রোগী যেন গবেষণাগারের গিনিপিগ৷ চিকিৎসক কখনো ওষুধ দেন, কখনো আবার পরামর্শ৷ অথচ কারো কারো একটাতেই কাজ চলে৷ কিন্তু কার কোনটা দরকার সেটা বোঝার উপায় কী? এ নিয়ে এতদিনের সংশয় বোধহয় দূর হতে চলেছে৷
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ৬৭ জন বিষাদগ্রস্তকে নিয়ে একটি গবেষণা চালিয়েছেন৷ ৬৭ জনের মধ্যে ৪০ জনের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে তাঁরা দেখেছেন, তাঁদের জন্য ওষুধ লাগবে, নাকি মনশ্চিকিৎসক অথবা মনস্তত্ত্ববিদের পরামর্শই কার্যকর হবে – সেটা আগেই বলে দেয়া সম্ভব৷ আসলে ইনসুলার কর্টেক্স বা ইনসুলাই বলে দেয় কার জন্য কোন চিকিৎসাটা কার্যকর৷
জার্মানির এক তৃতীয়াংশ মানুষ বিষণ্ণতায় ভোগেন
আবহাওয়া কি আপনার মনেও প্রভাব ফেলে?
ছবি: imago/CHROMORANGE
শরীর ও মনে আবহাওয়ার প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তন সারা বিশ্বেই প্রভাব ফেলেছে৷ জার্মানির মনোরোগ ক্লিনিকের হিসেবে আনুমানিক দুই কোটি ৫০ হাজারেরও বেশি জার্মান আবহাওয়ার কারণে মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করেন৷ কোনো না কোনোভাবে তাঁরা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার৷ তবে পুরুষদের তুলনায় মেয়েরাই বিষণ্ণতায় বেশি ভোগেন৷ অন্যদিকে, তরুণদের চেয়ে বয়স্করা যেমন বেশি ভোগেন, তেমনই সুস্থ মানুষদের চেয়ে অসুস্থদের সমস্যা বেশি হয়৷
ছবি: Fotolia/Adam Gregor
ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা
এখন আর আগের মতো সময় হিসেব করে কোনো কিছুই করা যেন সম্ভব হয়না, বাঁধ সাধে আবহাওয়া৷ অসময়ে বৃষ্টি, রোদ, ঝড়, ঠাণ্ডা বা গরম৷ আগে যেমনটা শোনা যেত বর্ষা, গরম বা শীতের অসুখ, এখন সারা বছরই মানুষের নানা অসুখ-বিসুখ লেগে আছে৷ তবে অসুখ কি শুধু শরীরের? না, মনকেও যে নানাভাবে আক্রান্ত করে এই উল্টোপাল্টা আবহাওয়া৷
ছবি: AFP/Getty Images
মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে
জার্মানিতে এবারের শীত সবাইকেই কাঁপিয়ে দিয়ে গেছে৷ বলা যায়, এ বছর পুরো শীত ছিল প্রায় সাত মাস আর এখন জুন মাসেও মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে শীত পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি৷ একদিন যদি একটু রোদের দেখা মেলে তো পরেরদিন আবার বৃষ্টি, অন্ধকার আর ঠাণ্ডা, সাথে প্রচণ্ড হাওয়া৷ এভাবেই চলছে গত কয়েকমাস থেকে৷ আর এই আবহাওয়ায় শরীর মন ঠিক রাখতে না পেরে মানুষ হাঁপিয়ে উঠেছে৷
ছবি: Fotolia/Creativa
বন্যা
গত কয়েক বছর থেকে অতি বৃষ্টির ফলে প্রায় প্রতিবছরই কম বেশি বন্যা হচ্ছে জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়৷ যার ফলে গত কিছুদিনে জার্মানির বিভিন্ন অঞ্চলে নদীর পানি বেড়ে গেছে৷ কোলন এবং বন শহরে রাইন নদীর তীরে হাঁটতে যাওয়াও এখন একেবারেই বন্ধ৷ সেখানে ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে ‘সাবধান’ লেখা সাইনবোর্ড৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উইন্টার ডিপ্রেশন বা শীতকালের বিষণ্ণতা
বলা হয়, হেমন্ত থেকে বসন্ত পর্যন্ত শীতের বিষণ্ণতায় সময় কাটান জার্মানির মানুষ৷ শীতের পর যখন বসন্ত আসে, অর্থাৎ পাখির কিচিরমিচির, খানিকটা ঝকঝকে রোদের আলো দেখা দেয় দিগন্তে, তখন মানুষের চেহারায় আসে এক ধরণের উজ্জ্বলতা৷ সব কিছুতেই যেন তখন আনন্দের ছোঁয়া৷ গরমকে স্বাগত জানাতে মানুষ করে নানা পরিকল্পনা৷ কিন্তু এ বছর এখনও যে তার কিছুই বোঝা যাচ্ছে না!
