1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিশেষ রায়ে খারিজ বাংলার মুকুল রায়ের বিধায়ক সদস্যপদ

১৪ নভেম্বর ২০২৫

দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর খারিজ হয়ে গেল বিধায়ক মুকুল রায়ের সদস্যপদ। কলকাতা হাইকোর্টের এই রায় কেন যুগান্তকারী?

কলকাতা হাই কোর্ট।
দলবদল ঠেকাতে হাইকোর্টের রায় কাজে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।ছবি: Jagannath Raul/Dinodia Photo/imago images

দলত্যাগ বিরোধী আইনে মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ খারিজের আবেদন জমা পড়েছিল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার অধ্যক্ষের কাছে। সেই মামলা পৌঁছেছিল আদালতে। শুক্রবার বহু প্রতীক্ষিত মামলার রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে এই প্রথমবার আদালতের নির্দেশে কোন বিধায়কের সদস্যপদ খারিজ হল।

মুকুলকে নিয়ে টানাপড়েন

তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গেরক্ষমতায় আসার পর দলের সেকেন্ড ইন কম্যান্ড ছিলেন মুকুল রায়। তিনি ২০১৭ সালের ৩ নভেম্বরে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে নদিয়ার কৃষ্ণনগর উত্তর বিধানসভা কেন্দ্রে বিজেপির টিকিটে লড়ে জেতেন।

এই জয়ের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ১১ জুন বিজেপি বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেন ৷ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী হুঁশিয়ারি দেন, মুকুল দু'দিনের মধ্যে বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা না দিলে তার বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইনে বিধানসভার অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করা হবে। সেই আবেদন দু'বার খারিজ করে দেন অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়।

 

এরই মধ্যে মুকুল তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলেও নিজেকে বিজেপি বিধায়ক বলে বিধানসভার ভিতরে দাবি জানাতে থাকেন। ২০২১-এর জুলাইয়ে তাকে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এই পদ পেয়ে থাকেন বিরোধী দলের নেতা। কার্যত তৃণমূলে যুক্ত হয়ে গেলেও এই পদে থেকে যান মুকুল। এর পরেই দলত্যাগ বিরোধী আইনে মুকুলের পিএসি চেয়ারম্যান হওয়ার বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিলেন কল্যাণীর বিজেপি বিধায়ক অম্বিকা রায়।

২০২২ সালে কলকাতা হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিশন বেঞ্চ বিধানসভার অধ্যক্ষকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু অধ্যক্ষ অর্জি খারিজ করে দিয়ে জানান, মুকুল বিজেপি বিধায়ক নন, এর সমর্থনে পর্যাপ্ত নথি দিতে পারেননি মামলাকারীরা।

বিরোধী দলনেতা একই আর্জি নিয়ে যান সুপ্রিম কোর্টে। শীর্ষ আদালত এই মামলা ফেরত পাঠায় হাইকোর্টে। চার বছরের বেশি সময় ধরে চলা আইনি লড়াইয়ের নিষ্পত্তি হল বৃহস্পতিবার। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও বিচারপতি মহাম্মদ শব্বর রশিদির বেঞ্চ খারিজ করে দেয় মুকুলের সদস্যপদ।

রায়ের প্রতিক্রিয়া

অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, "আমি সব দিক বিবেচনা করেই মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে দলত্যাগ বিরোধী আইনে আনা আবেদন খারিজ করেছিলাম। আদালত যে রায় দিয়েছে, তা পুরোটা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।"

তার মতে, "বিধানসভার অধ্যক্ষ হিসেবে আমার কিছু সাংবিধানিক ক্ষমতা রয়েছে। সংবিধানের ২১২ ধারা অনুযায়ী, বিধানসভার অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপ নিয়ে আদালত সাধারণত হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কীভাবে আদালত এখানে প্রবেশ করল, সেটা রায় না দেখে বলা সম্ভব নয়।"

যদিও আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সংবাদমাধ্যমে বলেন, "আদালতের নির্দেশ মানতে বাধ্য থাকবেন বিধানসভার স্পিকার। এই নির্দেশ অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার নেই। তিনি হাইকোর্টের উপরে নন। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি বিচারের ঊর্ধে নন। সেটা তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হন অথবা লোকসভা বা বিধানসভার স্পিকার।"

