‘বিশ্ববাসীকে সংস্কৃতির গুরুত্ব বোঝানোর মাধ্যম প্রত্নতত্ত্ব’
সমীর কুমার দে ঢাকা
৩ এপ্রিল ২০১৭
‘‘শুধু জাতির জীবনে নয়, সংস্কৃতির মূল ঐতিহ্যই হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব৷ আমাদের সংস্কৃতি কত পুরনো – তা বিশ্ববাসীকে জানানোর একমাত্র মাধ্যম প্রত্নতত্ত্ব৷’’ ডয়চে ভেলেকে বলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলতাফ হোসেন৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে: বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাংগঠনিক কাঠামো ক'টি?
আলতাফ হোসেন: সব অধিদপ্তরের একটি সাংগঠনিক কাঠামো থাকে৷ সে হিসেবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরেরও একটিই সাংগঠনিক কাঠামো৷ তবে ডিভিশন আছে চারটি৷ একটি বগুড়ায়, একটি খুলনায়, একটি কুমিল্লায় ও একটি ঢাকায়৷
বর্তমানে প্রকল্প আছে কতগুলো?
এই মুহূর্তে একটি প্রকল্পও নেই৷ একটি ছিল সাউথ এশিয়ান টুরিজম প্রোজেক্ট৷ সেটা গত ডিসেম্বরে শেষ হয়েছে৷ এই প্রকল্পের আওতায় আমরা চারটি বড় কাজ করেছি৷ একটি হলো আমাদের ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ যে দু'টি জায়গা আছে – পাহাড়পুর ও ষাটগম্ভুজ মসজিদ – সেখানে আমরা কাজ করেছি৷ সেই সঙ্গে মহাস্থানগড় ও কান্তজিউ মন্দিরে পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য কিছু কাজ করেছি আমরা৷ আগামী জুলাই থেকে আরো একটি প্রকল্প শুরু হবে৷ এছাড়া ছোট ছোট কিছু কর্মসূচি আছে৷
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের গেজেটভুক্ত পুরাকীর্তির সংখ্যা কত এবং জাদুঘর কতগুলো?
গেজেটভুক্ত পুরাকীর্তির সংখ্যা এখন ৪৫৫টি আর জাদুঘর আছে ১৭টি৷ এর মধ্যে বেশ কিছু আছে অনেক পুরনো জাদুঘর, যেগুলো ১৯৬৪-১৯৬৫ সালে তৈরি হয়৷ যেমন পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় এবং ময়নামতির জাদুঘরগুলো অনেক পুরনো৷
Interview of DG Archeology Directorate Altaf Hossion - MP3-Stereo
জাতির জীবনে পুরাকীর্তির গুরুত্ব কী?
আমাদের সংবিধানের ২৩ ও ২৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে হবে৷ শুধু জাতির জীবনে নয়, সামাজিক জীবনে নয়, আমাদের সংস্কৃতির মূল ঐতিহ্যই হচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব৷ বিশ্ববাসীকে বা দেশবাসীকে যদি জানাতে হয় আমাদের সংস্কৃতি কত পুরনো, তাহলে তার একটাই মাধ্যম৷ আর সেটা হলো প্রত্নতত্ত্ব৷ ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে বলি৷ ধরুন পুণ্ডবর্ধন, যেটা আমাদের রাজধানী ছিল৷ সেই সময়টা বিশ্লেষণ করে দেখলে বোঝা যাবে যে, তৎকালীন রাজা তাঁর জনগণকে বলছেন – ‘তোমরা তোমাদের গোলার ধান কৃষকদের দিয়ে দাও, কারণ মহামারি লেগেছে৷ আবার ফসল ভালো হলে আমি তোমাদের গোলা ভরে দেবো৷' এটা কিন্তু আজ থেকে দু'হাজার বছর আগের কথা৷ শুধু এটা নয়, আমরা যেখানেই খনন করছি, এখন যেমন ওয়ারিতে খনন করছি, সেখানে আমরা খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৬০০ বছর পুরনো নিদর্শন পাচ্ছি৷
প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও খননে কি আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়?
