বাঁকুড়ার টেরাকোটা থেকে ডোকরার পুতুল, কালীঘাটের পট থেকে নয়াগ্রামের পটচিত্র, জয়নগরের মোয়া থেকে বর্ধমানের মিহিদানা – এগুলিও এবার প্রতিনিধিত্ব করবে পশ্চিমবঙ্গের৷ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্ন সেটাই৷
বিজ্ঞাপন
ভারতে কলকাতা বিমান বন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবনটির কাজ এগোচ্ছিল ঢিমে তালে৷ একে তো সারা দেশের মধ্যে একমাত্র কলকাতার নতুন টার্মিনালের কাজই দীর্ঘদিন স্থগিত হয়ে ছিল বামপন্থি কর্মী ইউনিয়নের লাগাতার বিরোধিতায়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই প্রথম যে কটি বকেয়া কাজ দ্রুত শেষ করতে জোর দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একটি হলো কলকাতা বিমানবন্দরের আধুনিকীকরণ এবং নতুন টার্মিনাল ভবনটি চালু করা৷ সেই সময় অনেকেই নতুন মুখ্যমন্ত্রীর এই হঠকারিতার সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো কিছুকেই আমল দেননি৷
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত ‘জয়নগরের মোয়া’
শীত আসছে৷ তাই আবার উচ্চারিত হচ্ছে ‘জয়নগরের মোয়া’র নাম৷ ছবিঘরে ঢুকে জেনে নিন মজাদার এই মোয়া তৈরির বৃত্তান্ত৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
কণকচূড় ধানের খই
জয়নগরের মোয়ার অন্যতম প্রধান উপাদান কণকচূড় ধানের খই, যা এখনও প্রথাগত পদ্ধতিতেই ঝাড়াই-বাছাই করা হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
খেজুরের রসে মোয়া
মোয়ার দ্বিতীয় উপাদান হলো ‘নলেন গুড়’, যা অত্যন্ত যত্ন নিয়ে খেজুরের রস জাল দিয়ে তৈরি করতে হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
‘শিউলি’
খেজুর গাছ কেটে রস সংগ্রহ করেন যাঁরা, তাঁদের চলতি কথায় বলা হয় ‘শিউলি’ - এঁরা গাছ বাইতে ওস্তাদ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
‘নলেন গুড়’
খেজুর গাছের মাথার দিকে, গুঁড়ির গায়ে চিরে দিয়ে, তার তলায় বাঁধা হয় মাটির হাঁড়ি - সরু নল দিয়ে রস এসে জমা হয় হাঁড়িতে৷ এই নলের কারণেই নাম ‘নলেন গুড়’৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
গাছের গায়ের দাগ
খেজুর গাছের গায়ে কাটার দাগ পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায় - যে গাছের গায়ে যত বেশি দাগ, ধরে নিতে হবে, সেই গাছের রস তত বেশি মিষ্টি৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
জ্বালানি কাঠের ঢিমে আঁচের মোয়া
গুড় জাল দেওয়ার জন্য দরকার হয় কাঠের ঢিমে আঁচ - সেই জ্বালানি কাঠ শীতকাল শুরু হওয়ার আগেই মজুত রাখতে হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মোয়ার মণ্ড
নলেন গুড়ের সঙ্গে কণকচূড় ধানের খই মিশিয়ে, ঘন করে পাক দিয়ে তৈরি হয় জয়নগরের মোয়ার মণ্ড৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ঘি মেখে তৈরি মোয়া
গাওয়া ঘি দু হাতে মেখে, গোল গোল করে পাকিয়ে তৈরি করা হয় মোয়া৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
ক্ষীরের মোয়া
স্বাদ বাড়ানোর জন্য তার সঙ্গে যুক্ত হয় খোয়া ক্ষীর, কাজুবাদাম, কিশমিশ৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
সর্বত্র পাওয়া যায় এই মোয়া
কখনও হাঁড়িতে, কখনও রঙচঙে প্যাকেটে ভরে জয়নগরের মোয়া চলে যায় রাজ্যের সর্বত্র৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
10 ছবি1 | 10
