বিশ্বজুড়ে হাম-এর প্রকোপ বৃদ্ধি বিশেষজ্ঞদের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। টিকা কর্মসূচির কারণে প্রায় নির্মূল হতে বসেছিল হাম৷ কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে হাম।
যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে হামের প্রাদুর্ভাব সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর বেশিছবি: Alfredo Estrella/AFP
বিজ্ঞাপন
ইয়েমেনে ২০২৫ সালের এপ্রিলে ১০ হাজারের বেশি এবং ভারতে সাত হাজারের বেশি হামে আক্রান্ত রোগী নথিভুক্ত করা হয়েছে৷ দেশটিতে শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হাম। হাম নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন।
আবার কেনো হামের সংক্রমণ বাড়ছে পড়ছে?
ইউরোপেও হাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে হামে আক্রান্ত ৮৭% রোগীই টিকা গ্রহণ করেননি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এর ইউরোপের পরিচালক হান্স ক্লুগে একে একটি 'ওয়েকআপ কল' বা ‘সতর্কতা সংকেত' হিসেবে অভিহিত করেছেন। টিকার বিষয়ে ভুল তথ্য এবং অসচেতনতার কারণেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী টিকাদান কর্মসূচি ২০০০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে প্রায় ছয় কোটি মানুষের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে।
তবে আশার কথা হলো, হাম একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ এবং এর কার্যকর প্রতিষেধক রয়েছে। এমএমআর (হাম, মাম্পস ও রুবেলা) টিকার দুটি ডোজ হামের সংক্রমণ এবং এর বিস্তার থেকে ৯৯ শতাংশের বেশি সুরক্ষা দিতে পারে।
ইউরোপে ‘হাম’ রোগের প্রকোপ বাড়ছে
হাম রোগের প্রকোপ বাড়ার কথা জানা যায় গতবছর প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি রিপোর্ট থেকে৷ অবশ্য চলতি বছরে সারা ইউরোপে হাম রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে গত বছরের চেয়েও বেশি৷ বিস্তারিত থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র ছ’মাসে...
২০১৮ সালের প্রথম ছ’মাসে ইউরোপে ৪২,০০০ মানুষ হামের ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন৷
ছবি: imago stock&people
টিকা না নেওয়ার কারণে
হামের বিরুদ্ধে টিকা না নেওয়াই হামে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও৷
ছবি: picture-alliance/dpa
জার্মানিতে টিকার হার
বর্তমানে জার্মানিতে হামের টিকা নেওয়ার হার শতকরা ৯৩ ভাগ৷
ছবি: Sean Gallup/Getty Images
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সতর্কবাণী
হাম ভাইরাস নিয়ে ২০১৭ সালেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবাণী দিয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/Keystone/U. Flueeler
ডাব্লিউএইচও-র লক্ষ্য হাম নির্মূল করা
ওয়ার্ল্ড হেল্থ অরগ্যানাইজেশন বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য হাম নির্মূল করা৷ অ্যামেরিকা মহাদেশ এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলিতে ইতিমধ্যেই এটি করতে সফল হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/Keystone/U. Flueeler
জার্মানি
হাম একটি ছোঁয়াচে রোগ৷ অনেক মা-বাবা এই রোগকে তেমন গুরুত্ব দেন না বলেই অনেক শিশু অন্যশিশুদের সাথে খেলার ফলে হামে সংক্রমিত হয়৷ তাই এ রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি, প্রয়োজন টিকা নেওয়াও৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Schlesinger
হামকে অনেকে তেমন গুরুত্ব দেন না
অনেকে মনে করেন, হাম তেমন ক্ষতিকর কোনো অসুখ নয়৷ তবে হাম সম্পর্কে জার্মানির রবার্ট কখ ইন্সটিটিউট জানায় যে, হাম থেকে মস্তিষ্কে সংক্রমণ পর্যন্ত হতে পারে৷ তবে তা হাজারে মাত্র একজনের হয়ে থাকে এবং এদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু ঘটে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
7 ছবি1 | 7
হার্ড ইমিউনিটি কী?
সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারী বিশেষজ্ঞ মাইকেল হেড বলেন, কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ৯৫ শতাংশের বেশি মানুষের মধ্যে টিকা গ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। একে 'হার্ড ইমিউনিটি' বলা হয়।
হার্ড ইমিউনিটি তখনই কাজ করবে যখন একটি গোষ্ঠীর বেশিরভাগ মানুষকে প্রতিষেধক দেয়া থাকবে। যেমন- হামের ক্ষেত্রে প্রতি ২০ জনের মধ্যে ১৯ জনকেই যদি প্রতিষেধক দেয়া যায় তাহলে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে হার্ড ইমিউনিটি গড়ে উঠবে।
হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হলে সমাজের যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করে, ফলে সংক্রমণ ছড়াতে পারে না। এর ফলে যারা টিকা নিতে অক্ষম, তারাও সুরক্ষিত থাকে।
টিকাদান কর্মসূচীর বাস্তবায়ন কম
ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি)-র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ইউরোপের অনেক দেশেই হাম নির্মূলের জন্য প্রয়োজনীয় নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি, এখনো সুপারিশকৃত স্তরের নিচে রয়েছে।
২০২৪ সালে, মাত্র চারটি ইউরোপীয় দেশ হামের টিকার দ্বিতীয় ডোজের ক্ষেত্রে ৯৫ শতাংশ বা তার বেশি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পেরেছে। এই তথ্য হামের বিরুদ্ধে সুরক্ষায় ইউরোপের সামগ্রিক দুর্বল চিত্র তুলে ধরে।
ইসিডিসি সতর্ক করে জানিয়েছে, হাম সহজেই সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে এবং যেসব কমিউনিটিতে মানুষ টিকা নেয়নি বা আংশিক টিকা নিয়েছে, সেখানে বড় আকারে প্রাদুর্ভাব ঘটাতে পারে।
টিকাবিরোধী প্রচারণা
তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের শিশুস্বাস্থ্য ও টিকাদান বিশেষজ্ঞ হেলেন বেডফোর্ড জানান, ‘‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমরা দেখেছি যে বিশ্বব্যাপী এই লক্ষ্য অর্জন করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন কারণে টিকাদান কর্মসূচিতে বাধা আসে, যার ফলে হার্ড ইমিউনিটি তৈরি করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়।''
টিকাদানের হার কমে যাওয়ার পেছনে কেবল অ্যান্টি-ভ্যাকসিন প্রচারণা একা দায়ী নয়। সম্প্রতি ২০২৫ সালের এপ্রিলে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে হামের প্রাদুর্ভাব সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং কিছু জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ওপর বেশি।গবেষণাটিতে উঠে এসেছে, এসব গোষ্ঠীর মধ্যে টিকার গ্রহণ মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম ছিল।
গবেষণাটিতে স্পষ্ট যে, টিকাদান কর্মসূচির সাফল্য শুধুমাত্র টিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার মোকাবেলা করার উপরই নির্ভরশীল নয়, বরং অন্যান্য সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগের অভাবের মতো বিষয়গুলোও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমনটি কোভিড-১৯ চলাকালীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর চাপ এবং টিকাদান কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াতের অসুবিধা হয়তো অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে টিকাদান প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করেছে।
হাম একটি অত্যন্ত সংক্রামক রোগ, যা সহজেই এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের মধ্যে ছড়াতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে টিকাকরণের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাগুলোর উন্নতির ওপর জোর দেওয়া এখন অপরিহার্য।
শিশুরোগের লক্ষণ চিনুন, মারাত্মক ক্ষতি থেকে দূরে থাকুন
প্রতিটি মা-বাবার কাছে সন্তানের সুস্থতার চেয়ে মূল্যবান বোধহয় আর কিছু নেই৷ তাই শিশুরোগের লক্ষণগুলো জানা থাকলে সন্তানের জীবন সহজ ও সুন্দর হতে পারে৷ ছবিঘরে থাকছে এ বিষয়েই বিশেষজ্ঞের দেওয়া কিছু পরামর্শ৷
ছবি: Fotolia
শিশুর টিকা
