মানবজাতির সাধারণ সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাম্য হলেও চারিদিকে এত সংকটের মাঝে তার লক্ষণ দেখা যায় না৷ কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বিজ্ঞানী ও গবেষকরা সেই আদর্শ পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
অ্যান্টার্কটিকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামার আগেই হিমবাহের উপর রানওয়ে চোখে পড়ে৷ ১০টি দেশের গবেষক তুষারে ঢাকা গ্রীষ্মকাল কাটাতে অ্যান্টার্কটিকায় যাচ্ছেন৷ বেলারুশের দলটি এ বছর বিশেষ বড় আকারের৷ সেই দলের সদস্য আলেক্সি জাভাটভ বলেন, ‘‘বেলারুশ এক বিশাল অ্যান্টার্কটিকা গবেষণা কর্মসূচি চালাচ্ছে৷ জীববিজ্ঞানী, মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ, ভূপদার্থবিদ এতে শামিল হচ্ছেন৷ এতকাল শুধু গ্রীষ্মকালীন স্টেশন ছিল৷ এবার শীত কাটানোর উপযুক্ত স্টেশনও তৈরি করছি৷’’
পরিবেশ গবেষণায় ব্যস্ত অ্যান্টার্কটিকার বিজ্ঞানীরা
03:50
ভারতও এক বড় টিম পাঠিয়েছে৷ বিজ্ঞানীরা এখান থেকেই সে দেশের দুটি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হতে পারেন৷ তাঁদের গবেষণার লক্ষ্য খুবই স্পষ্ট৷ ‘মৈত্রী’ স্টেশনের বিজ্ঞানী জীব কৃষ্ণমালি বলেন, ‘‘জলবায়ু সংক্রান্ত গবেষণা এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প৷ এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা আমাদের কাছে জরুরি৷ তুষারের গভীরে ও হিমবাহের মধ্যে কী পরিবর্তন ঘটছে?’’
রুশ বিজ্ঞানীরা নয়মায়ার স্টেশনে জার্মানির সিসমোলজিস্টদের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন৷ প্রায় ৭০০ কিলোমিটার দূরে প্রত্যন্ত এক জায়গায় সেটি অবস্থিত৷ অ্যান্টার্কটিকার গভীরে সেই গবেষণাকেন্দ্রে খুব বেশি বিজ্ঞানী যাতায়াত করেন না৷ ইওসেফিন স্টাকেমান ও এডিট কর্গার সেখানে পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র নিয়ে গবেষণা করেন এবং ভূমিকম্পের তীব্রতা মাপেন৷ অন্যান্য দেশের গবেষকদের মতোই তাঁরা ১৫ মিটার গভীরে পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷ তবে তাঁদের মতে, এই পরীক্ষা যথেষ্ট নয়৷ স্টাকেমান বলেন, ‘‘মহাদেশ হিসেবে অ্যান্টার্কটিকা নিয়ে আসলে এখনো যথেষ্ট গবেষণা হয় নি৷ আমার মতে, তথ্য সংগ্রহের জন্য যথেষ্ট কেন্দ্রও নেই৷’’
বিশ্বের প্রথম স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার
অ্যান্টার্কটিকায় অবস্থিত ‘হ্যালি সিক্স’ নামের এই গবেষণাগারটি এমনভাবে তৈরি যেন প্রয়োজন হলে খুব সহজেই তাকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যায়৷ ‘ব্রিটিশ অ্যান্টার্কটিক সার্ভে’-এর গবেষণাগার এটি৷
ছবি: British Antarctic Survey
বিশ্বে প্রথম
২০১৩ সালে অ্যান্টার্কটিকায় যখন ‘হ্যালি সিক্স’-এর উদ্বোধন হয় তখন সেটe বিশ্বের প্রথম ‘রিলোকেটেবল’ বা স্থানান্তরযোগ্য গবেষণাগার হিসেবে স্বীকৃতি পায়৷ প্রায় ২৬ মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে নির্মিত গবেষণাগারটি অ্যান্টার্কটিকার যে কোনো স্থানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব৷
