বিহারের উত্তরাঞ্চলে ২০০৮ সালে কোশী নদীর ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলার ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেয়নি ভারত৷ এ বছর আবারও কোশী নদীর জল বিপদসীমার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে৷ বন্যার আশঙ্কা নেপাল সংলগ্ন বিহারের ৯টি জেলায়৷ কিন্তু কেন এই ব্যর্থতা?
বিজ্ঞাপন
ভারত-বাংলাদেশের মতো ভারত-নেপালের অভিন্ন নদীগুলির অনিয়ন্ত্রিত জলপ্রবাহ সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নদীর উজানে অবস্থিত দেশের নদীর জল ছাড়লে প্লাবিত হয় ভাটির দিকের দেশ৷ ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদীগুলির জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের সমস্যা আজও অমিমাংসিত৷ তিস্তা, গঙ্গাসহ ৫৪টির মতো নদী ও শাখানদীর জল ভারত কতটা বাঁধ দিয়ে আটকে রাখবে এবং বর্ষার সময় কতটা জল ছাড়বে – তা নিয়ে দু'দেশের মধ্যে মতভেদ দূর হয়নি৷ এর প্রেক্ষিতে ভারত-বাংলাদেশ বা ভারত-নেপালের মধ্যে একটি যৌথ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠনে দাবি উঠেছে৷
ছবিতে বিহার-এর বন্যা পরিস্থিতি
ছবি: CARE
কেয়ার ক্যাম্প, বিহার
বিহারের একটি কেয়ার ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন বহু মানুষ৷ সবকিছু ফেলে আসা এই মানুষগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে খাবার-দাবার, ওষুধপত্র৷
ছবি: CARE
বন্যা প্লাবিত ঘরবাড়ী
গৃহপালিত জন্তু জানোয়ারও বন্যার আগ্রাসী পানি থেকে রেহাই পেতে সচেষ্ট ...
নেপালে টানা বৃষ্টির জেরে নেপালের দিকে নামে ভূমিধস৷ কোশীর উপনদী সঙ্কোশীর গতিপথ আটকে গিয়ে নেপালের ভোটী কোশীতে তৈরি হয় এক বিশাল কৃত্রিম হ্রদ৷ ভোটী কোশী পড়ে সপ্তকোশীতে, যা মেশে বিহারের কোশী নদীতে৷ প্রায় ২৮ থেকে ৩২ লাখ কিউসেক জল জমা হয় ঐ হ্রদে৷ নেপালের সেনারা ভূমিধস সরাতে ডিনামাইট ব্যবহার করে৷ আটকে পড়া জল ছাড়া হলে উত্তর বিহারের ৯টি জেলা ভেসে যাবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ জলের তোড়ে হড়পা বান দেখা দিতে পারে৷ প্রায় ৪০ হাজার পরিবারকে জোর করে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়৷ জারি করা হয় উচ্চ সতর্কতা৷ স্থাপন করা হয় ৭৬টি ত্রাণ শিবির৷ ঐ সব এলাকার স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়৷ মোতায়েন করা হয় জাতীয় বিপর্যয় ব্যবস্থাপনা কর্মীদের৷ জরুরি উদ্ধার কাজের জন্য তৈরি রাখা হয়েছে ভারি বিমান এবং হেলিকপ্টার৷ বিহারে কোশী নদীর জলস্তর বাড়তে পারে ১০-১২ মিটার৷ সেক্ষেত্রে নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে নদী সন্নিহিত কয়েক হাজার গ্রাম, এমনটাই আশঙ্কা করছেন কোশী নদীর বন্যা বিশেষজ্ঞরা৷
বন্যা নিয়ে বিপাকে ভারত
মৌসুমি বৃষ্টিপাতের কারণে ভারতের উত্তরাঞ্চলে গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বন্যা চলছে৷ অতিরিক্ত পানি একস্থান থেকে অন্যত্র সরার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে উঠছে ক্ষতচিহ্ন৷
ছবি: AP
প্রকৃতির বিধ্বংসী রূপ
বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর একটি হিন্দুদের পবিত্র শহর কেদারনাথ৷ হিন্দু উৎসব উপলক্ষ্যে এখানে কয়েক লাখ পুণ্যার্থী হাজির হয়েছিলেন৷ অষ্টমম শতাব্দীতে তৈরি এই মন্দিরের চারপাশে বন্যার ফলে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি দেখা যাচ্ছে ছবিতে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
