বিশ্বকাপ কাতারে, খুনোখুনি বাংলাদেশে
১৭ ডিসেম্বর ২০২২এইসব সংঘাত-সংঘর্ষ আর হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে দুই ল্যাটিন অ্যামেরিকান দল আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের সমর্থকদের মধ্যে৷ ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিলেও সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা কমেনি৷ এখন ব্রাজিল সমর্থকরা উত্তেজনা ছড়াচ্ছেন আর্জেন্টিনা-বিরোধিতা জিইয়ে রেখে৷ আর আর্জেন্টিনার সমর্থকরা তো আছেনই৷
বিশ্লেষক এবং অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সামাজিক এবং নাগরিকদের মানসিক অবস্থার প্রতিফলন ঘটছে৷ কোনো দেশের উগ্র সমর্থককে আবার কোনো বিশ্লেষক উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চারণ বলেও মনে করছেন৷ সবার উপরে জাতীয় পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের অভাব হিসেবেও দেখছেন৷ দেখছেন আবেগ নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতার অভাব হিসেবে৷ এটাও সামাজিক পরিস্থিতির কারণে হয়েছে বলে মনে করছেন সমাজ বিশ্লেষকরা৷
বিশ্বকাপে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের জেরে তিনটি হত্যার ঘটনা ঘটেছে ৯ ডিসেম্বর রাতে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়ার কোয়ার্টার ফাইনাল ম্যাচকে কেন্দ্র করে৷ এর একটি হয়েছে ঢাকার অদূরে সাভার উপজেলায় ,একটি হবিগঞ্জের বাহুবলে. আরেকটি বাগেরহাটে৷ হবিগঞ্জে ছেলের সঙ্গে তর্কের জেরে তার বাবাকে পিটয়ে হত্যা করা হয়৷ পুলিশের তদন্ত জানাচ্ছে, পূর্ব শত্রুতার জেরে খেলাকে ইস্যু করে এই হত্যার ঘটনা ঘটে৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে এখনো ট্রেডিশনাল সমাজের উপাদান বিদ্যমান৷ আর এখানকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক৷ তার প্রতিফলন আমরা খেলার উত্তেজনায়ও দেখতে পাচ্ছি৷’’
আর সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মো. তৌহিদুল হক মনে করেন, ‘‘বিরুদ্ধ মত না মানার, সম্মান না করার যে প্রবণতা আমাদের মধ্যে আছে, তারই প্রতিফলন আমরা খেলার পক্ষ-বিপক্ষের মধ্যেও দেখতে পাচ্ছি৷’’
আসল কারণ পূর্ব শত্রুতা
৯ ডিসেম্বর হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় ফুটবল খেলা নিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মধ্যে তর্কাতর্কির জেরে আব্দুস শহীদ (৫০) নামের এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত ৯ ডিসেম্বর ব্রাজিলের খেলা চলাকালীন আব্দুস শহীদের ছেলে আর্জেন্টিনা সমর্থক রোকন মিয়ার সঙ্গে একই গ্রামের টেনু মিয়ার ছেলে ব্রাজিল সমর্থক সজিব মিয়ার বাকবিতন্ডা হয়৷ বিষয়টি হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ায়৷ এক পর্যায়ে স্থানীয়রা বিষয়টি মীমাংসাও করে দেন৷ কিন্তু একদিন পরে ১০ ডিসেম্বর সকালে রোকনের বাবা আব্দুস শহীদকে একা পেয়ে প্রতিপক্ষের লোকেরা বেধড়ক মারধর করে মেরেই ফেলে৷ তবে পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, খেলাকে কারণ হিসেবে দেখানো হলেও আসলে পুর্ব শত্রুতার কারণেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে৷ পুলিশ জানায়, বাহুবল উপজেলার সাতকাপন ইউনিয়নের আদিত্যপুর গ্রামের শহীদ মিয়ার বাড়ির সীমানা নিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত লোকজনের বিরোধ চলছিল৷ ওই বিরোধের জেরে প্রতিপক্ষ বিভিন্ন সময় শহীদ মিয়া ও তার পরিবারের লোকজনকে হয়রানি করছিল, নানা রকমের হুমকিও দিচ্ছিল৷
সমর্থনের নামে আরো যত হত্যা
