বিশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত ঘটে
১৯ আগস্ট ২০১১![Ukrainian people celebrate in front of the parliament in capital Kiev on August 24, 1991, the day when Ukraine's independence was declared. Since then August 24 is marked throughout the country as the national holiday. One of fifteen former Soviet Republics, Ukraine obtained independence after the Soviet Union collapsed. (AP Photo/Efrem Lukatsky, file)](https://static.dw.com/image/6574385_800.webp)
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অবক্ষয়ের চিহ্ন সুস্পষ্ট৷ শিল্পে উৎপাদন কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে, সেই সঙ্গে আছে লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি৷ জাতিগত বিরোধ বাড়ছে; জর্জিয়া, আজারবাইজানে গুলি চলছে৷ সোভিয়েত গণরাজ্যগুলির মধ্যে লিথুয়ানিয়া প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং সেটা ১৯৯০ সালেই৷ ১৯৯১'এর জানুয়ারিতে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে গোয়েন্দা পুলিশ কেজিবি'র বিশেষ কম্যান্ডো পাঠানো হয় মস্কো থেকে৷ সেখানকার টেলিভিশন টাওয়ারে কেজিবি'র অভিযানে ১৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়৷ তা সত্ত্বেও লিথুয়ানিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরানো যায়নি৷
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ আজ বলেন: ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচানো সম্ভব ছিল এবং তা উচিৎও ছিল৷'' গর্বাচভ চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক নতুন, আধুনিকতর সংস্করণ, যা তার অঙ্গ গণরাজ্যগুলিকে আরো বেশি সায়ত্তশাসন দেবে৷ ১৯৯১'এর মার্চে এই নিয়ে গণভোটও হয়েছিল এবং তা'তে নাকি বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল৷ এই নয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন কেমন হবে, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনায় কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয়নি - ১৫টি গণরাজ্যের মধ্যে মাত্র ন'টি তা'তে অংশগ্রহণ করে৷ গর্বাচভ একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেন ঠিকই৷ সেটা হবার কথা বিশে অগাস্ট৷ কিন্তু তার আগের দিনই ঘটে পশ্চিমে যা আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল: গর্বাচভের বিরুদ্ধে কট্টর সোভিয়েতপন্থিদের অভ্যুত্থান, যাদের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেজিবি প্রধান ইত্যাদিরা ছিলেন৷
গর্বাচভ অসুস্থ, বলে তাঁকে ক্রিমিয়ায় তাঁর ছুটি কাটানোর বাড়িতে সপরিবারে বন্ধ করে রাখা হয়৷ বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে জরুরি অবস্থা জারি করে মস্কোর রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামানো হয়৷ এই পন্থায় নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘‘বিপর্যয়ের'' হাত থেকে রক্ষা করা হবে৷ অভ্যুত্থানকারিদের একমাত্র ভুল ছিল, রাশিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন যে কি ধাতের মানুষ অথবা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, সেটা তারা ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি৷ মস্কোয় ইয়েলৎসিন'এর কর্মস্থল সেই সাদা রঙের বহুতল বাড়িটির সামনে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করে, অভ্যুত্থানকারিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে৷ আশ্চর্য, পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তই থাকে, শুধু মস্কোর পথে রাতে ট্যাঙ্ক বাহিনী যাবার সময় তিনজন মানুষ প্রাণ হারায়৷ তিনদিন পরে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়৷ গর্বাচভ মস্কোয় ফেরেন, তাঁর চেহারায় ধকলের চিহ্ন স্পষ্ট৷ পরিবর্তে বরিস ইয়েলৎসিনের ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ছবি তখন বিশ্বের সব পত্রিকার প্রথম পাতায়৷
অভ্যুত্থানকারিদের সকলকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের মধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যাও করে৷ কিন্তু বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তকে আরো এগিয়ে আনে তারাই৷ অগাস্টের সেই টালমাটাল দিনগুলিতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়ে এস্টোনিয়া৷ পরে দলছুট হয় ইউক্রেইন এবং অন্যান্য গণরাজ্য৷ গর্বাচভ তাঁর নতুন চুক্তি নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান৷ কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই রাশিয়া, ইউক্রেইন এবং বেলারুশ তাদের নিজেদের স্বাধীন জোট সৃষ্টি করে৷ সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয় ১৯৯১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর৷ গর্বাচভ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পদত্যাগ করেন৷
বিশ্বের এক পরাশক্তির এ'ভাবে মুহূর্তে অন্তর্ধান কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব ইউরোপ বিশেষজ্ঞ গেরহার্ড জিমন'এর কাছে আজও একটা ধাঁধা৷ পরাশক্তি? জিমন বলেন: ‘‘পরমাণু বোমায় তারা শক্তিশালী ছিল বৈকি৷ তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না৷'' পশ্চিমের দৃষ্টান্তটা ছিল বলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষমেষ মাটিতে মিশে গেল, বলে জিমনের ধারণা৷ জিমনের ভাষায়: ‘‘সোভিয়েত আদর্শ এবং প্রচারণার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, তারা প্রথম থেকেই পশ্চিমের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করেছে৷ অর্থাৎ তারা নিজেরাই ফাঁসির দড়ি নিজেদের গলায় পরেছে৷'' উন্নততর অর্থনীতি, বৃহত্তর স্বাধীনতার সেই ‘স্বর্ণময় পশ্চিম' - জামা, জুতো, গাড়ি, প্রসাধনদ্রব্য - লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত নাগরিক যে সব ভোগ্যপণ্যের স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু কোনোদিন হাতের নাগালে পায়নি৷ মানুষ তো মানুষই৷
প্রতিবেদন: রোমান গঞ্চারেঙ্কো/অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