বেশ কয়েকটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়৷ কখনও পুরনো পদ্ধতি, আবার কখনও আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়৷ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আমরা আধুনিক পদ্ধতির দিকে যাচ্ছি৷ মনে রাখতে হবে, আমরা মাটির নীতে যেসব পাচ্ছি – মানে ইটের, টালির বা ছোট ছোট পাথরের জিনিস – সেগুলো সংরক্ষণ করাটা কঠিন৷ কারণ আমাদের দেশে পানির লেভেল অনেক ওপরে৷ খনন করার কিছুদিন পরই বর্ষকালে এগুলোতে পানি উঠে যায়৷ এতে এগুলো নষ্ট হতে পারে৷ তবে উত্তর ভারতে এই ধরনের সমস্যা নেই৷ কারণ সেখানে যে প্রত্নতত্ত্ব পাওয়া যায়, সেগুলো পাথরের৷ কয়েক হাজার বছর আগে সেখানে পাথর দিয়েই কাজ হতো৷ কিন্তু আমাদের কোনো পাথরের কাজ নেই৷ এখানে যে কাজগুলো হয়েছে, সেগুলো ইটের৷ ইটের সঙ্গে হয় কাদামাটি বা চুন-সুরকির৷ ফলে এগুলো সংরক্ষণ করতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো পদ্ধতি ব্যবহার করতে হয়৷ যেটা কাদামাটি, সেটা কাদামাটি দিয়েই সংরক্ষণ করতে হবে৷ তা না হলে সঠিকভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক সংরক্ষণ হবে না৷
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তালিকায় বাংলাদেশের কতগুলো স্থান রয়েছে?
বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কয়েক রকমের হয়৷ একটি স্পর্শযোগ্য এবং আরেকটি অস্পর্শযোগ্য বা মনোগত সাংস্কৃতির ঐতিহ্য৷ আরেকটি আছে ন্যাচারাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷ বাংলাদেশে স্পর্শযোগ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আছে দু'টি৷ একটি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার এবং আরেকটি বাগেরহাটের মসজিদ শহর৷ ১৯৮৫ সালে এটি বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়৷ এরপর ১৯৯৯ সালে যে সম্ভব্য তালিকা হয়েছে, সেখানে পাঁচটি আছে৷ আর আমাদের ন্যাচারাল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হলো সুন্দরবন৷ অস্পর্শযোগ্য বা মনোগত সাংস্কৃতির ঐতিহ্য হলো লালন, জামদানি ও মঙ্গল শোভাযাত্রা৷
কেমন আছে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা৷ তবে বেশিরভাগ স্থাপনাই যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে৷ আর যেগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেগুলো নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ৷
ছবি: DW/M. Mamun
রূপলাল হাউস
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তৈরি হওয়া সুরম্য এই অট্টালিকাটি এখন খুঁজে পাওয়াই কষ্টকর৷ পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীদের দখলে যাবার পর রূপলাল হাউস ধ্বংসের গোড়ায় পৌঁছেছে৷ ফরাশগঞ্জের স্বরূপ চন্দ্রের দুই পুত্র রূপলাল দাস এবং রঘুনাথ দাস ১৮৪০ সালে এক আর্মেনীয় ব্যবসায়ীর কাছ থেকে পুরোনো একটি ভবন কেনেন৷ পরে কলকাতার স্থপতি নিয়োগ করে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে রূপলাল হাউসের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন তাঁরা৷
ছবি: DW/M. Mamun
আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা আহসান মঞ্জিলকে এখন বুড়িগঙ্গা থেকে দেখাই যায় না৷ এর সামনে বসে ফলের বাজার৷ সম্মুখভাগে তাই টিনের বেড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ ১৮৩০ সালে ঢাকার নবাব খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের কাছে থেকে পুরনো একটি ভবন কিনে নেন৷ ১৮৭২ সালে নবাব আব্দুল গণি এটিকে নতুন করে নির্মাণ করে তাঁর ছেলে খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় কাটরা
পুরান ঢাকার চকবাজারে মুঘল আমলের গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনাও সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে৷ সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজার নির্দেশে ১৬৪১ খ্রিষ্টাব্দে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই ইমারতটি নির্মাণ করা হয়৷ বর্তমানে একটি মাদ্রাসা হয়েছে৷ বেশ কিছু ব্যবসায়ী এ ভবনটি দখল করে আছে৷ স্থাপত্য সৌন্দর্যের বিবেচনায় একসময়ে বড় কাটরার সুনাম থাকলেও বর্তমানে এর ফটকটি যেন ভগ্নাবশেষ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছোট কাটরা
