১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার আগে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ভেবেছিলেন, গোটা কয়েক ম্যাচ ভারত খেলবে, প্রায় সবকটাতেই হারবে। তারপর তিনি বউকে নিয়ে চলে যাবেন অ্য়ামেরিকায় হানিমুন করতে। অধিকাংশ ক্রিকেটার তাদের পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। শুধু একজন মানুষ এর বাইরে গিয়ে ভেবেছিলেন, মনে করেছিলেন, ভারত বিশ্বকাপ জিততে পারে। তিনি হলেন কপিল দেব। যত দিন গেছে, ততই কপিলের আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হয়েছে দলের ভিতর। ফলে দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। শ্রীকান্তদের অ্য়ামেরিকার টিকিট বাতিল করতে হয়েছিল।
৪০ বছর পর আরেকটা একদিনের বিশ্বকাপে ভারতের খেলা দেখে মনে হচ্ছে, সবকছু অনেকটাই বদলে গেছে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলায়, মানসিকতায়, লড়াইয়ের মনোভাবে, আত্মবিশ্বাসে, নিজেকে উজাড় করে দেয়ায় এবং পরিকল্পনায় অনেক অনেক বদল এসেছে।
বিশ্বকাপ শুরুর আগেও কোচ হিসাবে রাহুল দ্রাবিড়, চোট পেয়ে ফিরে আসা ক্রিকেটার কে এল রাহুল ও বুমরাহ, সাদা বলের বোলার হিসাবে শামি, সিরাজ, কুলদীপরা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের খাতায় খুব বেশি নম্বর পাচ্ছিলেন না। যেমন শ্রেয়স আইয়ারকে তো বোঝা বলে মনে করা হচ্ছিল। কোন জাদুকাঠিতে তারা জ্বলে উঠলেন?
ভারতের ক্রিকেট বোর্ড যে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম তা কোনো নতুন তথ্য নয়। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড যে কাজটা করেছে, তা অন্য কোনো ক্রিকেট বোর্ড করে উঠতে পারেনি। তা হলো, ক্রিকেটারদের ঢালাও অর্থ দেয়া, আহত হলে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। তখনো তারা আগের মতোই অর্থ পেতে থাকেন। শুধু ক্রিকেটার নয়, কোচ, সাপোর্ট স্টাফ সকলকেই হাত উপুড় করে দেয় বোর্ড। প্লেয়াররা গ্রেডেশনের উপরে টাকা পান। এমনকী শুধু রঞ্জি খেলেই যথেষ্ট রোজগার করতে পারেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় স্তরে ২৬ জন ক্রিকেটার এ প্লাস গ্রেড থেকে সি গ্রেডে আছেন। তারা সাত কোটি থেকে এক কোটি টাকা বছরে পান। এরপর টেস্ট, একদিনের ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি, আইপিএলের খেলার টাকা আলাদা।
বোর্ডের আরেকটা বড় কাজ হলো জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি (এনসিএ)। বেঙ্গালুরুতে যে নতুন এনসিএ ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে, সেখানে ৪০টি প্র্যাকটিস পিচ থাকছে। সেই সঙ্গে থাকছে ১৬ হাজার বর্গফুটের জিম। তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় এরকম সুইমিং পুল। ২৪৩টি থাকার ঘর। সেই সঙ্গে সেরা কোচ, সেরা স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক, কোনো অসুবিধা হলেই প্লেয়ারদের বাইরে থেকে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা। স্কুল পর্য়ায় থেকে হবু ক্রিকেটাররা এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। বুমরাহরা ছয়টি বিভিন্ন ধরনের পিচে অনুশীলন করে এসেছেন।
ক্রিকেট বিশ্বকাপের কিছু অসাধারণ মুহূর্ত