মামলার অন্যতম আবেদনকারী বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, "ভারতবর্ষের সংবিধান শেষ কথা বলে। এটা সংবিধানের জয় হয়েছে। আমি খুশি। এবার পালা আলিপুরদুয়ারের সুমন কাঞ্জিলাল, বিষ্ণুপুরের তন্ময় ঘোষ, হলদিয়ার তাপসী মণ্ডলের। আমরা এই রায়ের পরেই এদের বিরুদ্ধে আদালতে যাব। আমরা স্পিকারের কাছে আবেদন জানিয়েছি জানিয়েছি, উনি পদক্ষেপ করেননি।"

তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ সংবাদ মাধ্যমে বলেন, "দলত্যাগের বিষয়ে বিজেপির জ্ঞান দেয়া উচিত নয়। বিভিন্ন রাজ্যে বিরোধী দল ভাঙিয়ে বিজেপি সরকার তৈরি করেছে। আর পশ্চিমবঙ্গে যারা তৃণমূলে যোগ দিয়ে উন্নয়নে সামিল হয়েছেন, তারা নির্বাচনে লড়লে মানুষের রায়ে জয়ী হবেন।"

রায়ের তাৎপর্য

দলবদল ঠেকাতে হাইকোর্টের রায় কাজে আসতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম বলেন, "দলবদল সার্বিকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের জন্য খারাপ। মুকুল রায় তো একাধিকবার দলবদল করেছেন, আরও অনেকে করেছেন। হাইকোর্টের রায় যদি ভবিষ্যতে কঠোর ভাবে পালন করা হয় সেটা আশার কথা। ভবিষ্যতে এটার কার্যকারিতা নিশ্চয়ই স্পিকারের সক্রিয়তার উপরেও নির্ভর করবে। স্পিকারের ভূমিকা নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ না হলে প্রতি কথায় আদালতের মুখাপেক্ষী হতে হবে, সেটাও সবল গণতন্ত্রের পরিচয় নয়। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনীতিতে যারা আছেন, তাদের অনেকেই নানা সময়ে দলবদল করেছেন। নির্বাচনে এক দলের হয়ে জিতে অন্য দলে যোগ দেওয়ার অর্থ, মানুষের মতামতকে অগ্রাহ্য করা।"

কিন্তু দলত্যাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া অনেকটাই নির্ভর করছে আইনসভার অধ্যক্ষের ভূমিকার উপরে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী সংবাদ মাধ্যমে বলেন, "যার এই আইন রক্ষা করার কথা ছিল, তিনি এই আইনকে কার্যকারী করেননি। তিনি চুপ করে ছিলেন। আজ যদি তিনি প্রশ্ন করেন আমার অধিকারে হস্তক্ষেপ কেন, এটা কতটা সংগতিপূর্ণ? ১৯৮৫ সালের আইন কে মাথায় রেখে কেন তিনি সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারলেন না।"

তিনি বলেন, "এই রায়ের একটা সুদূররপ্রসারী প্রভাব আছে। বিধায়করা ধরেই নিয়েছিলেন যে, ইচ্ছে মতো দল বদলানো যায়। কিন্তু এই রায়ের পরে, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী বিধায়করা দল বদলানোর আগে দু'বার ভাববেন।"

সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ

ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও দলবদল জলভাত হয়ে গিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে এমন একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা চলছে শীর্ষ আদালতে।

ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) ১০ জন বিধায়ক পদত্যাগ না করে যোগ দিয়েছিলেন রাজ্যে সদ্য ক্ষমতায় আসা কংগ্রেসে। এর বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের কাছে আবেদন করলেও তিনি সিদ্ধান্ত নেননি। এর বিরুদ্ধে আদালতে যায় সেই রাজ্যের বিরোধী দলটি। ৩১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ অধ্যক্ষ জিপি কুমারকে তিন মাসের সময় বেঁধে দেন এ নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য।

সেই সময়সীমা পার হয়ে গেলেও তেলেঙ্গানা বিধানসভার অধ্যক্ষ কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। এবার তার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আদালত অবমাননার মামলা হয়েছে। ১৭ নভেম্বর এই আবেদনে শুনানি হবে।

