সারা পৃথিবীতে প্রায় ২৩২ মিলিয়ন মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন পরিস্থিতি, নতুন ভাষা ও নতুন সংস্কৃতির সম্মুখীন হচ্ছেন৷ খুঁজে বেড়াচ্ছেন নতুন অভিবাসন৷ এঁদের অনেকেরই কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় গন্তব্যস্থান জার্মানি৷
বিজ্ঞাপন
‘‘তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?'' এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অনেক মানুষের পক্ষে সহজ নয়৷ জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৩২ মিলিয়ন মানুষ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য কোথাও বসবাস করছেন৷ এই সংখ্যাটা ২০ বছর আগের তুলনায় ৮০ মিলিয়ন বেশি৷
আসল সংখ্যাটা আরো বেশি
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন আসল সংখ্যাটা আরো বেশি হবে৷ দক্ষিণের অনেক দেশে প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবে অভিবাসীদের সংখ্যাটা ঠিকমতো গোনা হয় না৷ বলেন জার্মানির অসনাব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিবাসী গবেষণা ও আন্তঃর্জাতিক সমীক্ষা ইন্সটিটিউটের ইউখেন ওল্টমার৷ এছাড়া জাতিসংঘ শুধু সেই সব অভিবাসীদেরই তালিকায় ধরেছে, যাঁরা অন্য কোনো দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন৷ যাঁরা কয়েক দশক অন্য কোথাও বসবাস করে আবার স্বদেশে ফিরে গিয়েছে, তাঁদেরকে অভিবাসীদের তালিকায় আনা হয়নি৷
জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী অভিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় গন্তব্যস্থান জার্মানি৷ অভিবাসীর সংখ্যা ১০ মিলিয়ন৷ এদিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পর তৃতীয় স্থানে রয়েছে দেশটি৷
নিয়ে আসা হয় শ্রমশক্তি
জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রমশক্তির অভাব দেখা দিয়েছিল৷ ১৯৫৫ সালে ইটালি থেকে তথাকথিত অতিথি শ্রমিক আনা হয় জার্মানিতে৷ তারপর দক্ষিণ ইউরোপের অন্যান্য দেশ, তুরস্ক, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুগোস্লাভিয়া থেকে শ্রমিক আনা শুরু হয়৷ জার্মানিতে বসবাসকারী বিদেশির সংখ্যা ৬০-এর দশকের প্রথম দিকে ৭ লক্ষ থেকে বেড়ে ৭০ দশকের প্রথম দিকে ২.৭ মিলিয়নে দাঁড়ায়৷
কিন্তু ৭০ দশকের শেষ দিক থেকে বিশ্বব্যাপী তেল সংকট দেখা দেওয়ায় বিদেশ থেকে শ্রমশক্তি আনা বন্ধ হয়৷ অতিথি শ্রমিকদের অর্থের বিনিময়ে জার্মানি ত্যাগ করতে প্রণোদিত করা হয়৷ কিন্তু ততদিনে অনেকে জার্মানিতে থিতু হয়ে গেছেন৷ পরিবার পরিজনও এনেছেন৷ তাই এই উদ্যোগ তেমন কার্যকর হয়নি৷
৮০-এর দশকের শেষ দিকে কমিউনিজমের পতনের পর আর বিদেশিদের একটি বড় গোষ্ঠী জার্মানিতে আসা শুরু করে৷ তাঁরা হলেন পোল্যান্ড ও রাশিয়া থেকে আসা জার্মান বংশোদ্ভূত লোকজন৷ ১৯৯০ সালে বিদেশির সংখ্যা ৫.৬ মিলিয়নে দাঁড়ায়৷ এর দশ বছর পর এই সংখ্যার সাথে আরো ২ মিলিয়ন যোগ হয়৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে অভিবাসন
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকটের কারণে চাকরির আশায় বিগত বছরগুলিতে স্পেন, ইটালি ও পর্তুগাল থেকে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে জার্মানিতে৷ তবে তাঁরা জার্মানিতে বসবাসের ব্যাপারে দীর্ঘদিনের কোনো পরিকল্পনা করেন না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা৷
বিশেষ করে ইউরোপের নানা দেশ থেকে অভিবাসীরা জার্মানিতে আসছেন৷ অভিবাসন গবেষক ওল্টমার মনে করেন, এর পেছনে অর্থনৈতিক কারণটাই মুখ্য৷ পরিবহণ ও থাকা খাওয়ার জন্য অর্থের দরকার তো রয়েইছে৷ এছাড়া ‘নতুন স্বদেশে' থিতু হওয়ার জন্য পরিচিত ও আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে যোগযোগটাও জরুরি৷ সেজন্য কাছাকাছি দেশগুলিতেই অভিবাসনের জন্য যেতে চায় মানুষ৷ অভিবাসীদের কাছে এশিয়ার জনপ্রিয় দেশগুলির মধ্যে তাইওয়ান, দিক্ষণ কোরিয়া, চীনের নাম করা যায়৷ ল্যাটিন অ্যামেরিকার ব্রাজিল ও ভেনেজুয়েলা আকৃষ্ট করে অনেক অভিবাসীকে৷
পশ্চিমের অনেক দেশে কঠোর অভিবাসন আইন বিদেশিদের আসার পথ দুরূহ করে তুলেছে৷ রেগেন্সবুর্গ ইউনিভার্সিটির অভিবাসন গবেষক ফিলিপ আন্ডারসন ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জার্মান অভিবাসন নীতিতে ‘ভালো ও মন্দ অভিবাসীর' মধ্যে পার্থক্য করা হয়৷ যুদ্ধ বিগ্রহ বা অন্যান্য কারণে যাঁরা শরণার্থী হয়ে এসেছেন, তাঁরা তেমন স্বাগত নয় এই দেশে৷ তাই তিনি দাবি জানান, শরণার্থীদের শিক্ষাদীক্ষা ও পেশাগত অভিজ্ঞতা যেন হেলাফেলা করা না হয়৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এইসব মানুষ যাতে কর্ম -বাজারে দ্রত প্রবেশ করতে পারেন, সরকারের সেই উদ্যোগই নেওয়া উচিত৷''