ঢাকার চকবাজারে বড় কাটরার কাছেই আরেক ঐতিহাসিক স্থাপনা ছোট কাটারা৷ শায়েস্তা খানের আমলে আনুমানিক ১৬৬৩ থেকে ১৬৬৪ সালের দিকে এই ইমারতটির নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা শেষ হয় ১৬৭১ সালে৷ দেখতে অনেকটা বড় কাটরার মতো হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটরার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটরা৷ সংরক্ষণের অভাবে বর্তমানে মুঘল আমলের এ স্থাপনাটিও ধ্বংসপ্রায়৷
ছবি: DW/M. Mamun
হাজী শাহবাজ মসজিদ
ঢাকার রমনা এলাকায় হাইকোর্টের পিছনে হাজী শাহবাজ মসজিদ সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি৷ কিন্তু এর পেছনের অংশে আলাদা লোহার ফ্রেম বসানো হয়েছে ছাউনি দেওয়ার জন্য৷ যার ফলে স্থাপনাটির সৌন্দর্য হানি হয়েছে৷ মুঘল শাসনামলে শাহজাদা আযমের সময়কালে ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এ মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন কাশ্মীর থেকে বাংলায় আসা ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজী শাহবাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোয়ালদী শাহী মসজিদ
নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে গোয়ালদী শাহী মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণার পিলারটি ভবন থেকে খেসে পড়ার উপক্রম হলেও দীর্ঘ দিন চোখ পড়েনি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের৷ সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের আমলে মোল্লা হিজাবর খান ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেছিলেন এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি৷
ছবি: DW/M. Mamun
পানাম নগর
নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত প্রাচীন বাংলার রাজধানী ঐতিহাসিক পানাম নগর৷ ১৫ শতকে ঈসা খাঁ বাংলার প্রথম রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এই সোনারগাঁওয়ে৷ প্রায় ৫ মিটার চওড়া এবং ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দু’পাশে সুরম্য ৫২টি বাড়ি প্রাচীন এই নগরের অন্যতম আকর্ষণ৷ কিন্তু সঠিক সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ঐতিহাসিক এ শহরটি ধ্বংস হতে চলছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ষাট গম্বুজের মসজিদ
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনা বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরের পাথরের তৈরি পিলারগুলো ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সালের এক সংস্কার কাজের সময় সুরক্ষার কথা বলে পলেস্তারার প্রলেপে ঢেকে দেয়া হয়েছিল৷ তবে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বোধোদয় হওয়ায় সাম্প্রতিক সংস্কারের সময়ে পিলারগুলোর পাথরের উপর থেকে পলেস্তারা তুলে ফেলা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অযোধ্যার মঠ
বাগেরহাটের যাত্রাপুরে সরকার ঘোষিত সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ‘অযোধ্যার মঠ’ কিংবা ‘কোদলা মঠ’৷ মঠের গায়ে গজিয়ে ওঠা বড় বড় পরগাছাগুলোই সংরক্ষিত এ পুরাকীর্তিটির প্রতি সরকারের অবহেলার বড় প্রমাণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য স্থাপনার অংশ চুনাখোলা মসজিদের দেয়ালের ইট খসে পড়ার উপক্রম, দরজা-জানালার গ্রিলও মরিচা ধরে খুলে পড়েছে৷ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের ছোঁয়া লাগেনি প্রাচীন এ স্থাপনাটিতে৷
ছবি: DW/M. Mamun
গোকুল মেধ