৯ ডিসেম্বর রাতেই সাভারের ডগরমোড়া এলাকার একটি চায়ের দোকানে ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়ার খেলা দেখেতে যান হাসান মিয়া (২৬)৷ খেলা শেষে রাত ১২টার দিকে ম্যাচের ফলাফল নিয়ে ওই দোকানে থাকা কয়েকজন তরুণের সঙ্গে তর্কে জড়ান হাসান৷ বাকবিতণ্ডার মধ্যেই ওই তরুণেরা হাসানকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান৷ তাকে উদ্ধার করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন৷
একই দিন রাতে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে ছুরিকাঘাতে টুটুল হাওলাদার (১৬) নামে এক কিশোরকে হত্যা করা হয়৷ স্থানীয়রা জানান, মোড়েলগঞ্জের গুলিশাখালি সমাদ্দার বাজারে স্থানীয়রা টিভির পর্দায় ব্রাজিল বনাম ক্রোয়েশিয়ার খেলা দেখার সময় টুটুল হাওলাদারের সঙ্গে রুবেল সমাদ্দারের বাকবিতণ্ডা হয়৷ এক পর্যায়ে রুবেল সমাদ্দার টুটুল হাওলাদারকে ছুরিকাঘাত করলে হাসপাতালে নেওয়ার পর টুটুলের মৃত্যু হয়৷
৬ ডিসেম্বর ভোলার সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের চেউয়াখালী গ্রামে আর্জেন্টিনা ফুটবল দলের সমর্থকদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে মো. হৃদয় (২০) নামের এক তরুণ নিহত হন৷ ৩ ডিসেম্বর আর্জেন্টিনা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচের আগে নুডলস খাওয়ার আয়োজন নিয়ে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের দুটি পক্ষের সংঘর্ষ হয়৷ এর জের ধরে ৬ ডিসেম্বর রাতে আবার সংঘর্ষ বাধলে প্রতিপক্ষের হামলায় হৃদয় মারা যান৷
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় চাঁদপুরে সদর উপজেলার বাগাদী ইউনিয়নের নানুপুর আমিন বেপারিবাড়ির সামনে বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা নিয়ে বাকবিতণ্ডার জেরে বন্ধুর হাতে বন্ধু খুন হয়৷ পুলিশ ও স্থানীয়রা জানায়, দশম শ্রেণির ছাত্র মেহেদীকে (১৬) ছুরিকাঘাত করে খুন করেন একই এলাকায় তার বন্ধু বরকত (২০)৷
এর বাইরে সাত জন প্রিয় দলের পতাকা ওড়াতে গিয়ে এবং দুই জন হৃদযন্ত্রের ক্রিয় বন্ধ হয়ে মারা গেছেন৷ হামলার মধ্যে বাড়িঘরে আগুন দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে৷
কেন এই পরিস্থিতি
বিশ্লেষকরা বলছেন, খেলা নিয়ে এই সংঘাতের ঘটনা অন্য দেশেও হয়৷ কিন্তু বাংলাদেশে প্রতি বিশ্বকাপেই হয়৷ এমনকি সংঘাতের আশঙ্কায় খোলা মাঠে বড় পর্দায় বিশ্বকাপের খেলা দেখানোও এখানে বন্ধ রাখতে হয়েছে৷ এই আশঙ্কা রাজনৈতিক দিক দিয়ে ছিল৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমেদ এটাকে ব্যখ্যা করেন উগ্র জাতীয়তাবাদের দৃষ্টিকোণ হিসেবে৷ তিনি বলেন, ‘‘কোনো এক দলের সমর্থক ওই দলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান৷ আর সেটা যখন উগ্র সমর্থনে রূপ নেয়, তখন সংঘাত হয়৷ কারণ, সে তখন তার দলকেই শ্রেষ্ঠ মনে করে৷ অন্যের মতামতকে সম্মান, পরমত সহিষ্ণুতা তার মধ্যে থাকে না৷ আমিই শ্রেষ্ঠ এই চিন্তার প্রতিফলন হলো সংঘাত৷’’
আর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘‘আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শিক্ষা না থাকায় এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে৷’’ তার কথা, ‘‘এটা নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে আসে৷ রাষ্ট্রের সংস্কৃতি যদি হয় সংঘাত ও দমনমূলক তাহলে নাগরিকদের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটে৷’’
তিনি মনে করেন, ‘‘এখানে সংবাদ মাধ্যমকেও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে৷ এই ঘটনাগুলো ফলাও করে প্রচার করলে তা সঞ্চারিত হয়৷’’
অধ্যাপক জিয়া রহমান মনে করেন, ‘‘আইনের শাসনের অভাব থাকলে এটা হবে৷ আর সে কারণেই খেলাকে অজুহাত করে পূর্ব শত্রুতার জেরে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে৷’’