এবারের বিশ্বকাপে রেকর্ডের ছড়াছড়িই শুধু নয়, এই আসর সাক্ষী হয়েছে একের পর এক রোমাঞ্চকর মুহূর্তের৷ তেমনই কিছু মুহূর্ত ও ঘটনা নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: ANUSHREE FADNAVIS/REUTERS
কোহলির ৫০
১৫ নভেম্বর ২০২৩৷ বল হাতে দৌঁড়ে আসছেন কিউই পেসার ফারগুসন৷ ওপারে ব্যাট হাতে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে তিনি৷ ছোটবেলায় যে মাইলফলককে দূরে তারার মতো জ্বলতে দেখেছেন, সেই লিটল মাস্টারও গ্যালারিতে৷ বলটি লং লেগ ও ডিপ মিডউইকেটের মাঝে ঠেলে দিয়ে দৌঁড়৷ সে দৌঁড়ে ভিরাট কোহলি ছাড়িয়ে গেলেন নায়ক শচীন টেন্ডুলকারকে৷ নায়ককে সম্মান জানাতে ভোলেননি ওয়ানডেতে ৫০টি সেঞ্চুরি করা একমাত্র এই ব্যাটসম্যান৷
ছবি: ADNAN ABIDI/REUTERS
শামির সাত উইকেট
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে যে সেমিফাইনালে কোহলির এই কীর্তি, একই ম্যাচে বল হাতে কিউই শিবিরকে ধসিয়ে জয়ের মূল নায়ক বনে গেলেন ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামী৷ তার সেদিনের সাত উইকেট এই বিশ্বকাপের সেরা বোলিং স্পেল৷ হার্দিক পান্ডিয়ার ইনজুরির কারণে দলে সুযোগ পেয়ে এবারের বিশ্বকাপে তিনবার গড়লেন পাঁচ উইকেট তুলে নেবার কীর্তি৷ এই মুহূর্তে বিশ্বকাপে পাঁচ উইকেট শিকারিদের শীর্ষে (চারবার) এই বোলিং মায়েস্ত্রো৷
ছবি: PUNIT PARANJPE/AFP/Getty Images
অবিশ্বাস্য ম্যাক্সওয়েল
প্রথমে নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে বিশ্বকাপের দ্রুততম সেঞ্চুরি (৪০ বলে) করেও মন ভরেনি তার৷ আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে কিছু একটা নিশ্চিত ভর করেছিল তার ওপর৷ এ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানের ইনিংসটির (অপরাজিত ২০১ রান) অর্ধেকই করলেন এক পায়ের ফুটওয়ার্কে৷ ২৯১ রান তাড়া করতে যেখানে পুরো অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিং ধসে পড়ল, সেখানে আফগানিস্তানের সেমিফাইনালের স্বপ্ন একাই ধূলিসাৎ করলেন ম্যাক্সওয়েল৷
ছবি: Rajanish Kakade/AP/picture alliance
বিশ্বকাপের প্রথম ‘টাইমড আউট’
ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথমবার কেউ ‘টাইমড আউট’ হলেন৷ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞ ক্রিকেটার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুজ নিয়ম অনুযায়ী আগের ব্যাটসম্যান আউট হবার দুই মিনিটের মধ্যে বল ফেস করার জন্য প্রস্তুত না হওয়ায় আউটের আপিল করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক সাকিব৷ নিয়মে থাকায় আম্পায়ার আউট দেন৷ সেদিন বাংলাদেশের জয় ছাপিয়ে সারাবিশ্বের ক্রিকেট অঙ্গনে ঝড় ওঠে এই আপিল ও সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে৷
ছবি: ANUSHREE FADNAVIS/REUTERS
আফগানিস্তানের জয়রথ
বাংলাদেশের কাছে প্রথম ম্যাচ হারার পর যেন একরকম জয়ের ভূত চাপে আফগানিস্তানের কাঁধে৷ গুরবাজ-রহমতউল্লাহ-রশিদ খানরা রীতিমত কাঁপন ধরান বড় বড় দলগুলোর শিবিরে৷ প্রথমে সাবেক চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ড, তারপর পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে জয় তুলে সেমিফাইনালে যেতে বড় দলগুলোর কাঁধে কাঁধ রেখে লড়েন তারা৷ অস্ট্রেলিয়ার ম্যাক্সওয়েলের দানবীয় ইনিংসটি না হলে হয়তো ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত৷
ছবি: SAMUEL RAJKUMAR/REUTERS
পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রান তাড়া
হায়াদ্রাবাদে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার গ্রুপ ম্যাচটিও ছিল বিশেষ কিছু৷ এ ম্যাচে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জেতে পাকিস্তান৷ শ্রীলঙ্কার ছুঁড়ে দেয়া ৩৪৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ৪৯তম ওভারেই জয় নিশ্চিত করেন বাবর-রিজওয়ানরা৷ এই ম্যাচে দুই দলের চার খেলোয়াড় সেঞ্চুরি করেন, যেটিও একটি রেকর্ড৷
ছবি: Noah Seelam/AFP
নেদারল্যান্ডসের আফ্রিকা বধ
নেদারল্যান্ডস ছোট দল হিসেবে এলেও কাউকে ছেড়ে কথা বলেনি৷ তাদের প্রথম চমক ভয়ংকরদর্শন এক সাউথ আফ্রিকাকে হারিয়ে দিয়ে৷ ধর্মশালায় প্রথমে ব্যাট করে ২৪৬ রানের টার্গেট দেয় ডাচরা৷ জবাবে প্রোটিয়ারা গুটিয়ে যায় ২০৭ রানে৷
ছবি: Money Sharma/AFP/Getty Images
ব্রিটিশদের ভরাডুবি
বর্তমান চ্যাম্পিয়নদের শুরুটা রানার্সআপ নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষের হার দিয়ে৷ এরপর বাংলাদেশের সঙ্গে জিতলেও একের পর এক পরাজয় দলটিকে কঠিন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায়৷ এমনকি আলোচিত হয় অধিনায়কত্ব ও দলের ভেতর নানা সমস্যা নিয়েও৷
ছবি: Gareth Copley/Getty Images
রোহিতও সেরা
ভিরাট ওয়ানডে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক হলেও বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক এখন রোহিত শর্মা৷ আফগানিস্তানের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে ৬৩ বলে সেঞ্চুরি করেন তিনি৷ এ নিয়ে বিশ্বকাপে তার সেঞ্চুরির সংখ্যা সর্বোচ্চ ৭টি৷
ছবি: Money Sharma/AFP/Getty Images
মাহমুদুল্লাহর সেঞ্চুরি
দলে নেয়া হবে কি হবে না তা ছিল না নিশ্চিত৷ বোর্ড প্রেসিডেন্টের কথাতেও তা বোঝা যায়নি৷ শেষ পর্যন্ত অভিজ্ঞতাকে দাম দিয়ে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদকে দলে টানা হয়৷ তার মান রাখেন মাহমুদুল্লাহ৷ বিশ্বকাপে যেখানে বাংলাদেশের টপঅর্ডাররা খাবি খাচ্ছিলেন, সেখানে তিনি একটি সেঞ্চুরিসহ দলের জন্য সর্বোচ্চ ৩২৮ রান করেন৷ সাউথ আফ্রিকার বিপক্ষে তার ১১১ বলে ১১১ রানের ইনিংসটি সবার প্রশংসা কুড়িয়েছে৷
ছবি: INDRANIL MUKHERJEE/AFP
10 ছবি1 | 10
এই বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বোর্ড প্রেসিডেন্ট রজার বিনি কোচ রাহুল দ্রাবিড়-সহ সব ক্রিকেটার ও এনসিএ-র স্পোর্টস মেডিসিনের ডাক্তার ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসেছিলেন। তারপর প্রত্য়েক প্লেয়ারের জন্য তালিকা তৈরি করে দেয়া হয়েছিল, তারা প্রতিদিন কী কী ব্যায়াম করবেন, কীভাবে নিজেকে ফিট রাখবেন, কী খাবেন সব তাতে বলা হয়েছিল। প্রত্যেক প্লেয়ারকে বলে দেয়া হয়েছিল, এই চার্ট অন্ধের মতো অনুসরণ করতে হবে। তাছাড়া ছিল সকলে মিলে প্র্য়াকটিস সেশন। সেজন্যই চোট সারিয়ে আসা কে এল রাহুল এবং বুমরাহ তো বটেই পুরো টিমকে এতটা ফিট লেগেছে। প্লেয়ারদের ভিতরে এটা ঢুকে গছে। শুভমনের ডেঙ্গু হয়েছিল। সেরে ওঠার পরই তিনি অসাধারণ খেলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ডেঙ্গুর জন্য অসুবিধা হচ্ছে না? শুভমন বলেন, ওজন কমেছে। আরো অন্তত পাঁচ কেজি ওজন বাড়াতে হবে। তাহলে পেশীর সন্তুলন ঠিক থাকবে। অন্য টিমের তরুণ ক্রিকেটারের মুখে এই ধরনের কোনো কথা শুনেছেন কি?