বগুড়ার মহাস্থানগড়ের কাছে ঐতিহাসিক ‘গোকুল মেধ’৷ বেহুলার বাসরঘর নামেও এটি পরিচিত৷ বাতি ঝুলানোর জন্য ঐতিহাসিক এ প্রত্নস্থলটির চারপাশ ঘেঁষে বাঁশ বসানো হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় বাড়ি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামে তিতাস নদীর তীরে জমিদার কৃষ্ণপ্রসাদ রায় চৌধুরীর সুরম্য প্রাসাদ বড়বাড়িতেও সংস্কারের হাত পড়েনি কখনো৷ ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ছত্রছায়ায় এ বাড়িটি দখল করে আছে ৪০টিরও বেশি পরিবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
চার আনি জমিদার বাড়ি
কোনো রকম সংরক্ষণ না করায় প্রায় ধ্বংসই হয়ে গেছে নাটোরের পুঠিয়ার চার আনি জমিদার বাড়ি৷ পুঠিয়া রাজবাড়ীর শ্যাম সরোবরের দক্ষিণ পাশের এ চার আনি জমিদার বাড়ি ছাড়াও চার আনি কাছারি বাড়িও ধ্বংসের শেষ প্রান্তে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বড় সর্দার বাড়ি
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ধ্বংসের মহোৎসবের মাঝেও দু-একটি স্থাপনা খুব ভালোভাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে৷ যেমন ধুরণ সোনারগাঁওয়ের ঐতিহাসিক বড় সর্দার বাড়ি৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে এ বাড়িটি সংস্কার করে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে৷ কোরীয় বহুজাতিক কোম্পানি ইয়ংওয়ান কর্পোরেশনের প্রায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তায় করা হয়েছে এ সংস্কার কাজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাইনবোর্ড
বাংলাদেশের যে কোনো সংরক্ষিত পুরাকীর্তি যারা দেখেছেন, এই সাইনবোর্ডটি তাঁদের কাছে বেশ পরিচিত৷ মূল্যবান এই পুরাকীর্তিটি নষ্ট বা ধ্বংস করলে কী শাস্তি হতে পারে তা লিপিবদ্ধ আছে এখানে৷ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ সাইনবোর্ডটি বসিয়েই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে৷ প্রতিটি স্থাপনাতেই সংরক্ষণে অবহেলার ছাপ চোখে পড়ে সহজেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
15 ছবি1 | 15
প্রত্নসম্পদ খননে সরকারি না বেসরকারি উদ্যোগ বেশি লক্ষ্য করা যায়?
প্রত্নতত্ত্ব হলো সরকারের সম্পদ৷ তাই সারা পৃথিবীতে এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগটাই বেশি থাকে৷ আমাদের দেশে বেসরকারি উদ্যোগেও একটা-দু'টো কাজ হচ্ছে৷ বিশেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সাংস্কৃতির মন্ত্রণালয়ের অনুদান নিয়ে কিছু খনন করে থাকে৷ তবে এটাও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সরাসরি তত্ত্বাবধানে হয়৷
জাদুঘর থেকে অনেক সময় প্রত্নসম্পদ চুরি হয়ে যায়৷ এর কারণ কী?
এটা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ভালো বলতে পারবে৷ তবে জাদুঘর থেকে এই ধরনের প্রত্নতত্ত্ব চুরি হয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ হয়ত কোনো সময় দু-একট চুরি হয়ে থাকতে পারে৷ অবশ্যই সেটা নিয়ে থানায় মামলা হবে, থানা সেটা তদন্ত করে দেখবে৷
অনেক সময় বলা হয়, সব প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ করতে গেলে দেশে জমির অপচয় হবে৷ এই ধরনের ধারণা কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
প্রত্নসম্পদ সংরক্ষণ করতে গেলে বেশি জমির দরকার হয় না৷ প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ যেখানে আছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমি দেখেছি, সেটা কৃষি জমি নয়৷ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি নির্দেশনা আছে যে, কৃষি জমি যতটা সম্ভব কম নষ্ট করে প্রত্নসম্পদ রক্ষা করতে হবে৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেটা পাওয়া যায়, সেখান উঁচু ঢিবি থাকে, কিছু গাছ থাকে৷ কৃষি জমিতে থাকলে এটা নষ্ট হয়ে যেত৷ সর্বশেষ নীলফামারীর ধর্মপালে আমরা যে মন্দিরটা পেয়েছি, সেটাও একটা উঁচু জমিতে৷
বিদেশ থেকে কি কোনো পুরাকীর্তি আনা হয়? বিদেশি পুরাকীর্তি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আছে এখানে?
