ্গি আক্রমণের ডাক প্রায়ই দিতেন কুসপার্ট৷ কখনো কখনো হিংসাত্মক ভিডিও পোস্ট করতেন৷ জার্মান ভাষাভাষী তরুণদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কুসপার্টের প্রেমে এফবিআই কর্মকর্তা
কুসপার্টকে মনিটর করার জন্য এক এফবিআই অনুবাদককে নিয়োগ করা হয়েছিল৷ তিনি কুসপার্টের সঙ্গে দেখা করতে ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে তুরস্ক থেকে সিরিয়া যান৷ সেখানে গিয়ে ঘানাইয়ান বংশোদ্ভুত এই জার্মানের প্রেমে পড়ে যান সেই নারী৷ বিয়ে করেন তাকে৷ পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে সেই কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যান এবং জেল খাটেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/M. Reynolds
ওয়াফা মিডিয়ার রিপোর্ট
আইএসপন্থি মিডিয়া ওয়াফাতে কুসপার্টের মৃত্যুর খবর প্রকাশ করা হয়েছে৷ সেখানে তার মৃতদেহের ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে৷ তাদের তথ্য অনুযায়ী, কুসপার্ট গেল ১৭ জানুয়ারি পূর্ব সিরিয়ার দেইর-আল-জোর রাজ্যে নিহত হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সাইট ইনটেলিজেন্স গ্রুপের সমর্থন
জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট অনলাইন সাইটগুলোকে অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ৷ কুসপার্টের মৃত্যু নিয়ে ওয়াফা মিডিয়ার এ রিপোর্টকে সমর্থন জানিয়েছে তারা৷ সাইট ইন্টেলিজেন্সের পরিচালক রিতা কার্ৎজ টুইটারে লিখেছেন যে, যদিও আইএস এই মৃত্যুর কথা এখনো স্বীকার করেনি, তারপরও ওয়াফা মিডিয়া যেসব তথ্য প্রমাণ হাজির করেছে, তাতে রিপোর্টটি সত্য বলেই মনে হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আগেও মারা গিয়েছিলেন কুসপার্ট!
কুসপারের মৃত্যুর খবর এর আগেও চাউর হয়েছিলো ২০১৫ সালে৷ সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় তিনি মারা গিয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়েছিল৷ পরে পেন্টাগন জানায়, কুসপার্ট মারা যাননি, আহত হয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Ibrahim Erikan
জার্মানিতে জঙ্গিবাদ
স্বল্প পরিসরে হলেও জার্মানিতে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটেছে৷ গেল বছর অক্টোবর মাসে জঙ্গিবাদী গ্রুপের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবশির নামের এক ব্যক্তিতে দুই বছর দশ মাসের কারাদণ্ড দেন জার্মানির আদালত৷ পরে ওজকান নামের আরেক ব্যক্তিও দুই বছর আট মাস কারাবাসের সাজা পান৷
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি বেড়েছে জার্মানিতে৷ গেল কয়েক বছরে বেশ কয়েকজন জার্মান নাগরিককে জঙ্গিবাদের সংশ্লিষ্টতার জন্য সাজা দেয়া হয়েছে৷ ২০১৬ সালে ৮ জনকে আল শাবাবসহ সিরিয়ার জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলোতে যোগ দেবার কারণে সাজা দেয়া হয়৷ ২০১১ সালের তুলনায় বার্লিনে সালাফিস্ট সন্ত্রাসীদের সংখ্যা প্রায় তিনগুণ হয়েছে৷ এক প্রতিবেদনে এমনটাই জানিয়েছে জার্মানির গোয়েন্দা সংস্থা বিএফভি৷
ছবি: picture alliance/dpa/C. Jaspersen
সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিএসজি ৯
সন্ত্রাসের ঝুঁকি বাড়ার কারণে ১৯৭২ সালে মিউনিখে এক ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হত্যাকাণ্ডের পর বিশেষ বাহিনী জিএসজি-৯ গঠন করে জার্মানি৷ বাহিনীর একটি বিশেষ স্কোয়াডকে এখন রাজধানী বার্লিনে নিয়োজিত করা হয়েছে৷ রাজধানীতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ায় এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে জার্মান পুলিশ৷