ছবি: British Antarctic Survey
আছে স্কি লাগানো পা
খেয়াল করে দেখুন গবেষণাগারটিতে আটটি আলাদা অংশ একটি আরেকটির সঙ্গে জোড়া লেগে আছে৷ প্রতিটি অংশের চারটি করে হাইড্রোলিক পা আছে৷ এসব পায়ের নীচে আছে বিশেষ স্কি, যার সাহায্যে প্রতিটি অংশকে সহজে ঠেলে এদিক-সেদিক নেয়া যায়৷
ছবি: British Antarctic Survey
ইতিমধ্যে স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে
যে বিশাল ফাটলটি দেখতে পাচ্ছেন সে কারণে হ্যালি সিক্সকে একবার তার আগের জায়গা থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে৷ ‘ব্রান্ট আইস সেলফ’ নামে অ্যান্টার্কটিকার যে অংশে গবেষণাগারটি আছে সেখানে এই ফাটল দেখা দিয়েছে৷
ছবি: British Antarctic Survey
আরও একটি কারণে প্রথম
হ্যালি সিক্সই প্রথম গবেষণাগার যেটি ওজন স্তরে বিভিন্ন ছিদ্র থাকার খবর দিয়েছে৷ এছাড়া মহাকাশের আবহাওয়া, ওজন ডিপ্লেশন, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন সেখানকার বিশেষজ্ঞরা৷
দুই নম্বর ছবিতে হ্যালি সিক্সের মাঝখানে বড় লাল রঙের যে অংশটি দেখেছেন এই ছবিতে সেটিই আলাদাভাবে দেখতে পাচ্ছেন৷ এখানে গবেষক সহ অন্যরা আড্ডার জন্য জমায়েত হন৷ গ্রীষ্মকালে ৭০ আর শীতের সময় ১৬ জন থাকেন গবেষণাগারে৷
ছবি: British Antarctic Survey
আলোর নাচন
হ্যালি সিক্স এমন জায়গায় অবস্থিত যেখানে বছরের ১০৫ দিন ২৪ ঘণ্টাই আঁধার থাকে৷ চরম আবহাওয়ার কারণে মাঝেমধ্যেই বাকি বিশ্বের সঙ্গে সেখানকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়৷ তবে সেখানে শুধু যে খারাপ সময়ই যায় তা নয়৷ প্রায়ই সেখানকার বাসিন্দারা রাতের বেলায় আকাশে আলোর নাচন ‘অরোরা অস্ট্রালিস’ দেখতে পান৷
ছবি: British Antarctic Survey
6 ছবি1 | 6
বায়ুমণ্ডলীয় রসায়ন পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান মার্কুস শুমাখারও এমনটা মনে করেন৷ অ্যান্টার্কটিকার বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়ে চলায় তিনি দুশ্চিন্তায় ভুগছেন৷ বিশেষ করে পৃথিবীর দক্ষিণে নির্মল এই মহাদেশটিতে দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করার আশঙ্কা তাঁকে ভাবাচ্ছে৷ কোনো রাষ্ট্রের অন্তর্গত না হওয়ায় সেখানে এমন কাজে কোনো বাধা নেই৷ শুমাখার বলেন, ‘‘কী ঘটবে, কীভাবে সবকিছু এগোবে, সেটা বলা অবশ্যই কঠিন৷ কোনো এলাকা থেকে বরফ সরে গেলে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ মানুষের নাগালের মধ্যে এসে যাবে৷ তবে বহু বছর আগে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল৷ আমার কাছে এটা ভালো লক্ষণ, যে বিষয়টি সে দিকেই এগোচ্ছে৷’’
নয়মায়ার কেন্দ্রের গবেষকদের কাছে এম্পারার পেঙ্গুইন বিশেষভাবে আকর্ষণীয়৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে আগাম আভাস পেতে এই প্রাণীর রক্ত চলাচল যতটা সম্ভব নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করতে হবে৷ এ ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক গবেষক দলগুলি পরস্পরের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করছেন৷ ‘থিংক’ পরিবেশ সংগঠনের মারি-শার্লট রুমলার মনে করেন, ‘‘সব সময়ে বলা হয় এটা হলো অ্যান্টার্কটিক পরিবার৷ জগতের সব সংকট এখানে ম্লান হয়ে যায়৷ সবাই সবাইকে সাহায্য করে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়ার চেষ্টা চালু থাকে৷ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও এই মনোভাব দেখা যায়৷ বিশ্বের সব নেতিবাচক খবরের মাঝেও এমন সহযোগিতা দেখলে খুব সুন্দর লাগে৷’’
