জনমোহিনী রাজনীতি করতে গিয়ে নেতারা মানুষের মধ্যে বিদ্বেষের বীজ ছড়াচ্ছেন৷ আক্রান্ত হচ্ছে মানবাধিকার৷ এভাবে চলতে থাকলে বিশ্বযুদ্ধকালীন ইতিহাস ফিরে আসবে৷ সতর্ক করলো অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷
বিজ্ঞাপন
বিশ্ব জুড়ে মানবাধিকার হুমকির মুখে৷ অধিকাংশ দেশেই তা ঠিকভাবে রক্ষিত হচ্ছে না৷ সম্প্রতি তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে এ কথা জানিয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল৷ তাদের বক্তব্য, রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্রপ্রধানেরা জনসংযোগ তৈরি করতে এবং ভোটে জেতার জন্য সস্তা রাজনীতি করছেন৷ জনগণকে উত্তেজিত করতে তাঁরা ‘হেট স্পিচ’ দিচ্ছেন, যা আসলে মানুষের মধ্যে বিভেদ আরো বৃদ্ধি করছে৷ তাদের রিপোর্টে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছে৷ ভোটের আগে থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত ট্রাম্প যেভাবে মার্কিন জনগণের মধ্যে বিদ্বেষের আগুন জ্বালিয়েছেন, তার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে রিপোর্টে৷ তবে শুধু অ্যামেরিকা নয়, অন্যান্য দেশের কথাও রিপোর্টে বলা হয়েছে৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল মনে করে, বিদ্বেষমূলক রাজনীতি বিশ্ব জুড়ে ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে৷
রোহিঙ্গাদের উপর নৃশংসতার চিত্র
মিয়ানমারের রাখাইনে সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে কয়েক লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে চলে গেছে৷ রয়টার্সের আলোকচিত্রীর ছবিতে সেইসব নৃশংসতার ছবি ফুটে উঠেছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
একবছরের শিশু
মনকে নাড়া দেয়া ব্যান্ডেজে মোড়ানো তুলতুলে ছোট্ট এই দু’টি পা শহিদের৷ বয়স মাত্র এক বছর৷ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচতে দাদি তাহেরা যখন পালাচ্ছিলেন, তখন তাঁর কোল থেকে পড়ে যায় ছোট্ট শহিদ৷ ছবিটি কক্সবাজারে রেডক্রসের এক হাসপাতালে ২৮ অক্টোবর তোলা৷
ছবি: Reuters/H. McKay
কালাবারো, ৫০
রাখাইনের মংদুতে তাঁদের গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনা সদস্যরা৷ এতে স্বামী, মেয়ে ও এক ছেলেকে হারান কালাবারো৷ তাঁর ডান পায়ে আঘাত করা হয়৷ যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন সেখানেই কয়েক ঘণ্টা মারা যাওয়ার ভান করে ছিলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
সেতারা বেগম, ১২
নয় ভাই-বোনের মধ্যে একজন সে৷ সেনারা যখন তাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন বাকি আটজন বের হয়ে যেতে পারলেও সে আগুনের মধ্যে আটকা পড়ে গিয়েছিল৷ পরে তাকে উদ্ধার করা হয়৷ তবে পা পুড়ে যায়৷ এই অবস্থায় বাংলাদেশে পৌঁছেছে সে৷ বাংলাদেশেই তার চিকিৎসা করা হয়৷ এখন তার দুই পা থাকলেও নেই কোনো আঙুল৷
ছবি: Reuters/J. Silva
নূর কামাল, ১৭
নিজের ঘরে লুকিয়ে ছিল সে৷ সেখান থেকে সৈন্যরা তাকে খুঁজে বের করে প্রথমে রাইফেলের বাট, পরে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করে৷ ছবিতে সেটিই দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
আনোয়ারা বেগম, ৩৬
ঘরে আগুনের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুম থেকে উঠে পালাতে গিয়েছিলেন তিনি৷ তবে এর মধ্যেই পুড়ে যাওয়া ছাদ তাঁর মাথায় ভেঙে পড়ে৷ ফলে শরীরে থাকা নাইলনের কাপড় গলে হাত পুড়িয়ে দেয়৷ ‘‘আমি মনে করেছিলাম, মরে যাব৷ তবে আমার সন্তানদের জন্য বেঁচে থাকার চেষ্টা করছি,’’ রয়টার্সকে বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মমতাজ বেগম, ৩০
সেনারা তাঁর বাড়িতে ঢুকে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলেছিল৷ তখন মমতাজ তাঁদের দারিদ্র্যের কথা জানালে সৈন্যরা বলেছিল, ‘‘যদি তোমার কোনো অর্থ না থাকে, তাহলে আমরা তোমাকে হত্যা করব৷’’ এই বলে, সৈন্যরা তাঁকে ঘরে বন্দি করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল৷ কোনোরকমে সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে বের হয়ে দেখেন তাঁর তিন ছেলে মৃত, আর মেয়েকে প্রহার করা হয়েছে, তার রক্ত ঝরছে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
ইমাম হোসেন, ৪২
মাদ্রাসায় পড়িয়ে ফেরার পথে তিন ব্যক্তি ছুরি নিয়ে তাঁর উপর হামলা করেছিল৷ পরের দিনই তিনি তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তানকে গ্রামের অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন৷ এরপর তিনিও কক্সবাজারে পৌঁছান৷
ছবি: Reuters/J. Silva
মোহাম্মদ জাবাইর, ২১
গ্রামের বাড়িতে এক বিস্ফোরণে তার শরীরের এই অবস্থা৷ ‘‘আমি কয়েক সপ্তাহ অন্ধ ছিলাম৷ কক্সবাজারের এক সরকারি হাসপাতালে ২৩ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম,’’ বলেছে সে৷
ছবি: Reuters/J. Silva
8 ছবি1 | 8
বিদ্বেষের রাজনীতির কথা বলতে গিয়ে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে হাঙ্গেরি, তুরস্ক এবং মিয়ানমারের কথা৷ এসব দেশে একইভাবে নেতারা রাজনীতির নামে মানুষের ভিতরে বিদ্বেষের বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছেন৷ তুরস্ক সরাসরি হামলা চালিয়েছে সিরিয়ায়, মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে৷ হাজার হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সেইসব প্রসঙ্গই এনেছে তাদের রিপোর্টে৷
শুধু তাই নয়, রিপোর্টে পরিসংখ্যান দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, গত এক বছরে মানবাধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে৷ শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই ৩১২ জন মানবাধিকার কর্মী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিহত হয়েছেন৷ আক্রমণ বাড়ছে সাংবাদিকদের ওপরেও৷ এসবকিছুর জন্যই ‘পপুলার রাজনীতি’ বা বিদ্বেষমূলক রাজনীতিকে দায়ী করা হচ্ছে৷
উপসংহারে রিপোর্টটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে দিগনির্দেশ করেছে৷ বলা হয়েছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভৎসতা দেখে ১৯৪৮ সালে হিউম্যান রাইটস বা মানবাধিকার চুক্তি তৈরি হয়েছিল৷ এ বছর যা ৭০ বছরে পা দিল৷ পৃথিবীতে একটি শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরির জন্যই সেই চুক্তিতে সই করেছিল অধিকাংশ দেশ৷ বর্তমান সময়ে বিশ্ব রাজনীতি আবার পিছনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছে৷ মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বারবার৷ এভাবে চলতে থাকলে অনতি দূরের ইতিহাস ফিরে আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না৷ তখন কিন্তু পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে উঠবে৷