আরেক জনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন রাহুল দ্রাবিড়। বন্ধু সৌরভের কথা ফেলতে না পেরে জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম তাকে কেউ কোচ হিসাবে নম্বর দিচ্ছিলেন না। বরং যুব ক্রিকেটারদের উপর অত্যাধিক ভরসা রাখায় বিরক্ত হচ্ছিলেন। ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরেও শ্রেয়েস আইয়ার-সহ একাধিক ক্রিকেটারকে সুয়োগ দেয়া, তাদের উপর ভরসা রাখার জন্য কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। তারপরেও নিজের মত ও পথ থেকে সরেননি গ্রাবিড়। তার সুবিধা হলো তিনি ছিলেন নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার, যার মধ্যে ট্যালেন্ট, টেমপরামেন্ট ও টেকনিক ছিল। আর কোচ হয়ে দ্রাবিড় তার সঙ্গে আরো কয়েকটি বিষয় যোগ করেছেন, শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা, নিরপেক্ষতা এবং একে অপরকে সম্মান করা। টিমটাকে একসূত্রে বাঁধতে পেরেছেন তিনি। প্রত্যেকের মনে হার না মানা ভাব চাগিয়ে তুলেছেন। সকলের কাছ থেকে তাদের সেরা খেলাটা বের করে আনতে পারাটা তাই সহজ হচ্ছে। নিজে সহজভাবে সকলের সঙ্গে মেশেন বলে তিনি এটা করতে পেরেছেন।
এবারের বিশ্বকাপের সাফল্যের পিছনে আছে একটা নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি, যা প্রতিটি ম্যাচে খেটে যাচ্ছে। রোহিত এসে চালিয়ে খেলবেন। প্রথমেই বেশ কিছু রান তুলে নেবেন। লেগের উপর বল পেলেই ফ্লিক করে ছয় মারবেন। গোড়ার ওভারগুলিতে ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে মেরে দ্রুত রান তুলবেন। তাকে যোগ্য সঙ্গত দেবেন শুভমন গিল। বিরাট এসে ধরে খেলবেন। তিনি একদিকটা যেমন ধরে রাখবেন, তেমনই বড় ঝুঁকি না নিয়ে স্কোরবোর্ডও সচল রাখবেন। তখন শুভমন মারবেন। তিনি আউট হলে শ্রেয়স, কে এল রাহুলরা এই দায়িত্ব নেবেন। ভারতের প্রথম পাঁচ-ছয়জন ব্যটারের ফর্ম এখন এতটাই ভালো যে, সূর্যকুমার, জাদেজাদের খেলার সুয়োগই খুব কম হচ্ছে। হার্দিক পান্ডিয়ার মতো ক্রিকেটারের অভাব পর্যন্ত বিন্দুমাত্র অনুভূত হচ্ছে না। একের পর এক সেঞ্চুরি বা হাফ সেঞ্চুরি করছেন বিরাট, শ্রেয়স, শুভমন, কে এল রাহুল। উইকেটকিপার হিসাবে তো কে এল রাহুল তিনশ শতাংশ উন্নতি করেছেন। এর পিছনেও এনসিএ-র হাত আছে।
তবে একটা কথা না বললেই নয়, আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটারদের আরো পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে জয়ের খিদে বাড়িয়েছে। আর বিশ্বের সব বড় ক্রিকেটারদের পাশে থাকা, তাদের বিরুদ্ধে খেলা, তাদের অনুশীলন দেখা, টিপস নেয়াটাও কম কাজে লাগছে না।
