কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্বিবিদ্যালয়ে ছাত্রী নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন সবাই৷ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতও বিষয়টি আমলে নিয়ে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর অভিযোগ শুনবেন বলে জানিয়েছেন৷
বিজ্ঞাপন
কিন্তু নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা না নিয়ে দুইটি কমিটি গঠন করেছে মাত্র৷ আর ছাত্রলীগও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
নির্যাতের শিকার ওই শিক্ষার্থী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''আমি এখন অসুস্থ হয়ে পড়েছি৷ পাবনা গ্রামের বাড়িতে আছি৷ আমাকে এখন হুমকি দেয়া হচ্ছে৷ আামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরতে বা সেখানে পড়াশুনা চলিয়ে যেতে পারব কী না জানি না৷ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ আমার সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করেননি৷''
নির্যাতনের শিকার ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন৷ তবে তিনি চাপ ও আতঙ্কের মধ্যে আছেন৷ অন্যদিকে যাদের বিরুদ্ধে নির্যাতনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তারা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন৷ তারা উল্টো বুধবার নির্যাতনের শিকার ছাত্রীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন৷
সাড়ে চার ঘন্টা ধরে শেখ হাসিনা হলে ওই ছাত্রীকে আটকে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণ করা করা হয় ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে৷ প্রথম বর্ষের ছাত্রী হওয়ায় তার হলে সিট ছিল না৷ তিনি আরেকজনের সঙ্গে অতিথি (দ্বৈত আবাসিক) হিসেবে থাকতেন৷ ছাত্রলীগ নেত্রীদের না জানিয়ে হলে ওঠার অভিযোগে তাকে নির্যাতন করা হয়৷ নির্যাতন ও বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণের ঘটনা প্রকাশ করলে তাকে হত্যারও হুমকি দেয়া হয়৷ মঙ্গলবার বিকেলে তিনি হলের প্রভোস্ট এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন৷
নির্যাতনের শিকার ছাত্রী যা বললেন
ওই ছাত্রী বলেন, ‘‘৷ এই কারণে আমাকে ৩০৬ নাম্বার রুম থেকে গণরুমে নিয়ে রাত ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়৷ নির্যাতনের পর আমাকে গণরুমেই শুইয়ে রাখা হয়৷ পর দিন আমি ক্লাসে যাওয়ার কথা বলে পালিয়ে আসি৷''
তিনি জানান, ‘‘আমাকে চড়, লাথি, ঘুষি কিছুই দিতে বাদ রাখা হয়নি৷ এক পর্যায়ে আমার কাপড়চোপড় খুলে বিবস্ত্র করে ভিডিও করা হয়৷ আর কয়েকজনের বিরুদ্ধে কিছু অশ্লীল কথা হাসিমুখে পড়তে বাধ্য করে তা রেকর্ড করে রাখা হয়৷''
‘তাদের না জানিয়ে হলে ওঠাই আমার অপরাধ’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘তাদের নির্যাতনে আমরা মুখমণ্ডলসহ শারীরে বিভিন্ন স্থানে কালো দাগ হয়ে যাওয়ায় আমাকে সব সময় মুখ ঢেকে, মাস্ক, বোরকা ও হিজাব পড়ে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়৷ আর আমি এই ঘটনা প্রকাশ করলে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়৷''
‘‘ওই রাতে গণরুমে আমাকে মারার সময় সেখানে অনেক ছাত্রী ছিলো; কিন্তু ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায়নি৷ আমাদের হলের কোনো শিক্ষকও আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেননি৷ নির্যাতনের সময় আমার মুখ ঘামছা দিয়ে বেধে রাখা হয়,'' জানান নির্যাতনের শিকার এই ছাত্রী৷
তদন্তে আছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
ইসাামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শেখ আব্দুস সালাম বলেন, ‘‘আমি দুই পক্ষের কাছ থেকেই অভিযোগ পেয়েছি৷ আজ (বুধবার) বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি৷ হলের পক্ষ থেকেও আরেকটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে৷ উভয় কমিটি সাত দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট দেবে৷ রিপোর্ট দেখে ব্যবস্থা নেয়া হবে৷ এর আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়৷ কারণ আমাকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়৷''
তিনি জানান, ‘‘নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী এখন ক্যাম্পাসে নেই৷ তার সাথে আমরা কথা বলব৷ তবে তার বিরুদ্ধে কয়েক মিলে একসাথে এসে অভিযোগ দিয়ে গেছে৷ সব অভিযোগেরই তদন্ত হচ্ছে৷''
