বিশ বছর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত ঘটে
১৯ আগস্ট ২০১১১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অবক্ষয়ের চিহ্ন সুস্পষ্ট৷ শিল্পে উৎপাদন কমছে, বেকারত্ব বাড়ছে, সেই সঙ্গে আছে লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতি৷ জাতিগত বিরোধ বাড়ছে; জর্জিয়া, আজারবাইজানে গুলি চলছে৷ সোভিয়েত গণরাজ্যগুলির মধ্যে লিথুয়ানিয়া প্রথমে স্বাধীনতা ঘোষণা করে, এবং সেটা ১৯৯০ সালেই৷ ১৯৯১'এর জানুয়ারিতে লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে গোয়েন্দা পুলিশ কেজিবি'র বিশেষ কম্যান্ডো পাঠানো হয় মস্কো থেকে৷ সেখানকার টেলিভিশন টাওয়ারে কেজিবি'র অভিযানে ১৪ জন মানুষ প্রাণ হারায়৷ তা সত্ত্বেও লিথুয়ানিয়াকে সোভিয়েত ইউনিয়নে ফেরানো যায়নি৷
সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ আজ বলেন: ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নকে বাঁচানো সম্ভব ছিল এবং তা উচিৎও ছিল৷'' গর্বাচভ চেয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের এক নতুন, আধুনিকতর সংস্করণ, যা তার অঙ্গ গণরাজ্যগুলিকে আরো বেশি সায়ত্তশাসন দেবে৷ ১৯৯১'এর মার্চে এই নিয়ে গণভোটও হয়েছিল এবং তা'তে নাকি বিপুল সাড়া পাওয়া গিয়েছিল৷ এই নয়া সোভিয়েত ইউনিয়ন কেমন হবে, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনায় কিন্তু বিশেষ সুবিধা হয়নি - ১৫টি গণরাজ্যের মধ্যে মাত্র ন'টি তা'তে অংশগ্রহণ করে৷ গর্বাচভ একটি নতুন চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করেন ঠিকই৷ সেটা হবার কথা বিশে অগাস্ট৷ কিন্তু তার আগের দিনই ঘটে পশ্চিমে যা আগে থেকেই আশঙ্কা করা হচ্ছিল: গর্বাচভের বিরুদ্ধে কট্টর সোভিয়েতপন্থিদের অভ্যুত্থান, যাদের মধ্যে প্রতিরক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, কেজিবি প্রধান ইত্যাদিরা ছিলেন৷
গর্বাচভ অসুস্থ, বলে তাঁকে ক্রিমিয়ায় তাঁর ছুটি কাটানোর বাড়িতে সপরিবারে বন্ধ করে রাখা হয়৷ বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন৷ সোভিয়েত ইউনিয়নে জরুরি অবস্থা জারি করে মস্কোর রাস্তায় ট্যাঙ্ক নামানো হয়৷ এই পন্থায় নাকি সোভিয়েত ইউনিয়নকে ‘‘বিপর্যয়ের'' হাত থেকে রক্ষা করা হবে৷ অভ্যুত্থানকারিদের একমাত্র ভুল ছিল, রাশিয়ার নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিন যে কি ধাতের মানুষ অথবা কোন ধাতু দিয়ে তৈরি, সেটা তারা ঠিক আন্দাজ করতে পারেনি৷ মস্কোয় ইয়েলৎসিন'এর কর্মস্থল সেই সাদা রঙের বহুতল বাড়িটির সামনে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হতে শুরু করে, অভ্যুত্থানকারিদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে৷ আশ্চর্য, পরিস্থিতি মোটামুটি শান্তই থাকে, শুধু মস্কোর পথে রাতে ট্যাঙ্ক বাহিনী যাবার সময় তিনজন মানুষ প্রাণ হারায়৷ তিনদিন পরে জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়া হয়৷ গর্বাচভ মস্কোয় ফেরেন, তাঁর চেহারায় ধকলের চিহ্ন স্পষ্ট৷ পরিবর্তে বরিস ইয়েলৎসিনের ট্যাঙ্কের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ছবি তখন বিশ্বের সব পত্রিকার প্রথম পাতায়৷
অভ্যুত্থানকারিদের সকলকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ তাদের মধ্যে কয়েকজন আত্মহত্যাও করে৷ কিন্তু বস্তুত সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তকে আরো এগিয়ে আনে তারাই৷ অগাস্টের সেই টালমাটাল দিনগুলিতেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়ে এস্টোনিয়া৷ পরে দলছুট হয় ইউক্রেইন এবং অন্যান্য গণরাজ্য৷ গর্বাচভ তাঁর নতুন চুক্তি নিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যান৷ কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই রাশিয়া, ইউক্রেইন এবং বেলারুশ তাদের নিজেদের স্বাধীন জোট সৃষ্টি করে৷ সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয় ১৯৯১ সালের ২৬শে ডিসেম্বর৷ গর্বাচভ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে পদত্যাগ করেন৷
বিশ্বের এক পরাশক্তির এ'ভাবে মুহূর্তে অন্তর্ধান কোলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব ইউরোপ বিশেষজ্ঞ গেরহার্ড জিমন'এর কাছে আজও একটা ধাঁধা৷ পরাশক্তি? জিমন বলেন: ‘‘পরমাণু বোমায় তারা শক্তিশালী ছিল বৈকি৷ তবে অর্থনীতির ক্ষেত্রে সোভিয়েত ইউনিয়নের কোনোদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না৷'' পশ্চিমের দৃষ্টান্তটা ছিল বলেই সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষমেষ মাটিতে মিশে গেল, বলে জিমনের ধারণা৷ জিমনের ভাষায়: ‘‘সোভিয়েত আদর্শ এবং প্রচারণার সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, তারা প্রথম থেকেই পশ্চিমের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করেছে৷ অর্থাৎ তারা নিজেরাই ফাঁসির দড়ি নিজেদের গলায় পরেছে৷'' উন্নততর অর্থনীতি, বৃহত্তর স্বাধীনতার সেই ‘স্বর্ণময় পশ্চিম' - জামা, জুতো, গাড়ি, প্রসাধনদ্রব্য - লক্ষ লক্ষ সোভিয়েত নাগরিক যে সব ভোগ্যপণ্যের স্বপ্ন দেখেছে, কিন্তু কোনোদিন হাতের নাগালে পায়নি৷ মানুষ তো মানুষই৷
প্রতিবেদন: রোমান গঞ্চারেঙ্কো/অরুণ শঙ্কর চৌধুরী
সম্পাদনা: দেবারতি গুহ