1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিশ্বকাপে ভারতের সাফল্যের চাবিকাঠি

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১৮ নভেম্বর ২০২৩

বিশ্বকাপের আগেও ভাবা যায়নি, ভারতীয় ক্রিকেটাররা এরকম স্বপ্নের ফর্মে থাকবেন।

এবারের বিশ্বকাপে ভারতের সাফল্যের পিছনে আছে একটা নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি, যা প্রতিটি ম্যাচে খেটে যাচ্ছে। ছবি: PUNIT PARANJPE/AFP/Getty Images

১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেট খেলতে যাওয়ার আগে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত ভেবেছিলেন, গোটা কয়েক ম্যাচ ভারত খেলবে, প্রায় সবকটাতেই হারবে। তারপর তিনি বউকে নিয়ে চলে যাবেন অ্য়ামেরিকায় হানিমুন করতে। অধিকাংশ ক্রিকেটার তাদের পরবর্তী ভ্রমণের পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। শুধু একজন মানুষ এর বাইরে গিয়ে ভেবেছিলেন, মনে করেছিলেন, ভারত বিশ্বকাপ জিততে পারে। তিনি হলেন কপিল দেব। যত দিন গেছে, ততই কপিলের আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত হয়েছে দলের ভিতর। ফলে দুর্ধর্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত। শ্রীকান্তদের অ্য়ামেরিকার টিকিট বাতিল করতে হয়েছিল।

৪০ বছর পর আরেকটা একদিনের বিশ্বকাপে ভারতের খেলা দেখে মনে হচ্ছে, সবকছু অনেকটাই বদলে গেছে। ভারতীয় ক্রিকেটারদের খেলায়, মানসিকতায়, লড়াইয়ের মনোভাবে, আত্মবিশ্বাসে, নিজেকে উজাড় করে দেয়ায় এবং পরিকল্পনায় অনেক অনেক বদল এসেছে। 

বিশ্বকাপ শুরুর আগেও কোচ হিসাবে রাহুল দ্রাবিড়, চোট পেয়ে ফিরে আসা ক্রিকেটার কে এল রাহুল ও বুমরাহ, সাদা বলের বোলার হিসাবে শামি, সিরাজ, কুলদীপরা ক্রিকেট বিশেষজ্ঞের খাতায় খুব বেশি নম্বর পাচ্ছিলেন না। যেমন শ্রেয়স আইয়ারকে তো বোঝা বলে মনে করা হচ্ছিল। কোন জাদুকাঠিতে তারা জ্বলে উঠলেন?

ভারতের ক্রিকেট বোর্ড যে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ক্রীড়া সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম তা কোনো নতুন তথ্য নয়। কিন্তু ভারতীয় বোর্ড যে কাজটা করেছে, তা অন্য কোনো ক্রিকেট বোর্ড করে উঠতে পারেনি।  তা হলো, ক্রিকেটারদের ঢালাও অর্থ দেয়া, আহত হলে তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া।  তখনো তারা আগের মতোই অর্থ পেতে থাকেন। শুধু ক্রিকেটার নয়, কোচ, সাপোর্ট স্টাফ সকলকেই হাত উপুড় করে দেয় বোর্ড। প্লেয়াররা গ্রেডেশনের উপরে টাকা পান। এমনকী শুধু রঞ্জি খেলেই যথেষ্ট রোজগার করতে পারেন ক্রিকেটাররা। জাতীয় স্তরে ২৬ জন ক্রিকেটার এ প্লাস গ্রেড থেকে সি গ্রেডে আছেন। তারা সাত কোটি থেকে এক কোটি টাকা বছরে পান।  এরপর টেস্ট, একদিনের ক্রিকেট, টি-টোয়েন্টি, আইপিএলের খেলার টাকা আলাদা। 

বোর্ডের আরেকটা বড় কাজ হলো জাতীয় ক্রিকেট একাডেমি (এনসিএ)। বেঙ্গালুরুতে যে নতুন এনসিএ ক্যাম্পাস তৈরি হচ্ছে, সেখানে ৪০টি প্র্যাকটিস পিচ থাকছে।  সেই সঙ্গে থাকছে ১৬ হাজার বর্গফুটের জিম। তাপ নিয়ন্ত্রণ করা যায় এরকম সুইমিং পুল। ২৪৩টি থাকার ঘর। সেই সঙ্গে সেরা কোচ, সেরা স্পোর্টস মেডিসিনের চিকিৎসক, কোনো অসুবিধা হলেই প্লেয়ারদের বাইরে থেকে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থা। স্কুল পর্য়ায় থেকে হবু ক্রিকেটাররা এখানে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন। বুমরাহরা ছয়টি বিভিন্ন ধরনের পিচে অনুশীলন করে এসেছেন।