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক সাহাদাত হোসেন আজাদ জানান, ‘‘ঘটনার পরই ওই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান৷ মঙ্গলবার লিখিত অভিযোগ করতে এসেছিলেন৷ অভিযোগ করার পর আবার চলে গেছেন৷ আমরা তাকে ক্যাম্পাসে আসতে বলেছি৷ তার নিরাপত্তার কোনো সমস্যা হবে না৷ তবে তদন্ত শেষ হওয়া আগে আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছি না৷''
‘দুটো তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার আগে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয়’
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবং হলে বুধবারও নির্যাতনকারী ছাত্রলীগ নেত্রীরা মহড়া দিয়েছেন৷ তারা ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে৷ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ভয়ে কথা বলতে পারছেন না বলে জানান কয়েকজন শিক্ষার্থী৷
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ইমানুল সোহান বলেন, ‘‘নির্যাতনকারীরা ছাত্রলীগ নেত্রী বলেই হয়তো এখনো আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না৷ তবে সংবামাধ্যমে খবর প্রকাশ ও বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আসায় তারা আজকে(বুধবার) আজকে কিছুটা নীরব৷ তারা ওই শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দিয়ে চাপ সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে৷''
তার কথা, ‘‘সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখনো প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করার সাহস করছে না৷ তারা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছে৷ আর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে৷ ছাত্রলীগ চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে৷''
এদিকে ওই ছাত্রীকে নির্যাতনের ঘটনা হাকোর্টের নজরে এসেছে৷ বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের বেঞ্চ বৃহস্পতিবার অভিযোগ শুনবেন বলে জানিয়েছেন৷
ভালো-মন্দে ছাত্র রাজনীতি
গণতান্ত্রিক সব আন্দোলন, বাংলাদেশ সৃষ্টি, একটি স্বাধীন দেশের বাঁক বদলে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে৷ গৌরবের সেই ধারা কতটুকু ধরে রাখতে পেরেছে হালের ছাত্র সংগঠনগুলো? ছাত্র রাজনীতির ভালো-মন্দের বয়ান পড়ুন ছবিঘরে৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
ভাষা আন্দোলন
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন ছাত্ররা৷ এই আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এমনই এক ঘটনা, দাবি পূরণের পরেও যার রেশ থেকে যায়৷ ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার দীক্ষা দেয়; যা থেকে জন্ম নেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ৷
ছবি: Journey/R. Hoque
গণঅভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালে সব ছাত্রসংগঠন মিলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে জাতীয় ও সমাজতান্ত্রিক ধারণাপুষ্ট ১১ দফা দাবি উপস্থাপন করে৷ এর ফলে আইয়ুব খানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে বাধ্য করা হয়৷ এরপর এক জনসমাবেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়৷
ছবি: Journey/R. Talukder
মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালের ১ মার্চের পর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশ জাতিসত্তার ধারণাগুলো বাস্তবায়নে অগ্রসর হয়৷ শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল ছাত্রদের আকাঙ্ক্ষারই বহিঃপ্রকাশ৷ স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে ছাত্র সংগঠন তথা শিক্ষার্থীদের ভূমিকা অপরিসীম৷
ছবি: Journey/R. Talukder
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের পঁচিশ মার্চ মধ্যরাতে জনগণের উপর পাকবাহিনীর আক্রমণ ৩ মার্চ ছাত্রদের স্বাধীনতা ঘোষণার যৌক্তিকতা প্রমাণ করে৷ ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বস্তুত ৩ মার্চ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের স্বাধীনতা ঘোষণারই স্বীকৃতি৷
ছবি: Journey
স্বৈরাচার পতন
হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং ১৯৯১ সালে তাঁর পতন ঘটানোর ক্ষেত্রে ছাত্রঐক্য ও শক্তির পরিচয় পাওয়া যায়৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন ক্ষমতাসীন স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের পতন হয়, শুরু হয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নবযাত্রা৷
ছবি: Journey/Y. Saad
ছাত্র বিক্ষোভ
সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ফুটবল খেলা দেখাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের সঙ্গে সেনা সদস্যদের সংঘর্ষ হয়৷ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক ছাত্র বিক্ষোভ৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষক ও আট শিক্ষার্থী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয়র আট শিক্ষক ও এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হলেও পরে এদের মুক্তি দেয়া হয়৷
ছবি: Journey/S.-M. Gorki
সেভেন মার্ডার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ১৯৭৪ সালের ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের সাত নেতা খুন হন৷ ওই সময়কার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান এই খুনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসে৷ বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে শফিউলের মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও ’৭৫-এর পর জিয়াউর রহমান তাকে বিএনপিতে যোগদানের শর্তে ক্ষমা করে দিয়ে মুক্তি দেন৷
ছবি: Fotolia/Scanrail
সস্ত্রাসে ছাত্র নেতারা
জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর ক্যাম্পাসগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি বাড়তে থাকে৷ ক্ষমতা ধরে রাখতে ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেন স্বৈরশাসক এরশাদও৷ এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি যখন যে দলটি ক্ষমতায় ছিল ক্যাম্পাসগুলোতে তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়৷
ছবি: bdnews24
রগ কাটা শিবির
ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতাকর্মীরা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরের পর বছর রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল৷ ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনীতি করা এই সংগঠনটির নেতারা প্রতিপক্ষের কর্মীদের হাত-পায়ের রগ কেটে দিত, এজন্য এটিকে রগকাটা সংগঠন হিসেবে মনে করেন অনেকেই৷
ছবি: STR/AFP/Getty Images
ছাত্রদলে অছাত্র
বিএনিপির শাসনামলে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজ সংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বার বার দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়ায় ছাত্রদলের নেতারা৷ ভাতৃপ্রতীম ছাত্র শিবিরের সঙ্গেও তাদের সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল নিয়মিত ঘটনা৷ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রদল টেন্ডারবাজি, ছাত্রী নিপীড়নসহ হাজারো অভিযোগে বিদ্ধ ছিল প্রায় সময়ই৷ অছাত্রদের এই সংগঠনের নেতৃত্বে রাখা এক সময় অঘোষিত রেওয়াজে পরিণত হয়েছিল৷
ছবি: Reuters
নিয়ন্ত্রণহীন ছাত্রলীগ
টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ৷ এই সময়ে ছাত্রলীগ সারা দেশে তাদের আধিপত্য পুরো প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে৷ প্রতিপক্ষ দূর্বল হয়ে যাওয়ায় নিজেদের মধ্যে বার বার সংঘাতে জড়িয়ে রক্ত ঝরিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা৷ সাধারণ ছাত্ররাও এদের হাতে বলি হয়েছেন অনেকবার৷ সংগঠনটির নেতাকর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নানা সময়ে শিরোনাম হয়েছে৷ এ বছর চাঁদাবাজীর অভিযোগে ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতাকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Bdnews24.com
প্রতিবাদী বাম
এক সময় ক্ষমতা, শক্তি, প্রভাব, প্রতিপত্তি আর দাপুটে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো কালের পরিক্রমায় এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত৷ জাতীয় কোনো ইস্যুতে ভয়ে অনেকে চুপ থাকলেও এখনো বেশকিছু বাম সংগঠনের নেতাকর্মীদের অন্তত রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/M. Asad
ক্যাম্পাসে যত খুন
স্বাধীনতার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন৷ ঢাবিতে ৭৪, রাবিতে ২৯, চবিতে ১৯, জাবিতে সাত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯ শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন৷ আওয়ামী লীগের গত ১০ বছরে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে খুন হয়েছে ২৪ জন শিক্ষার্থী৷ নিজ সংগঠনের নেতাকর্মী বা প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের হাতে এসব খুনের ঘটনা ঘটছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Asad
13 ছবি1 | 13
ছাত্রলীগকে দেখার কেউ নেই?
