পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ ক্যানাডার আদালতে খারিজ হওয়ার পর বাংলাদেশে চলছে তুমুল আলোচনা৷ সংসদ সদস্যরা বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার দাবি তুলেছেন৷ তবে প্রধানমন্ত্রী কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানাননি৷
বিজ্ঞাপন
শুক্রবার ক্যানাডার সংবাদ মাধ্যম জানায়, সেখানকার আদালত পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগকে ‘গুজব ও অনুমান নির্ভর' হিসেবে অভিহিত করেছে৷ মামলার বিচারক নরডেইমার চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই রায় দিলেও শুক্রবার পর্যন্ত তা প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা ছিল৷
ক্যানাডার আদালত দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের সব উন্নয়ন প্রকল্পে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ক্যানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন৷ ওই রায়ে এসএনসি-লাভালিনের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালেস, প্রতিষ্ঠানটির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও বাংলাদেশ-ক্যানাডার দ্বৈত নাগরিক, ব্যবসায়ী জুলফিকার ভূইয়াকেও অব্যাহতি দেয়া হয়৷
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার পাঁচ কৌশল
বিশ্বব্যাংকের ‘গ্লোবাল ইন্ডিকেটরস গ্রুপ’-এর পরিচালক আওগুস্তো লোপেজ-কার্লোস এক ব্লগ পোস্টে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়ার কয়েকটি কৌশল আলোচনা করেছেন৷ ছবিঘরে থাকছে সে’সব কথা৷
ছবি: Getty Images
সরকারি চাকুরেদের জন্য ভালো বেতন
যাঁরা সরকারি চাকরি করেন তাঁদের বেতন যদি খুব কম হয়, তাহলে আয় বাড়াতে তাঁরা ‘অনানুষ্ঠানিক’ পথ অবলম্বন করতে পারেন৷ বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে সরকারি চাকুরেদের কম বেতন ও দুর্নীতির মধ্যে সম্পর্ক পাওয়া গেছে৷
ছবি: DW
অর্থ ব্যয়ে স্বচ্ছতা
যে সমস্ত দেশের নাগরিকদের সরকারি কর্মকাণ্ড পর্যালোচনার সুযোগ আছে সেসব দেশে দুর্নীতি কম হয়৷ অর্থাৎ যেখানে গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, শিক্ষিতের হার বেশি এবং সক্রিয় সুশীল সমাজ রয়েছে সেখানে দুর্নীতির হার কম৷ কেননা এর ফলে বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারের ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, সরকারের নীতি নিয়ে আলোচনা করা যায়৷
ছবি: Colourbox/Hin255
লাল ফিতার দৌরাত্ম কমানো
বিশ্বব্যাংকের ‘ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন বলছে, যে সব দেশে ব্যবসা শুরু করতে, সম্পত্তি নিবন্ধন করতে, আন্তর্জাতিক ব্যবসায় জড়িত হতে নানা ধরনের সার্টিফিকেট, আইন, লাইসেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে সে’সব দেশে দুর্নীতি বেশি হয়৷ তাই বিশ্বব্যাংকের এক গবেষক দুর্নীতির জন্ম দিতে পারে এমন আইনকানুন বাদ দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন৷
ছবি: DW
ভর্তুকি নয়
জ্বালানি খাতে ভর্তুকির নানা সমস্যা আছে৷ প্রায়ই এর সুবিধাভোগী হন ধনীরা৷ এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে কেনা জ্বালানি চোরাচালানের মাধ্যমে আর্থিকভাবে লাভবান হন অনেকে৷ তাই ভর্তুকির মতো ব্যয়বহুল পদ্ধতির চেয়ে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মানুষদের অর্থ সহায়তা দেয়া যেতে পারে৷
ছবি: DW/W.Jantschits
স্মার্ট প্রযুক্তির ব্যবহার
সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে নাগরিকদের সরাসরি যোগাযোগ যত কমানো যাবে, দুর্নীতি কমানো ততই সম্ভব হবে৷ এক্ষেত্রে বিভিন্নক্ষেত্রে ইন্টারনেটের সহায়তা নেয়া যেতে পারে৷ সরকারি কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনলাইনে টেন্ডার আহ্বানের মতো বিষয়াদি চালু করলে দুর্নীতির সুযোগ কমবে৷
ছবি: Getty Images
5 ছবি1 | 5
তখন অভিযোগ করা হয়েছিল, ‘‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে পাঁচ কোটি ডলারের কাজ পেতে এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তারা ২০১০ ও ২০১১ সালে বাংলাদেশের সেতু কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন৷''
ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের তখনকার যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রীত্ব ছাড়তে হয়, যোগাযোগ সচিব মোশারফ হোসেনকে জেলে যেতে হয়৷ তারপরও বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সঙ্গে পদ্মা সেতুতে ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে৷ তারপর অবশ্য সরকার নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করে৷
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনও পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত করে৷ তারা কোনো দুর্নীতির প্রমাণ না পওয়ার প্রতিবেদন দিলেও বিশ্বব্যাংক তা গ্রহণ করেনি৷ কিন্তু এবার ক্যানডার আদালতও দুর্নীতির অভিযোগ নাকচ করে দিল৷
বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংককে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন৷ আর সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন এক বিৃবতিতে বলেছেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের আনা দুর্নীতির অভিযোগটি পদ্মা সেতু ও আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল৷''
রবিবার রাতে সংসদে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার দাবি তুলেছেন সংসদ সদস্যরা৷ বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন সংসদে বলেন, ‘‘বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কারণে রাষ্ট্রের মর্যদাহানি হয়েছে৷ তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা উচিত৷ রাষ্ট্রের মর্যাদা পুনরুদ্ধারে রাষ্ট্রীয়ভাবে মামলা করতে হবে৷'' তিনি সরকারকে বাদী হয়ে বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দেন৷
সেরা দশ দুর্নীতির দেশ, সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ
এক সময়ের দুর্নীতির বিশ্বচ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ এবার হয়েছে ১৩তম৷ চলুন দেখা যাক ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআইবি)-র প্রতিবেদনে এবার কোন কোন দেশ আছে দুর্নীতির সেরা দশে আর কোন দশটি দেশে এখন দুর্নীতি সবচেয়ে কম৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
৮ থেকে ১০ নম্বরে কঠিন লড়াই
টিআইবি-র এবারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমান ১৮ পয়েন্ট করে পাওয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দশটি দেশের তালিকায় ৮ নাম্বার থেকে ১০ নাম্বার পর্যন্ত স্থানে রয়েছে উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়া৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
দুর্নীতির সপ্তম স্বর্গে তুর্কমেনিস্তান
উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়ার চেয়ে মাত্র এক পয়েন্ট কম হওয়ায় দুর্নীতিতে সেরা দশটি দেশের মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে তুর্কমেনিস্তান৷
ছবি: DW
ইরাকের দুরবস্থা
যুদ্ধ, হানাহানির মাঝে ইরাকে দুর্নীতিও চলছে পুরোদমে৷ তাই ১৬ পয়েন্ট নিয়ে তারা এখন দুর্নীতিতে সেরা দেশগুলোর মধ্যে ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: Reuters
পঞ্চম স্থানে দক্ষিণ সুদান
ইরাকের পরেই রয়েছে সদ্য স্বাধীন দেশ দক্ষিণ সুদান৷ তারা পেয়েছে ১৫ পয়েন্ট৷
ছবি: Getty Images/AFP/T. Karumba
আফগানিস্তান দুর্নীতিরও স্থান
দুর্নীতিরও স্থান না হলে আফগানিস্তান কি আর ১২ পয়েন্ট নিয়ে বিশ্বের চতুর্থ সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হতো?
ছবি: Getty Images/AFP/S. Marai
দক্ষিণ সুদানের চেয়ে দুর্নীতিতে এগিয়ে সুদান
সুদান থেকে আলাদা হয়ে দক্ষিণ সুদান শুধু মানচিত্রেই নয়, দুর্নীতিতেও কিছুটা ব্যবধান দেখাতে পেরেছে৷ দক্ষিণ সুদান যখন সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে পঞ্চম স্থানে, সুদান তখন ১১ পয়েন্ট নিয়ে তৃতীয়৷ দুর্নীতিতে এগিয়ে থাকা তো আর ভালো কথা নয়!