ঠিক যেমন পশ্চিমবঙ্গ তথা মুখ্যমন্ত্রীর সাধের ‘ব্র্যান্ড বেঙ্গল'-কে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে তুলে ধরতে জনপ্রিয় বলিউড ফিল্মস্টার শাহরুখ খানকে রাজ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করার সিদ্ধান্তও বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হয়েছিল৷ ভারতের টিভি, রেডিও আর খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে তখন পশ্চিম ভারতের গুজরাট রাজ্যের হয়ে প্রচার করছেন আর এক মেগা ফিল্মস্টার অমিতাভ বচ্চন৷ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত তার থেকেই আইডিয়াটা পেয়েছিলেন এবং হাজার সমালোচনা সত্ত্বেও আইপিএল ক্রিকেটের ফাইনাল থেকে কলকাতা আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভাল, সর্বত্র শাহরুখ খান প্রোমোট করে গেছেন এই ব্র্যান্ড বেঙ্গলকে৷
সেই উদ্যোগেরই আর একটি ফসল, কলকাতা বিমানবন্দরের নতুন টার্মিনাল ভবনে ‘বিশ্ব বাংলা' নামে একটি কাউন্টার, যেখানে একই ছাদের তলায় মিলবে ঐতিহ্যগতভাবে যা কিছু বাংলার, বাঙালির, সেই সব জিনিসই৷ পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত শান্তিপুরী বা ধনেখালি তাঁতের শাড়ি, মহার্ঘ জামদানি বা আরও মহার্ঘ রেশমবস্ত্র, মুর্শিদাবাদের সিল্ক থেকে বিষ্ণুপুরি বালুচরী, বাটিকের কাজ থেকে কাঁথার কাজ, পোড়ামাটি. ডোকরা থেকে শুরু করে হাতির দাঁতের কাজ, কৃষ্ণনগরের ঘূর্নির বিখ্যাত পুতুল, পাটের কাজ, পটচিত্র, কালীঘাটের পট, ইত্যাদি সবই দেখা এবং কেনার সুযোগ মিলবে প্রায় দেড় হাজার বর্গফুট জায়গা জুড়ে তৈরি এই ‘বিশ্ব বাংলা'-য়৷
হস্তশিল্প ছাড়াও বিশ্ব বাংলায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের বিখ্যাত সব খাবার৷ তার মধ্যে বর্ধমানের সীতাভোগ-মিহিদানা বা জয়নগরের মোয়া যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে কালিম্পংয়ের চিজ, দার্জিলিংয়ের চা, কৃষ্ণনগরের সরভাজা-সরপুরিয়া, মালদার আমসত্ত আর কাসুন্দি, সুন্দরবনের এবং ডুয়ার্সের মধু৷ এছাড়া উত্তরবঙ্গের রায়গঞ্জের তুলাইপাঞ্জি চাল বা মরশুমি নলেন গুড়ের মতো জিনিসও থাকবে৷ আন্তর্জাতিক গুণমান নিশ্চিত রেখে এইসব জিনিস সংগ্রহ করা হবে তাদের নিজস্ব অঞ্চল থেকে৷
দার্জিলিংয়ের ঐতিহ্যবাহী ‘টয় ট্রেন’
দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত৷ টয় ট্রেনের ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখলে মনে হয় যেন একটা মিউজিয়াম, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, এক সময় যা সারা বাংলার গর্ব ছিল৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে
আদত নামটা এমন হলেও, পর্যটক এবং স্থানীয় মানুষজন আদর করে ডাকেন ‘টয় ট্রেন’৷ এই ট্রেন ইউনেসকো ঘোষিত একটি ঐতিহ্যবাহী রেলওয়ে হিসেবে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত৷ আগে এই টয় ট্রেন চলত নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত৷ এখন অবশ্য তার যাত্রা সীমাবদ্ধ দার্জিলিং আর ভারতের সর্বোচ্চ রেলস্টেশন ঘুম-এর মধ্যে, দিনে চারবারের জয় রাইডে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
বাষ্পচালিত ইঞ্জিন
কাজেই টয় ট্রেনের বাষ্পচালিত ইঞ্জিনগুলো এখন কার্যত অবসর জীবন কাটায় দার্জিলিংস্টেশনের লাগোয়া লম্বা এক শেডের তলায়৷ যদিও মাঝেমধ্যে জয় রাইডে যাওয়ার জন্য এদেরও ডাক পড়ে৷
ছবি: DW/Zeljka Telisman
সচল ওয়ার্কশপ
দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ের নিজস্ব কারিগরি বিভাগের কর্মীরা তাই রোজই এই ওয়ার্কশপে আসেন, ব্যস্ত থাকেন মেরামতিতে, যাতে ইঞ্জিনগুলো সচল থাকে৷টয় ট্রেনের বিরাট ওয়ার্কশপটাকে এখন দেখে মনে হয় যেন এক মিউজিয়াম, যেখানে সংরক্ষিত আছে ইতিহাস আর ঐতিহ্য, যে ঐতিহ্য দার্জিলিং তো বটেই, সারা বাংলার গর্ব ছিল এক সময়৷
ছবি: S. Bandopadhyay
প্রবীণ কারিগর
এই প্রযুক্তি-কর্মীদের অনেকেই ডিএইচআর-এ বহু বছর ধরে কাজ করছেন৷ যেমন এই প্রবীণ মুসলিম কারিগর, যিনি তাঁর অধস্তন এক ছোকরা মেকানিককে বকাবকি করছিলেন যে তারা কোনো কাজ ঠিকঠাক করতে পারে না৷ তাতে সবারই নাম খারাপ হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