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকার ইডেন কলেজে সিট বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগেরই এক নেত্রীকে মারধর করে ছাত্রলীগের আরেক গ্রুপ৷ এই নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়৷ তখন সিট বাণিজ্য ছাড়াও ছাত্রীদের অনৈতিক কাজে বাধ্য করার অভিযোগ ওঠে৷ তখন ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের ১৬ জনকে সাময়িক বহিষ্কার ও কমিটি সাময়িক স্থগিত করা হয়৷ পরে আবার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও কমিটি বহাল করা হয়৷
সম্প্রতি আরো কিছু অঘটন ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ৷ পুরানো ঢাকার সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের এক ছাত্রী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আশিকুল ইসলাম আশিকের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে শ্লীলতাহানি ও ধর্ষণের হুমকি দেয়া হয়৷
চলতি মাসেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির চার শিক্ষার্থী৷ তাদের মধ্যে দুইজনকে আইসিইউকে রাখতে হয়৷ আইসিইউকে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতারা তাদের কবরে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়৷ এদিকে একই সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের খবর পবিবেশন করায় এক নারী সাংবাদিককে হেনস্তা করে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা৷
তবে এসব নিয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কোনো নেতার বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷
ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক নৃশংসতা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একের পর এক নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়েছে ছাত্রলীগ৷ বিশ্বজিৎ থেকে আবরার পর্যন্ত তাদের নির্যাতনে মারা গেছে বেশ কয়েকজন৷ কেউ হারিয়েছেন দৃষ্টি, কারো ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে শরীরের হাড়৷ বিচার হয়নি অনেক ঘটনারই৷
ছবি: bdnews24.com
দখলবাজির শিকার আবু বকর
২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখলকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মেধাবী ছাত্র আবু বকর৷ ময়না তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী শক্ত ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতে আবু বকরের মাথা থেঁতলে দেয়া হয়৷ এই হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানায় একটি মামলা হয়৷ ২০১৭ সালে আদালতের রায়ে ছাত্রলীগের অভিযুক্ত ১০ নেতা-কর্মীর সবাই বেকসুর খালাস পায়৷ (ছবি: সাম্প্রতিক)
ছবি: bdnews24.com
খাবার নিয়ে বিরোধে হত্যা
২০১০ সালে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ইফতারের টোকেন সংঘর্ষ বাধে রাজশাহী ছাত্রলীগের মধ্যে৷ তার জের ধরে দলটির কর্মী নাসরুল্লাহ নাসিমকে পিটিয়ে শাহ মখদুম হলের দ্বিতীয় তলা থেকে ফেলে দেয়া হয়৷ ১০ দিন হাসপাতালে থাকার পর তার মৃত্যু হয়৷ এ ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় ১০ জন, যাদের সবাই এখন জামিনে৷
ছবি: DW/A. Khanom
জুবায়েরকে কুপিয়ে হত্যা
২০১২ সালে জানুয়ারিতে মারা যান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের৷ তাকে পরিকল্পিতভাবে কুপিয়ে হত্যা করে তারই সংগঠনের প্রতিপক্ষরা৷ এই মামলায় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০১৫ সালে পাঁচ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন৷ গত বছরের জানুয়ারিতে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবন বহাল রাখে হাইকোর্ট৷ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে চারজনই পলাতক৷
ছবি: bdnews24.com
দুর্ভাগা বিশ্বজিৎ
বিশ্বজিৎ দাস ছিলেন পুরান ঢাকার একজন দর্জি৷ ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নৃশংস হামলায় তাঁর মৃত্যু হয়৷ সেসময় ১৮ দলের অবরোধ চলছিল৷ বিশ্বজিৎ শিবির কর্মী এমন ধারণা করে তাঁকে চাপাতি, কিরিচ দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে কোপায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ আলোচিত এই ঘটনায় নিম্ন আদালতে আট আসামির মৃত্যুদণ্ড হলেও চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন, দুইজনকে খালাস আর পলাতক দুইজনের রায় বহাল রাখে হাইকোর্ট৷
ছবি: bdnews24.com
বাদ যায়নি শিশুও
২০১৩ সালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয় মারা যায় ১২ বছরের শিশু রাব্বি৷