ছবি: getty / C. Bouroncle
উত্তর কোরিয়া আর সোমালিয়া
সমাজতন্ত্র কায়েমের পথে হোঁচট খেয়ে প্রায় মুখ থুবড়ে পড়লেও দুর্নীতিতে খুব এগিয়েছে উত্তর কোরিয়া৷ আফ্রিকার দারিদ্র্য জর্জরিত দেশ সোমালিয়াও কম যায় না৷ ৮ পয়েন্ট করে নিয়ে এই দুই দেশই আছে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance/dpa/R. Sinmun
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশ ডেনমার্ক
নারীর জন্য সবচেয়ে ভালো দেশ হওয়ার পর, এবার সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশও হয়েছে ডেনমার্ক৷ স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এই দেশ পেয়েছে ৯২ পয়েন্ট৷
ছবি: Reuters/N. Ahlmann Olesen
দ্বিতীয় নিউজিল্যান্ড, তৃতীয় ফিনল্যান্ড
সবচেয়ে কম দুর্নীতির দেশগুলোর মাঝে নিউজিল্যান্ড ৯১ পয়েন্ট নিয়ে আছে দ্বিতীয় স্থানে আর ৮৯ পয়েন্ট পেয়ে ফিনল্যান্ড দ্বিতীয় স্থানে৷
ছবি: picture alliance / Robert Harding
চতুর্থ স্থানে সুইডেন
আরেক স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ সুইডেনও কম দুর্নীতিগ্রস্থ দেশগুলোর মাঝে খুব ভালো অবস্থানে৷ তাদের পয়েন্ট ৮৭, অবস্থান চতুর্থ৷
ছবি: DW/T. Mehretu
নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ডে সমতা
৮৬ পয়েন্ট করে পেয়েছে নরওয়ে আর সুইজারল্যান্ড৷ ফলে দেশ দু’টি আছে পঞ্চম এবং ষষ্ঠ স্থানে৷
ছবি: EBU
একের হেরফেরে সাত থেকে দশ
সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দশ দেশের তালিকায় সপ্তম থেকে দশম স্থানে আছে যথাক্রমে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবুর্গ এবং ক্যানাডা৷ সপ্তম থেকে দশম, অষ্টম, নবম ও দশমে মাত্র এক পয়েন্ট করে ব্যবধান৷ সিঙ্গাপুরের ৮৪, নেদারল্যান্ডসের ৮৩, লুক্সেমবুর্গের ৮২ এবং ক্যানাডার পয়েন্ট ৮১৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Antonisse
12 ছবি1 | 12
বিশ্বব্যাংক অভিযোগ তোলার পর ‘দুর্নীতি' নিয়ে সোচ্চার ছিল তখনকার বিরোধী দল বিএনপি৷ তবে ক্যানাডার আদালতের রায়ের পর বিএনপির মাহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘‘পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজ করে ক্যানাডার আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা বিএনপির বিবেচনার বিষয় নয়৷ পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তাদের অর্থ বন্ধ করে দিয়েছিল, এটাই বাস্তবতা৷''
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-ও তখন বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চেয়েছিল৷ ক্যানাডার আদালতের রায়ের পর টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হ্যাঁ, আমাদের কথামতো তখন নিরপেক্ষ তদন্ত হলে তখনই সত্য বেরিয়ে আসতো, দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতো না৷ এখন সরকারের উচিৎ বিশ্ব ব্যাংকের আছে জবাবহিতা চওয়া৷ আর এটা একটি প্রক্রিয়ার মাধমে চাইতে পারে বাংলাদেশ৷''
তখন দুদক তদন্ত করেছিল এবং তারা দুর্নীতির প্রমাণ পায়নি৷ সেই প্রেক্ষাপটে সুলতানা কামাল বলেন, ‘‘দুদকের তদন্ত তো বিশ্বব্যাংক গ্রহণ করেনি৷ তাই আমরা বলেছিলাম, সবারকাছে গ্রহণযোগ্য একটা তদন্তের কথা৷''
ক্যানাডার আদালতের রায়ের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি বিশ্বব্যাংক৷ তবে ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর জিমিয়াও ফান-এর পক্ষে ই-মেইলে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো প্রতিক্রিয়ায় বলা হয়েছে, ‘‘বিশ্বব্যাংক তার অর্থায়িত প্রকল্পে ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে থাকে৷ যখন বিশ্বব্যাংকের একটি তদন্ত শেষ হয়, তখন সেই তদন্তের অনুসন্ধান পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট দেশকে৷ যেন তারা বিবেচনায় নিতে পারে যে, এর মধ্য দিয়ে তাদের জাতীয় আইন ক্ষুন্ন হয়েছে কিনা৷ পরবর্তীতে সেই সংশ্লিষ্ট দেশের পর্যবেক্ষণ বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়৷ প্রকাশিত পর্যবেক্ষণ সেই দেশকেই দেওয়া হয়৷''