পৃথিবীর সবচেয়ে জনবিরল মহাদেশে এমনটা ঘটে চলেছে৷
মাটিয়াস এবার্ট/এসবি
অ্যান্টার্কটিকায় তুরস্কের গবেষণাগার
প্রথমবারের মতো অ্যান্টার্কটিকায় নিজস্ব গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করলো তুরস্ক৷ এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ গবেষণায় অবদান রাখতে চায় দেশটি৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
বিশেষ অবদান সাহিকা এরকুমেনের
গবেষণাগারটি প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রেখেছেন তুরস্কের ডুবুরি সাহিকা এরকুমেন৷ বিশেষ প্রস্তুতি নিয়েই দলের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তিনি বরফ ঘেরা এ মহাদেশটিতে যাত্রা শুরু করেন৷
ছবি: picture-alliance/AA/O. Elif Kizil
সহজ ছিল না যাত্রা
গবেষণাগারটি প্রস্তুত করতে বড় জাহাজে করে প্রায় ছয় টন মালামাল সরবরাহ করতে হয়েছিল৷ এ সরবরাহ কাজে নিয়োজিত করা হয়েছে হেলিকপ্টারও৷ শেষ পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকার ৬৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি দ্বীপে সফলভাবেই স্থাপন করা হয় স্টেশনটি৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
রয়েছে আরো অনেকেই
অ্যান্টার্কটিকায় গবেষণা করার ক্ষেত্রে তুরস্কই প্রথম নয়৷ ১৯৫৯ সালে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গবেষণার জন্য অনেক দেশই আস্তানা গেড়েছে সেখানে৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
সৌন্দর্য নয়, মন দিন কাজে
অ্যান্টার্কটিকার মন ভোলানো সৌন্দর্যে মেতে থাকলে যে আর নিজেদের কাজ শেষ হয় না৷ বিশ্বের শীতলতম এ মহাদেশটিতে গবেষণা কাজ শুরুর আগে নিজেদের থাকার জায়গা ঠিক করতে দরকার হয় কঠোর পরিশ্রম৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
একা নন বিজ্ঞানীরা
অ্যান্টার্কটিকা বিচ্ছিন্ন মহাদেশ হলেও সেখানে একা নন বিজ্ঞানীরা৷ অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাতে রয়েছে সীল, পেঙ্গুইনসহ নানা ধরণের প্রাণী৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
আধুনিক প্রযুক্তিতে গবেষণা
গবেষণা কাজ চালানোর জন্য এখানকার বিজ্ঞানীরা আধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকেন৷ ইস্তানবুল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ওসগুন ওকটার গবেষণা কাজে ব্যবহার করছেন আধুনিক লেজার স্ক্যানিং সিস্টেম৷
ছবি: picture-alliance/AA/O.E. Kizil
সবকিছু প্রস্তুত!
যন্ত্রপাতিসমেত গবেষণাগারটি প্রস্তুত৷ কাজ শুরু করতে পারেন বিজ্ঞানীরা৷ এ গবেষণাগারের মধ্য দিয়ে পরিবেশ, প্রতিবেশ বিষয়ে নতুন কিছু খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র তুরস্ক৷