যেন জুল ভার্নের কল্পকাহিনি
কিন্তু আসল সমস্যা আদ্যিকালের এইসব ইঞ্জিনের পুরনো যন্ত্রাংশ৷ টয় ট্রেনের চালকের ঘরটা দেখলে মনে হয়, যেন সোজা জুল ভার্নের কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি থেকে উঠে এসেছে৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
মান্ধাতা আমলের যন্ত্রাংশ
যন্ত্রপাতিগুলো দেখতে নেহাতই সহজ-সরল হলেও সবই অতি পুরনো, মান্ধাতার আমলের৷ ফলে এগুলোকে সারানো বা এর যন্ত্রাংশ জোগাড় করাটাই কারিগরদের জন্যে আজকাল মস্ত বড় সমস্যা৷ কাজেই একাধিক বাষ্পচালিত ইঞ্জিন আজকে স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ওয়ার্কশপে৷ যদি কোনোভাবে তাদের সারিয়ে তোলা যায়, সেই অপেক্ষায়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
রোজকার দৌড়
তবে কিছু ইঞ্জিন এখনও রোজ নিয়ম করে রেল লাইনের উপর দিয়ে ছুটতে বের হয়৷ পাহাড়ি রাস্তায় পাতা ন্যারো গেজ রেললাইন ধরে তারা এঁকে-বেঁকে দৌড়ায়, নিজেদের ফিট রাখে৷ কে জানে, কখন কী কাজের ডাক আসে!দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গা ঘামানোর মতো ইঞ্জিনগুলোর থেকে ধোঁয়া বেরোয়, কলকব্জার ধাতব আওয়াজ হয় সারা শরীর জুড়ে৷ যেন পাহাড়ি রাস্তায় ছুটতে যাবে বলে সবাই খুব উত্তেজিত৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
নামেই যায় চেনা
টয় ট্রেনের সব ইঞ্জিনেরই একটা করে নাম আছে৷ আর সেই নামগুলো কোনো না কোনো শক্তিধর প্রাণীর নামে৷ খাড়াই রাস্তায় আস্ত একটা ট্রেন টেনে নিয়ে যাওয়ায় এদের যে বিক্রম, সম্ভবত তা-ই বোঝাতে৷কখনও ইঞ্জিনের নাম দাঁতাল হাতির নামে, ‘টাস্কার’৷ কখনও হিমালয়ের পরাক্রমশালী ঈগল পাখির নামে তার নাম৷ এখনও খুব যত্ন নিয়ে পিতলের নাম-ফলকগুলো ঘষে-মেজে চকচকে রাখা হয়৷
ছবি: DW/S. Bandopadhyay
8 ছবি1 | 8
পশ্চিমবঙ্গ ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তরের পরিকল্পনায় এইরকম আরও তিনটি বিশ্ব বাংলা শোরুম আছে, যেগুলি হবে মধ্য কলকাতার পার্ক স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড এবং দক্ষিণাপণ শপিং কমপ্লেক্সে৷ ক্রমশ এই শোরুম ছড়িয়ে দেওয়া হবে দিল্লি, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোরের মতো ভারতের অন্যান্য বড় শহরের বিমানবন্দরগুলিতে৷ অদূর ভবিষ্যতে অ্যামেরিকা, ক্যানাডা এবং ইওরোপের বিভিন্ন বিমানবন্দরে, সিঙ্গাপুর ও ব্যাংককেও এমন শোরুম চালু করতে আগ্রহী সরকার৷
ব্র্যান্ড বেঙ্গল-কে তুলে ধরার এই উদ্যোগের পাশাপাশিই এসেছে সুখবরটা যে, পশ্চিমবঙ্গ ভিত্তিক ৩৫টি ব্র্যান্ড রয়েছে ভারতের সেরা ১০০০টি ব্র্যান্ডের তালিকায় এবং সবকটিই রয়েছে প্রথম ২৫০টি ব্র্যান্ডের মধ্যে৷ মুম্বইয়ের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটের ঠিক করে দেওয়া মাপকাঠির ভিত্তিতে ভারতের ট্রাস্ট রিসার্চ অ্যাডভাইসারি সংস্থা সম্প্রতি সমীক্ষা চালিয়ে চলতি ২০১৪ সালের যে ব্র্যান্ড ট্রাস্ট রিপোর্ট তৈরি করেছে, তাতেই ওই ৩৫টি ব্র্যান্ডের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-সম্ভাবনার ঘুরে দাঁড়ানোর এই ছবি ধরা পড়েছে৷ এই ৩৫টি ব্র্যান্ডের প্রতিটিই পশ্চিমবঙ্গ থেকে সারা ভারতে এবং কখনও কখনও আন্তর্জাতিক স্তরেও সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা করছে৷ এদের মধ্যে ১৫টি ব্র্যান্ড এই প্রথম ব্র্যান্ড ট্রাস্ট রিপোর্টে জায়গা পেল, বিভিন্ন নামজাদা বহুজাতিক পণ্য ব্র্যান্ডের সঙ্গে রীতিমত পাল্লা দিয়ে৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্র্যান্ড বেঙ্গলের পক্ষে সেটা নিঃসন্দেহে সুখবর৷