বুমরাহ আগে থেকেই ভয়ঙ্কর ছিলেন। চোট সরিয়ে ফিরে আসার পরেও একইরকম আছেন। সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে মহম্মদ সিরাজের। তিনি ক্রমশ ক্ষুরধার হচ্ছেন। আর অবাক করে দিচ্ছেন মহম্মদ শামি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে মাঠে নেমে কোনো পেসার যে ভারতের পিচে এতটা ভয়ংকর হতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এর পিছনে শামির কৃতিত্ব সর্বাধিক। আরো একজনের অবদানও আছে। তিনি হলেন বোলিং কোচ ভরত অরুণ। তিনি প্রচারের বাইরে থেকে নীরবে কাজ করেন। বোলারদের যেভাবে তিনি পরিচালিত করেছেন তা অসাধারণ।
ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছেন, ভারতের এই টিমটা ২০০৩ সালের অস্ট্রেলিয়ার মতো। অস্ট্রেলিয়ার সেই টিমে ছিলেন, পন্টিং, হেডেন, গিলক্রিস্ট, বিভান, লেহম্যান, শ্যেন ওয়াটসন, সিমন্ডস, ম্য়াকগ্রা, ব্রেট লি, গিলেপসি, ওয়ার্নরা। ক্রিকেটারদের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই টিম সব অর্থেই অসাধারণ ছিল।
ভারতের এই টিম ওই পর্যায়ে যাবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে পারফরমেন্স, দায়বদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস, লড়াই, দলগত সংহতি, ফিটনেস ও জয়ের খিদের হিসাবে এই টিম অনেকেরই আগে আছে। পুরো টিমটাই চেগে আছে। আগে বিরাট কোহলিকে মাঠে সবচেয়ে আবেগতাড়িত ও আক্রমণাত্মক লাগত। এই বিশ্বকাপে কোহলি বরং অনেক ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তুলনায় রহিত অনেক বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছেন। তাকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছেন সিরাজরা।
রোহিতরা শেষ হাসি হাসতে পারবেন নাকি, তারা কাপ জেতার একধাপ আগে থেমে যাবেন জানি না। শুধু এটুকুই জানি, তারা স্বপ্নের ক্রিকেট খেলছেন। এরকম খেলা দেখতেই মানুষ মাঠে যান, টিভি-র পর্দায় চোখ রেখে বসে থাকেন। একটা টুর্নামেন্টে একের পর এক তাবড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে তারা যেভাবে হেলায় হারিয়েছেন এবং ক্রিকেট-ভক্তদের আনন্দ দিয়েছেন, তাই বা কম কীসে। তারা এখন ক্রিকেটের সুপারস্টার হয়ে গেছেন।
শামি কীভাবে এই সাফল্য পেলেন?
বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে সাত উইকেট নিয়ে দলকে জিতিয়েছেন শামি। তার এই সাফল্যের রহস্য কী?