এই মামলার কথা উল্লেখ করে প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণ বলেছিলেন, কীভাবে স্পিকার সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা আদালত বলতে পারে না। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা বলতে পারে। প্রধান বিচারপতির মতে, যখন স্পিকার দলত্যাগের মামলা বিচার করছেন, তখন আসলে তিনি স্পিকারের ভূমিকা পালন করছেন না। তখন তার ভূমিকা ট্রাইবুনালের বিচারকের। তার এই ভূমিকা আদালতের পর্যালোচনার মধ্যে পড়ে।"

একই বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "জুলাই মাসে সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণে বলেছে, সংবিধানের ১২২ বা ২১২ নম্বর ধারায় যে রক্ষাকবচ স্পিকারের রয়েছে, দলত্যাগ বিরোধী আইন প্রয়োগ তার আওতায় পড়বে না। মুকুল রায়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়টাই হাইকোর্টে প্রতিষ্ঠিত হল। হাইকোর্ট আবার একই ধরনের রায় দিতে পারে অর্থাৎ দলত্যাগী নেতাদের সদস্যপদ খারিজের ক্ষেত্রে যে বিলম্বিত প্রক্রিয়া চলত, সেটা আর থাকবে না। দলবদল রোখার ক্ষেত্রে এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে।"

তার কথায়, "শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশের অন্যান্য রাজ্যের স্পিকাররা দলবদলকারী নেতাদের ক্ষেত্রে অনেক বিলম্বিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলেন। এই বিষয়ে আদালত যে হস্তক্ষেপ করতে পারে, সেটা সুপ্রিম কোর্টের জুলাইয়ের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সুতরাং কেউ এক দলের টিকিটে জিতে অন্য দলে চলে গেলে, আর যে কোনো উপায়ে সদস্যপদ টিকিয়ে রাখতে পারবেন না। আদালতের নির্দেশে তার সদস্যপদ চলে যেতে পারে।"

নির্বাচনে প্রভাব

দলবদল করে অনেক নেতা অবশ্য পরবর্তী ভোটে জিতে বিধানসভার সদস্য হয়েছেন। হলদিয়ার তাপসী মণ্ডল ২০১৬ সালে সিপিএমের টিকিটে জিতেছিলেন। এর পরে তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিজেপির টিকিটে ২০২১-এ জয়লাভ করেন একই কেন্দ্রে। তার পরে যোগ দেন তৃণমূলে।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, "দলবদলের মতো বিষয় জনমানসে সেভাবে সাড়া ফেলে না, অন্য বিষয়ে যেভাবে ফেলে। এখন তো ধর্মের ভিত্তিতে ভোট বিভাজন হয়ে যাচ্ছে। এই যে মুকুল রায়ের বিধায়ক পদ খারিজ হল এত বছর পরে, সাধারণ মানুষ মনে করবেন, ভোটের মাত্র কয়েক মাস আগে খারিজ হল, এতে কী ফারাক হবে! তবে এটা যে গণতন্ত্রের পক্ষে একটা উজ্জ্বল বিষয়, সেটা মানুষকে বোঝাতে পারলে বিজেপি সুবিধা পেতে পারে।"

শুভাশিসের বক্তব্য, দলত্যাগের প্রবণতা আগের থেকে কমেছে। তিনি বলেন, "দলত্যাগীদের আগে বিজেপিতে যোগদানের প্রবণতা ছিল। কিন্তু এখন আর বিজেপি সেভাবে দলত্যাগীদের জেতাতে পারছে না। মহারাষ্ট্রে অশোক চৌহানকেও জেতাতে পারেনি। আর এখন তারা কাউকে দলে নিলে পদত্যাগ করিয়ে নিচ্ছে। জয় সম্পর্ক নিশ্চিত না হওয়ায় অনেকেই আর বিজেপিতে যোগ দিতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না। সম্প্রতি বিহারের নির্বাচনে খুব বড় মাপের কোনো দলবদল দেখা যায়নি। তাই ২০২১-এ পশ্চিমবঙ্গে যেভাবে বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক দেখা গিয়েছিল, এবার সেটা হওয়ার সম্ভাবনা কম।"

 

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