বিদেশ থেকে পুরাকীর্তি আনার বিষয়টি ভ্যারি করে কান্ট্রি-টু-কান্ট্রি, মানে সে দেশের আইন অনুযায়ী৷ কেউ পুরাকীর্তি রপ্তানি করতে পারে না, আমরাও পারব না৷ এর কোনো আইন নেই৷ তবে কোনো দেশের সঙ্গে ইটারচেঞ্জ করে দু-একটা পুরার্কীতি রাখা যেতে পারে৷ আমরা বলতে পারি, তোমাদের একটা পুরার্কীতি আমাদের দাও আর আমাদের এটা তোমরা নাও৷ তখন সেটা আমরা সংরক্ষণ করতে পারি৷ তবে এখনো পর্যন্ত তেমন কিছু হয়নি৷
মসজিদের শহর বাগেরহাটের বিশ্ব ঐতিহ্য
খুলনার প্রচীন মসজিদের শহর বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ৷ শহরটির প্রতিষ্ঠাতা খান-ই-জাহান ছিলেন এক সাধক পুরুষ৷ ষাট গম্বুজ মসজিদসহ এখানকার নানা প্রাচীন স্থাপনা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পায় ১৯৮৫ সালে৷
ছবি: DW/M. Mamun
নির্মাণ কাল ১৪৫৯
খান জাহান আলীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি ষাট গম্বুজ মসজিদ৷ ঐতিহাসিকদের মতে, এই ষাট গম্বুজ মসজিদটি তিনি নির্মাণ করেছিলেন ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দেরও কিছু আগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
একাশিটি গম্বুজ
নাম ষাট গম্বুজ হলেও মসজিদটিতে মূলত একাশিটি গম্বুজ আছে৷ মসজিদের ছাদে ৭৭টি এবং চারকোণার টাওয়ারে চারটি৷ তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ষাটটি স্তম্ভ থাকার কারণে এর নাম হয়ত ষাট গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
অভ্যন্তর ভাগ
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের অংশ৷ এই অংশ অতীতে চুন-শুরকির মিশ্রণে লাল রঙের হলেও, পরবর্তীতে তা পলেস্তরা আরা সাদা রঙের প্রলেপে ঢাকা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢেকে ফেলা হয়েছে কালো পাথর
ষাট গম্বুজ মসজিদের ভেতরের স্তম্ভগুলো ছিল মূলত কালো পাথরের তৈরি৷ উত্তর দিকের একটি স্তম্ভ খালি দর্শনার্থীদের দেখার জন্য রেখে বাকি স্তম্ভগুলোর মূল্যবান কালো পাথর ঢেকে ফেলা হয়েছে সিমেন্টের পলেস্তারার প্রলেপে৷ বাংলাদেশের অনেক প্রাচীন স্থাপনাই এরকম অদক্ষ সংস্কারের নামে ধ্বংস করেছে খোদ সরকারেরই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর!
ছবি: DW/M. Mamun
সিংড়া মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদের দক্ষিণ পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে অবস্থিত প্রাচীন স্থাপনা সিংড়া মসজিদ৷ইট নির্মিত মসজিদের প্রাচীরগুলি প্রায় সাত ফুট প্রশ্বস্ত৷ মসজিদের পূর্ব দেয়ালে আছে তিনটি প্রবেশপথ৷ প্রবেশপথ বরাবর পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি অলংকৃত মিহরাব৷ তবে কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অপেক্ষাকৃত বড় এবং সুসজ্জিত৷ এর নির্মাণ শৈলী বিবেচনা করে ঐতিহাসিকরা মনে করেন, সিংড়া মসজিদের নির্মাণকাল পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি৷
ছবি: DW/M. Mamun
হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এক গম্বুজ বিশিষ্ট হযরত খানজাহান আলীর সমাধিসৌধ৷ কথিত আছে, হযরত খান জাহান আলী বাগেরহাটে এসেছিলেন ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের পরে৷ তিনি প্রথমে দিল্লির সুলতান এবং পরে বাংলার সুলতানের কাছ থেকে সুন্দরবন অঞ্চলের জায়গির লাভ করেন৷ এখানকার গভীর বন কেটে তিনি মুসলিম বসতি গড়ে তোলেন৷ ১৪৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর খান জাহান আলীর মৃত্যু হলে, এখানেই তাঁকে সমাহিত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