এই বিশ্বকাপ শুরুর আগেই বোর্ড প্রেসিডেন্ট রজার বিনি কোচ রাহুল দ্রাবিড়-সহ সব ক্রিকেটার ও এনসিএ-র স্পোর্টস মেডিসিনের ডাক্তার ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বসেছিলেন। তারপর প্রত্য়েক প্লেয়ারের জন্য তালিকা তৈরি করে দেয়া হয়েছিল, তারা প্রতিদিন কী কী ব্যায়াম করবেন, কীভাবে নিজেকে ফিট রাখবেন, কী খাবেন সব তাতে বলা হয়েছিল। প্রত্যেক প্লেয়ারকে বলে দেয়া হয়েছিল, এই চার্ট অন্ধের মতো অনুসরণ করতে হবে। তাছাড়া ছিল সকলে মিলে প্র্য়াকটিস সেশন। সেজন্যই চোট সারিয়ে আসা কে এল রাহুল এবং বুমরাহ তো বটেই পুরো টিমকে এতটা ফিট লেগেছে।  প্লেয়ারদের ভিতরে এটা ঢুকে গছে। শুভমনের ডেঙ্গু হয়েছিল। সেরে ওঠার পরই তিনি অসাধারণ খেলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ডেঙ্গুর জন্য অসুবিধা হচ্ছে না? শুভমন বলেন, ওজন কমেছে। আরো অন্তত পাঁচ কেজি ওজন বাড়াতে হবে। তাহলে পেশীর সন্তুলন ঠিক থাকবে। অন্য টিমের তরুণ ক্রিকেটারের মুখে এই ধরনের কোনো কথা শুনেছেন কি?

আরেক জনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন রাহুল দ্রাবিড়। বন্ধু সৌরভের কথা ফেলতে না পেরে জাতীয় দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম তাকে কেউ কোচ হিসাবে নম্বর দিচ্ছিলেন না। বরং যুব ক্রিকেটারদের উপর অত্যাধিক ভরসা রাখায় বিরক্ত হচ্ছিলেন। ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পরেও শ্রেয়েস আইয়ার-সহ একাধিক ক্রিকেটারকে সুয়োগ দেয়া, তাদের উপর ভরসা রাখার জন্য কম কথা শুনতে হয়নি তাকে। তারপরেও নিজের মত ও পথ থেকে সরেননি গ্রাবিড়। তার সুবিধা হলো তিনি ছিলেন নিজের সময়ের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার, যার মধ্যে ট্যালেন্ট, টেমপরামেন্ট ও টেকনিক ছিল। আর কোচ হয়ে দ্রাবিড় তার সঙ্গে আরো কয়েকটি বিষয় যোগ করেছেন, শৃঙ্খলা, দায়বদ্ধতা, নিরপেক্ষতা এবং একে অপরকে সম্মান করা। টিমটাকে একসূত্রে বাঁধতে পেরেছেন তিনি। প্রত্যেকের মনে হার না মানা ভাব চাগিয়ে তুলেছেন। সকলের কাছ থেকে তাদের সেরা খেলাটা বের করে আনতে পারাটা তাই সহজ হচ্ছে। নিজে সহজভাবে সকলের সঙ্গে মেশেন বলে তিনি এটা করতে পেরেছেন।