ছবি: DW/S. Wünsch
ডাক্তারের মতামত
কয়েক বছর আগে অবসাদগ্রস্থ রোগীদের সমস্যার মধ্যে থাকতো মাথা ব্যথা বা ঘোরা, কম ঘুম হওয়া, বাতের ব্যথা, হাঁড়ে ব্যথা ইত্যাদি৷ এখন বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এতটাই এলোমেলো সব যে, মানুষের সাধারণ মাথা ব্যথার সাথে যোগ হয়েছে মাইগ্রেনও৷ কাজ বা অন্য যে কোনো ব্যাপারেই কম আগ্রহ বা অমনোযোগ৷ অল্পতেই রেগে যাওয়া বা খাবারে অরুচি ইত্যাদি৷ কেউ কেউ আবার হার্টেরও সমস্যা বোধ করেন৷
ছবি: Fotolia/Peter Atkins
ছেলেরাও মাইগ্রেনের স্বীকার
এ ব্যথা সে ব্যথা নয়, রীতিমতো মাইগ্রেন৷ রাতে ঘুমের ভেতরই কখনও হয়ত এই ব্যথা শুরু হয়৷ মাইগ্রেনের সমস্যা আজকাল শুধু মেয়েদেরই নয়, প্রায় সময় ছেলেরাও অভিযোগ করেন এ সমস্যা নিয়ে, বিশেষ করে তাপমাত্রা এত ঘনঘন ওঠানামার কারণে৷ মাইগ্রেনের জন্য অনেককে কিন্তু নিয়মিত অসুধও খেতে হয়৷
ছবি: Fotolia/Amir Kaljikovic
ভিটামিন-ডি
আমাদের দেশে দেখেছি ছোট বাচ্চাদের গায়ে তেল দিয়ে রোদে শুইয়ে রাখা হতো ভিটামিন-ডি গ্রহণের জন্য৷ তবে বড়দের ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যেত না, রোদই সেটা পুষিয়ে দিত৷ কিন্তু এখন আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে অনেককে নিয়মিত ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট খেতে হচ্ছে৷ জার্মানিতেও বাচ্চা হলে তাকে ভিটামিন-ডি ট্যাবলেট দুধের সাথে গুলিয়ে খাওয়ানো হয়৷ লক্ষ্যণীয়, রোদের অভাবে মানুষের মধ্যে আগের তুলনায় হাশিখুশি ভাবটাও যেন কমে যাচ্ছে৷
ছবি: DW/K. Hairsine
আগে থেকেই প্রস্তুতি
অনেকেই গত গরমের সময় সস্তায় কাপড়-চোপড় কিনে রেখেছেন এই গরমে পড়বেন বলে৷ কিন্তু তার যে তেমন কোনো সম্ভবনাই দেখা যাচ্ছে না৷ কাপড়গুলো ঝুলছে সেই আলমারিতেই৷ তাই সব প্রস্তুতিই এখন বৃথা৷
ছবি: DW/M.Braun
চলো যাই রোদের দেশে!
বিশ্বে জার্মানরা এমনিতেই ভ্রমণপ্রেমীদের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে৷ আর এবার, লম্বা শীতের ডিপ্রেশনকে মোকাবিলা করতে ছটিতে যাওয়ার ইচ্ছে যেন আরো বেড়ে গেছে৷ ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলো কিছুটা উষ্ণতা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে যাওয়ার বিজ্ঞাপণ দিয়ে চলেছে৷ ইন্টারনেটেও রয়েছে আকর্ষণীয় অফার – তিউনিশিয়া, মালটা, স্পেন, ইটালি, মিশর, ব্রাজিল বা অন্যান্য দেশের সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার কত লোভনীয় হাতছানি!