শিশুর জন্মের এক বছরের মধ্যে হুপিং কাশি, দিপথেরিয়া, টিটেনাস, পোলিও, হাম, মাম্স এবং জলবসন্তের টিকা ইত্যাদি অবশ্যই দিতে হবে৷ তাছাড়া আরো কিছু টিকা রয়েছে যেগুলো পরে কিশোর বয়সে আবারও নতুন করে দিতে হয়৷ শিশুর স্বাস্থ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রতিটি টিকাই নির্দিষ্ট সময়ে দেয়া প্রয়োজন৷ তবে এ বিষয়ে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K.J. Hildenbrand
রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
কিছু শিশুরোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে মারাত্মক৷ যেমন হাম৷ জার্মানির শিশু-কিশোর অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ডা. এসারের ভাষায়, ‘‘অনেকের ধারণা হাম ক্ষতি করে না৷ অথচ এটি একটি সংক্রমণ রোগ, যা নার্ভ বা স্নায়ু সিস্টেমকে আক্রমণ করতে পারে৷ হামের পর শতকরা ১০ জন শিশুর মস্তিষ্কের তরঙ্গে পরিবর্তন হয় আর অন্তত একজনের মাথায় থেকে যায় মানসিক ব্যাধির লক্ষণ৷
ছবি: imago stock&people
শিশুর জ্বর
প্রায়ই দেখা যায় কোনো অসুখ হওয়ার আগে শিশুদের জ্বর হয়৷ তাই জ্বরকে মোটেও হালকাভাবে নেয়া বা নিজে থেকে জ্বরের ওষুধ দেয়া কখনোই উচিত নয়৷ তবে এক শিশুর জ্বর হওয়ার আগে যদি তার বড় বা ছোট ভাই-বোনের ভাইরাস ঘটিত সংক্রমণ হয়ে থাকে, তাহলে দু-একদিন অপেক্ষা করা যেতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Agencia Estado
পান করতে না চাইলে
শিশুদের শরীরে তরল মজুদ রাখার সীমাবদ্ধতা রয়েছে৷ তাই শিশু জল বা অন্য কোনো পানীয় পান করতে না চাইলে, খুব তাড়াতাড়ি শিশুদের শরীরের ভেতরটা শুকিয়ে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে৷ তাই শিশু পান করতে না চাইলে বা অনেকটা সময় কোনো তরল পদার্থ পান না করে থাকলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত৷
ছবি: Fotolia/Zsolt Bota Finna
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন?
কথা না বলা, না হাঁটা, খেলা না করা বা কানে কম শুনছে মনে হলে খুব বেশি চিন্তা না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়াই স্রেয়৷ কারণ সব শিশু একই বয়সে একই কাজ করে না৷ কেউ হয়ত ১০ মাস বয়সেই হাঁটতে শুরু করে আবার কেউ ১৪ মাসেও হাঁটে না৷ তাছাড়া অনেক শিশু হামগুড়ি না দিয়েই হাঁটতে শুরু করে৷ এ বিষয়গুলো অনেক সময় বংশগত কারণেও হয়ে থাকে৷
ছবি: Fotolia/deber73
অযথা অসুখ খুঁজবেন না!
‘‘অকারণে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন না৷ তবে কোনো কিছু অন্যরকম মনে হলে বা কোনো দ্বিধা থাকলে প্রয়োজনে নিজের মা বা মুরুব্বিদের কাছ থেকে জেনে নিতে পারেন৷ সারাক্ষণ শিশুকে অসুস্থ মনে করলে বা সে কথা তাকে বললে, তা শিশুমনে প্রভাব ফেলে৷ এবং পরবর্তীতে শিশুকে তা সত্যিই মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলতে পারে৷’’ বলেন শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এসার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Schlesinger
নিজের মতো চলতে দিন
নিজের ৩১ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ডা. এসার বলেন, ‘‘ছোটখাটো ব্যাপারে শিশুকে বিরক্ত না করে, তাকে তার মতো চলতে এবং অন্য শিশুদের সাথে খেলতে দিন৷ খেলার মধ্য দিয়ে শিশুদের ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে, ওরা হয় ওঠে আত্মবিশ্বাসী৷ লক্ষ্য রাখুন শিশুর আগ্রহ কোন দিকে৷ কারণ বেশি জোড় করলে শিশু মনে তার প্রভাব পড়ে এবং মনোজগতে ক্ষতচিহ্ন থেকে যায়৷’’
ছবি: Fotolia/Fotofreundin
মানসিক দ্বন্দ্ব থেকে দূরে রাখুন
একটা শিশু কিন্তু বুঝতে পারে না, কী কারণে তার মা অন্যের সাথে টেলিফোনে বা সরাসরি বাবার বদনাম বা সমালোচনা করছেন৷ শিশুরা এ সব নিয়ে কোনো প্রতিবাদ বা আলোচনা করতে পারে না ঠিকই, তবে শিশুমনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং এর ফলে সৃষ্টি হয় মানসিক দ্বন্দ্ব৷ তাই দাম্পত্য কলহ কখনই শিশুদের সামনে নয়! মা-বাবার ঝগড়া সন্তানের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে৷