ছবি: bdnews24.com
আধিপত্য বিস্তারের বলি তাপস
২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান সংস্কৃতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র তাপস সরকার৷ ২০১৬ সালে এই ঘটনায় ২৯ নেতাকর্মীর নামে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ৷ মূল আসামী আশরাফুজ্জামানসহ গ্রেপ্তারকৃত ১৫ জনই জামিনে পান৷ (ছবি: প্রতীকী)
ছবি: Fotolia/Scanrail
খাদিজার মৃত্যুর কাছ থেকে ফেরা
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবরের ঘটনা৷ এমসি কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বের হবার পরই খাদিজা আক্তার নার্গিসকে চাপাতি দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবি)-র ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলম৷ নার্গিসকে মৃত ভেবে পালিয়ে যাওয়ার সময় পথচারীরা বদরুলকে আটক কোরে পুলিশে দেয়৷ আলোচিত এই ঘটনায় বদরুলের যাবজ্জীবন সাজার রায় দিয়েছে আদালত৷
ছবি: bdnews24.com
হেলমেট বাহিনীর হামলা
গত বছর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় হেলমেট পরিহিত সশস্ত্র কিছু যুবক ধানমন্ডি, জিগাতলা এবং সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় পুলিশের উপস্থিতিতে শিক্ষার্থী এবং সাংবাদিকদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা করে৷ হামলাকারীরা ছাত্রলীগের কর্মী বলে বিভিন্ন গনমাধ্যমে পরিচয় সহ খবর বের হয়৷ কিন্তু এই ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হয়নি, কারও বিচারও হয়নি৷
ছবি: Bdnews24.com
হাতুড়ি মামুনদের বিচার হয়নি
দেশব্যাপী কোটা আন্দোলনের সময় বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের উপর ছাত্রলীগের হামলার অভিযোগ ওঠে৷ তেমনই একটি ঘটনা ঘটে গত বছরের ২ জুলাই৷ তরিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষার্থীকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় পেটায় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী৷ তাকে হাতুড়ি পেটা করে দলটির সহ-সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামুন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: bdnews24.com
চোখ হারানো এহসান
গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হলে এহসান নামের এক ছাত্রকে পিটিয়ে আহত করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা৷ নিজের ক্যালকুলেটর ফেরত চাইলে এই হামলা চালায় তারা৷ এসময় তাকে শিবির কর্মী বলেও অপবাদ দেয়া হয়৷ হামলায় এহসানের চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়৷ ঘটনায় ছাত্রলীগের ৭ নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে বহিস্কার হলেও তারা হলে থাকতেন বলে খবর বের হয়৷ অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছাড়ে এহসান৷
ছবি: bdnews24.com
আহ্ আবরার!
সবশেষ ৭ সেপ্টেম্বর দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের নৃশংসতার শিকার হল বুয়েটের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ৷ রাত ২টার দিকে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এই ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতারা আগের দিন সন্ধ্যায় তাকে রুম থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে৷ আবরারের বাবা বরকতুল্লাহ ১৯ জনকে আসামি করে মামলা করেন, যার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০ জন ৷
ছবি: bdnews24
১০ বছরে ২৪ হত্যা
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী গত ১০ বছরে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ২৪ জনকে হত্যা করা হয়েছে৷ যার প্রায় সবগুলোর সাথেই ছাত্রলীগ জড়িত রয়েছে৷ এর মধ্যে ১৭ টিই ঘটেছে নিজেদের অন্তর্কোন্দলে৷ সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ গত ১০ বছরে সেখানে ৮ শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে৷
ছবি: bdnews24
ইচ্ছে হলেই মারধর, হামলা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সংগঠনের কর্মসূচীতে ইচ্ছে হলেই হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা৷ কোটা আন্দোলনের সময় আন্দোলনকারীদের বিভিন্ন সময় মারধর করেছে সংগঠনটির নেতা কর্মীরা৷ গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের আন্দোলনেও ছাত্রলীগের হামলা এবং ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা ঘটে৷ একাধিকবার তাদের হামলার শিকার হয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক নুর৷