ছবি: picture-alliance/Bildagentur Huber
বাগান প্রেমীরা বিষণ্ণ
বাগান প্রেমীরা বাগানে কাজ করতে পারছেন না, ফলে খুবই মনোকষ্টে আছেন তাঁরা৷ গত বছর ঠিক এ সময়ে বাগানে বাগানে ছিল প্রচুর ফুল আর ফল৷ যে ফুল ফোটার কথা ছিল গত এপ্রিল মাসে, সেগুলোই এই জুন মাসে অবশেষে একটু একটু করে ফুটতে শুরু করেছে৷
ছবি: picture-alliance/empics
বিষণ্ণতা থেকে নেশা
ঘরে বসে কিছু করার নেই, তাই কেউ কেউ মদ্যপানের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন৷ বেড়ে যাচ্ছে ধূমপান এবং অন্যান্য নেশাও৷ পছন্দের কিছু থাকুক আর না থাকুক, অনেকে সারাদিনই বসে থাকছেন টিভির সামনে আর খেয়ে চলছেন নানা রকম ফাস্টফুড বা অন্য কোনো তেলেভাজা জিনিস৷ ফলে ওজন তো বাড়েই, ডিপ্রেশনের মাত্রাও যায় বেড়ে৷ অনেকে আবার সহ্য করতে না পেরে বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথও৷
ছবি: Fotolia/lassedesignen
বিষণ্ণতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. ভলকার ফাউস্ট বলেন, আবহাওয়ার কারণে বিষণ্ণ বা অবসাদগ্রস্থ মানুষদের সুস্থ থাকার জন্য কি করা দরকার, তা নিয়ে বহু আলোচনা হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন খুব কম৷ যেহেতু আবহাওয়ার ব্যাপারে মানুষের তেমন কিছু করার নেই, তাই তা মেনে নেওয়া ছাড়া তেমন কোনো উপায়ও নেই৷
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
প্রতিদিন কিছুটা ব্যায়াম করুন, হাঁটুন৷ তাহলে ভালো ঘুম হবে৷ ফিটনেস সেন্টারে যাওয়া সম্ভব না হলে টিভিতেই ব্যায়ামের অনুশীলন দেখে দেখে সাথে করুন৷ প্রতিদিন হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে পরে ঠাণ্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে গা মুছে ফেলুন৷ গান শুনুন, ভালো বই পড়ুন৷ বন্ধুদের সাথে প্রাণ খুলে হাসুন, আড্ডা দিন, সিনেমা দেখুন৷ সোজা কথা, চিত্ত বিনোদনের জন্য যা করার এবং নিজের যা ভালো লাগে – সব করুন৷
ছবি: Fotolia/putilov_denis
বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই
সব শেষে বলা যায়, কিছু নিয়ম-কানুন মেনে চললে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না৷ যাতে মানুষের হাত নেই, তা ভেবে অসুস্থ হওয়ার কোনো যুক্তিও নেই৷ একথা মনে রাখলে যে কেউ কিছুটা হলেও সুস্থ বোধ করবেন, অন্তত মনের দিক থেকে৷ দেশের জন্য বা মানুষের জন্য কিছু করা সম্ভব হলে তার চেষ্টা করুন৷ তখন মন থাকবে নিজের আয়ত্বে, যেখানে বিষণ্ণতার তেমন কোনো জায়গা থাকবে না৷
ছবি: imago/CHROMORANGE
15 ছবি1 | 15
কানের ঠিক ওপরে থাকে ইনসুলা৷ গবেষকরা দেখেছেন, যাঁদের ইনসুলায় গ্লুকোজ বেশি, তাঁদের কোনো ওষুধ না খেয়ে, শুধু মনশ্চিকিৎসা নিলেই চলে৷ তবে ইনসুলা বেশি সক্রিয় নয় বলে গ্লুকোজ যাঁদের কম থাকে, তাঁদের ওষুধ খাওয়া ছাড়া গতি নেই৷ গবেষকরা অবশ্য দাবি করছেন না যে, এক্ষুনি চূড়ান্ত কথা বলার সময় এসে গেছে৷ তাঁরাও মনে করেন, বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখার প্রয়োজন আছে৷
তবে শেষ পর্যন্ত যদি তাঁদের অনুমান সত্যি হয়, তাহলে যে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের উপকার হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ জীবনে আনন্দের মতো বিষাদ কার জীবনে না আসে! বিষাদের মাত্রা বেশি হলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন অনেকে৷ সে অবস্থায় কেউ কেউ আত্মহননের পথও বেছে নেন৷ সেই পর্যায়ে যাবার আগেই দরকার সুচিকিৎসা৷ কিন্তু সুচিকিৎসা কোথায় আছে?
জার্মানির বন ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের মনশ্চিকিৎসক ভল্ফগাং মায়ার জানালেন, বিষাদগ্রস্থ রোগীদের সবচেয়ে বড় সমস্যার কথা৷ তাঁর মতে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগী কোনো মনশ্চিকিৎসক অথবা মনস্তাত্ত্বিকের কাছে গেলে তিনি মনশ্চিকিৎসাই চালিয়ে যান৷ ওষুধের দরকার আছে কিনা তা খুব কমই ভেবে দেখেন৷ আবার সাধারণ ডাক্তারদের কাছে গেলে তাঁরা শুধু ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত, রোগীর মানসিকতায় পরিবর্তন আনার বিকল্প রাস্তাটিতে রোগীকে তাঁরা পাঠান না৷ যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের অ্যাটলান্টার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের উদ্ভাবনটি যদি শেষ পর্যন্ত সত্যি প্রমাণিত হয়, তাহলে বিষাদগ্রস্থরা এই বিপদ থেকে রেহাই তো পাবেনই!