জিন্দাপীর মসজিদ
হযরত খানজাহান আলীর সমাধির পশ্চিম দিকে ঠাকুর দিঘির পশ্চিম পাড়ে সুন্দরঘোনা গ্রামে ইট নির্মিত এক গম্বুজ বিশিষ্ট জিন্দাপীর মসজিদ৷ মসজিদের পাশেই হযরত খানজাহানের অনুসারী জিন্দাপীরের সমাধি৷ তাঁর নামেই এ মসজিদের নামকরণ৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজ মসজিদ
খান জাহান আলীর সমাধির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে, ঠাকুর দিঘীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত নয় গম্বুজ মসজিদ৷ ইটের তৈরি এ মসজিদের উপরে নয়টি গম্বুজ রয়েছে৷ পুরো মসজিদের গায়ে পোড়ামাটির কারুকাজ খচিত৷ মসজিদের ছাদ নয়টি নীচু অর্ধ বৃত্তাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
নয় গম্বুজের মিহরাব
নয় গম্বুজ মসজিদের অভ্যন্তরভাগ৷ মসজিদের ভেতরের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
রণবিজয়পুর মসজিদ
বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে রণবিজয়পুর গ্রামের ষাটগম্বুজ সড়কে এ মসজিদটি অবস্থিত৷ ফকিরবাড়ি মসজিদ নামেও এর পরিচিতি আছে৷ স্থাপত্যশৈলির বিচারে এটিকে হযরত খান জাহান আলীর সময়কালে (১৪৫৯ সাল) নির্মিত বলে মনে করা হয়৷ ইটের তৈরি এ মসজিদটি বর্গকারে নির্মিত এবং এক কক্ষ বিশিষ্ট৷ রণবিজয়পুর গ্রামের নামেই এ মসজিদের নামকরণ হয়েছে৷ রণবিজয়পুর মসজিদ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷
ছবি: DW/M. Mamun
চুনাখোলা মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে ধান খেতের মধ্যে অবস্থিত চুনাখোলা মসজিদ৷ বর্গাকৃতির এ মসজিদটি বাইরের দিকে লম্বায় প্রায় ৪০ ফুট এবং ভেতরের দিকে ২৫ ফুট৷ দেয়ালগুলি প্রায় আট ফুট চওড়া৷ কেন্দ্রস্থলের উপরের দিকে রয়েছে বড় একটি গম্বুজ৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিবি বেগনী মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পশ্চিমে এক গম্বুজ বিশিষ্ট বিবি বেগনী মসজিদ৷ মসজিদটি সিংড়া মসজিদের অনুরূপ হলেও, এর পশ্চিম দেয়ালে মিহরাবের সংখ্যা তিনটি৷ মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি
খান জাহান আলীর স্থাপত্য শৈলীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তির অবস্থান বাগেরহাট শহরের উপকণ্ঠে সাবেকডাঙ্গা গ্রামে৷ লাল ইটের তৈরি আয়তকার এ ভবনটি একেক পাশে দৈর্ঘ্য ৭.৮৮ মিটার৷ ভবনটির দক্ষিণপাশে কেবল একটি প্রবেশপথ আছে৷ এর ভেতরে আর কোন দরজা, জানালা কিংবা মিহরাব নেই৷ তাই এটিকে মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি৷ জনশ্রুতি আছে খান জাহান আলী তাঁর বিশেষ প্রার্থনার জন্য এটি নির্মাণ করেছিলেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
এই পুরার্কীতির দেখভালে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল কি আছে বাংলাদেশের? যাঁরা প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণ করে, তাঁদের কি প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ আছে?
এটা একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন৷ আমাদের যত পুরার্কীতি আছে, সেই পরিমাণ জনবল নেই৷ আমরা মানুষ বাড়াতে চেষ্টা করছি, সরকারও দিচ্ছে৷ যেখানে আমাদের জনবল দরকার আমরা চাইলে সরকার সেটা দিচ্ছে৷ এছাড়া নতুন নতুন ‘সাইট' আবিষ্কার হচ্ছে, সেখানে নতুন জনবল লাগছে৷ তবে শুধু জনবল হলেই তো হবে না, তাঁদের প্রশিক্ষণও তো লাগবে৷ তাই আমরা চেষ্টা করছি, এই জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে৷ বিশেষ করে খননের কাজে, সংরক্ষণের কাজে৷ আসলে দু'টোই আমাদের জন্য খুব জরুরি৷