ছবি: PUNIT PARANJPE/AFP/Getty Images
অবিশ্বাস্য বোলিং
নয় দশমিক পাঁচ ওভারে ৫৭ রান দিয়ে সাত উইকেট। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই অতিমানবিক পারফরমেন্স করে ভারতকে ফাইনালে তুললেন মহম্মদ শামি। আউট করলেন কনওয়ে, রাচিন রবীন্দ্র, উইলিয়ামসন, মিচেল, লাথাম, স্যন্টনার, সাউদিকে। নিউজিল্য়ান্ডের মতো প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে এই বোলিং নিয়ে কোনো কথা হবে না।
ছবি: Manish Swarup/AP Photo/picture alliance
তাও অখুশি শামি
এই পারফরমেন্সের পরেও শামি খুশি নয়। খেলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি বারবার আক্ষেপ করছিলেন, ''উইলিয়ামসনের ক্যাচটা ফেলা আমার উচিত হয়নি। অবশ্যই ধরা উচিত ছিল। ক্যাচটা ফেলে খুব খারাপ লাগছিল।'' যে ক্যাচের কথা শামি বলছেন, সেটা মোটেই কঠিন ছিল না। পরে অবশ্য উইলিয়ামসনকে তিনিই আউট করেন।
ছবি: Adnan Abidi/REUTERS
'সুযোগের অপেক্ষায় থাকি'
শামি জানিয়েছেন, তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তার কথায়, ''আমি সাদা বলে খেলার খুব বেশি সুযোগ পাই না। তাই মুখিয়ে থাকি। সুযোগ পেলে তার সদ্বব্যবহার করার চেষ্টা করি।'' এবারের বিশ্বকাপেও প্রথম কয়েকটা ম্যাচে খেলার সুয়োগ পাননি। বাইরে বসে কাটাতে হয়েছিল। প্রথম সুযোগেই বজিমাত করছিলেন শামি। নিয়েছিলেন পাঁচ উইকেট।
ছবি: Rajanish Kakade/AP/picture alliance
সাফল্যের রহস্য কী?
শামি জানিয়েছেন, তার সাফল্যের রহস্য হলো, বলটা ঠিক জায়গায় রাখা। শামি বলেছেন, ''অনেকে বলের বৈচিত্রের কথা বলেন, তবে আমার মনে হয়, বল ঠিক জায়গায় রাখাটাই সবচেয়ে জরুরি। তাহলে সাফল্য আসবেই। ম্যাচের যে কোনো সময় এভাবেই উইকেট পাওয়া যায়।'' তবে, শামির বলের বৈচিত্রও যথেষ্ট। দুই দিকেই সুইং করাতে পারেন। অসম্ভভ ভালো স্লোয়ার দেন। ইয়র্কারেও পারদর্শী।
ছবি: SAEED KHAN/AFP/Getty Images
১৭ ম্যাচে ৫০ উইকেট
বিশ্বকাপে মাত্র ১৭ ম্যাচ খেলে ৫০ উইকেট পেয়েছেন শামি। বিশ্বকাপে তার উইকেটের সংগ্রহ ৫৪। বিশ্বকাপে এত দ্রুত ৫০ উইকেট কোনো বোলার নিতে পারেননি। বিশ্বের সপ্তম বোলার হিসাবে একদিনের বিশ্বকাপে শামি ৫০ উইকেট নিলেন। বোলিংয়ের ক্ষেত্রে একটা অবিশ্বাস্য সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
ছবি: FRANCIS MASCARENHAS/REUTERS
চারবার পাঁচ উইকেট
এই বিশ্বকাপে এই নিয়ে তিনবার পাঁচ উইকেট পেলেন শামি। তিনবার ম্যাচের সেরা হলেন তিনি। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে চারবার পাঁচ উইকেট নিয়েছেন তিনি। এই নজির আর কোনো বোলারের নেই।
ছবি: Rajanish Kakade/AP/picture alliance
সবচেয়ে বেশি উইকেট
উইকেট নেয়ার তালিকায় জাম্পাকে পিছনে ফেলে এখন এক নম্বরে শামি। এই বিশ্বকাপে তিনি ২৩টি উইকেট নিয়েছেন। তাছাড়া তিনিই একমাত্র ভারতীয় বোলার যিনি বিশ্বকাপের একটি ম্যাচে সাতটি উইকেট নিলেন। এর আহে নেহরা ছয়টি উইকেট নিয়েছিলেন।
ছবি: PUNIT PARANJPE/AFP/Getty Images
পারিবারিক জটিলতা টলাতে পারেনি
কিছুদিন আগে বাবাকে হারিয়েছেন। স্ত্রীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা চলছে। স্ত্রী হাসিন জাহান শামির বিরুদ্ধে নিয়মিত ভয়ংকর সব অভিযোগ করেন। আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছেন শামি। সেখান থেকে মাঠে ফিরে এসে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। ক্রিকেটের ২২ গজই তার মুক্তির জায়গা।