এবারের বিশ্বকাপের সাফল্যের পিছনে আছে একটা নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি, যা প্রতিটি ম্যাচে খেটে যাচ্ছে। রোহিত এসে চালিয়ে খেলবেন। প্রথমেই বেশ কিছু রান তুলে নেবেন। লেগের উপর বল পেলেই ফ্লিক করে ছয় মারবেন। গোড়ার ওভারগুলিতে ফিল্ডারদের মাথার উপর দিয়ে মেরে দ্রুত রান তুলবেন। তাকে যোগ্য সঙ্গত দেবেন শুভমন গিল। বিরাট এসে ধরে খেলবেন। তিনি একদিকটা যেমন ধরে রাখবেন, তেমনই বড় ঝুঁকি না নিয়ে স্কোরবোর্ডও সচল রাখবেন। তখন শুভমন মারবেন। তিনি আউট হলে শ্রেয়স, কে এল রাহুলরা এই দায়িত্ব নেবেন। ভারতের প্রথম পাঁচ-ছয়জন ব্যটারের ফর্ম এখন এতটাই ভালো যে, সূর্যকুমার, জাদেজাদের খেলার সুয়োগই খুব কম হচ্ছে।  হার্দিক পান্ডিয়ার মতো ক্রিকেটারের অভাব পর্যন্ত বিন্দুমাত্র অনুভূত হচ্ছে না। একের পর এক সেঞ্চুরি বা হাফ সেঞ্চুরি করছেন বিরাট, শ্রেয়স, শুভমন, কে এল রাহুল। উইকেটকিপার হিসাবে তো কে এল রাহুল তিনশ শতাংশ উন্নতি করেছেন। এর পিছনেও এনসিএ-র হাত আছে।

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

তবে একটা কথা না বললেই নয়, আইপিএল ভারতীয় ক্রিকেটারদের আরো পরিণত করেছে। তাদের মধ্যে জয়ের খিদে বাড়িয়েছে। আর বিশ্বের সব বড় ক্রিকেটারদের পাশে থাকা, তাদের বিরুদ্ধে খেলা, তাদের অনুশীলন দেখা, টিপস নেয়াটাও কম কাজে লাগছে না।

বুমরাহ আগে থেকেই ভয়ঙ্কর ছিলেন। চোট সরিয়ে ফিরে আসার পরেও একইরকম আছেন। সত্যিই পরিবর্তন হয়েছে মহম্মদ সিরাজের। তিনি ক্রমশ ক্ষুরধার হচ্ছেন। আর অবাক করে দিচ্ছেন মহম্মদ শামি। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে মাঠে নেমে কোনো পেসার যে ভারতের পিচে এতটা ভয়ংকর হতে পারেন, তা না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এর পিছনে শামির কৃতিত্ব সর্বাধিক। আরো একজনের অবদানও আছে। তিনি হলেন বোলিং কোচ ভরত অরুণ। তিনি প্রচারের বাইরে থেকে নীরবে কাজ করেন। বোলারদের যেভাবে তিনি পরিচালিত করেছেন তা অসাধারণ।

ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলতে শুরু করেছেন, ভারতের এই টিমটা ২০০৩ সালের অস্ট্রেলিয়ার মতো। অস্ট্রেলিয়ার সেই টিমে ছিলেন, পন্টিং, হেডেন, গিলক্রিস্ট, বিভান, লেহম্যান, শ্যেন ওয়াটসন, সিমন্ডস, ম্য়াকগ্রা, ব্রেট লি, গিলেপসি, ওয়ার্নরা। ক্রিকেটারদের নাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই টিম সব অর্থেই অসাধারণ ছিল।

ভারতের এই টিম ওই পর্যায়ে যাবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে পারফরমেন্স, দায়বদ্ধতা, আত্মবিশ্বাস, লড়াই, দলগত সংহতি, ফিটনেস ও জয়ের খিদের হিসাবে এই টিম অনেকেরই আগে আছে। পুরো টিমটাই চেগে আছে। আগে বিরাট কোহলিকে মাঠে সবচেয়ে আবেগতাড়িত ও আক্রমণাত্মক লাগত। এই বিশ্বকাপে কোহলি বরং অনেক ফুরফুরে মেজাজে আছেন। তুলনায় রহিত অনেক বেশি আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছেন। তাকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছেন সিরাজরা।

রোহিতরা শেষ হাসি হাসতে পারবেন নাকি, তারা কাপ জেতার একধাপ আগে থেমে যাবেন জানি না। শুধু এটুকুই জানি, তারা স্বপ্নের ক্রিকেট খেলছেন। এরকম খেলা দেখতেই মানুষ মাঠে যান, টিভি-র পর্দায় চোখ রেখে বসে থাকেন। একটা টুর্নামেন্টে একের পর এক তাবড় প্রতিদ্বন্দ্বীকে তারা যেভাবে হেলায় হারিয়েছেন এবং ক্রিকেট-ভক্তদের আনন্দ দিয়েছেন, তাই বা কম কীসে। তারা এখন ক্রিকেটের সুপারস্টার হয়ে গেছেন।

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

বাংলাদেশ