পর্যটন কেন্দ্র
হিন্দুদের পুণ্যস্থান এবং মন্দির দেখতে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক হিমালয় অঞ্চলে যান৷ মে এবং জুন মাসে সেখানে পর্যটকদের ভিড় হয় সবচেয়ে বেশি৷ গত জুনমাসে রেকর্ড তাপদাহের পর ভারতের আবহাওয়া দপ্তর ধারণা করেছিল, জুন মাসে ভারি বৃষ্টিপাত হতে পারে৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
সবকিছু ধুয়েমুছে সাফ
বন্যার পানিতে ডুবে থাকা এই ট্রাকটির চারপাশে ময়লা আটকে গেছে৷ পানি আর কাদার তোড়ে ভেসে গেছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট এবং সেতু৷ কেদারনাথের আশেপাশের ৬০টি গ্রাম কার্যত মাটিতে মিশে গেছে৷ কিছু জায়গায় ভূমিধসের পরিমাণ তিন মিটার পর্যন্ত উঁচু৷
ছবি: STRDEL/AFP/Getty Images
পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন
এই অঞ্চলের অধিবাসীরা বাৎসরিক মৌসুমি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে পরিচিত৷ তবে এ বছর ভারি বৃষ্টি প্রত্যাশিত সময়ের আগেই শুরু হয়৷ ফলে বিপাকে পড়েন কয়েক লাখ স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটক৷ বন্যায় নিহত এবং নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে পরস্পরবিরোধী বিভিন্ন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে৷ ভারতের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রীর হিসেবে, নিহতের সংখ্যা পাঁচ হাজারে পৌঁছাতে পারে৷
ছবি: Reuters/Stringer
বিপজ্জনক উদ্ধার অভিযান
এই মানুষটিকে অলকনন্দা নদীর উপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শুধু একটি দড়ির সহায়তায়৷ ভারত-তিব্বত সীমান্তে অবস্থানরত সেনারা দড়ি দিয়ে বিশেষ সেতু তৈরি করে উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছেন৷ ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, বন্যার কারণে কয়েক হাজার মানুষ এখনো বিভিন্ন স্থানে আটকে আছেন৷ তাদের কাছে খাবার বা পানীয় জল নেই৷
ছবি: Reuters/Danish Siddiqui
নিখোঁজদের সন্ধান
বন্যার কবল থেকে রক্ষা পেতে ছুটে চলা মানুষগুলো অনেক প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলেছেন৷ নিরাপদ আস্তানার সন্ধান পেয়েই তারা তাই খুঁজতে শুরু করেছেন হারানো প্রিয়জনদের৷
ছবি: DW/Shiv Prasad Joshi
মহামারি প্রতিরোধের চেষ্টা
মহামারি প্রতিরোধের জন্য সেচ্ছাসেবকরা কাঠ সংগ্রহ করছেন৷ বন্যার পানিতে ভেসে থাকা মরদেহগুলো দ্রুত দাহের জন্য এই ব্যবস্থা৷
ছবি: Manan Vatsyayana/AFP/Getty Images
হতাশাজনক পূর্বাভাষ
দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাতের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছে৷ বিশেষ করে সামরিক হেলিকপ্টারগুলো সময়মত উপদ্রুত অঞ্চলে নামতে পারছে না৷ ফলে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে আবহাওয়াবিদরা জানিয়েছেন, দ্রুত বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণও এই মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না৷
ছবি: Getty Images/Afp/Manan Vatsyayana
8 ছবি1 | 8
তাঁরাই আঙুল তুলেছেন কেন সরকার শিক্ষা নেয়নি ২০০৮ সালে কোশী নদীর ভয়াবহ বন্যা থেকে? নেপালের দিকে কোশী নদীর জল পাড় ছাপিয়ে ভিন্ন গতিপথে নিম্ন অববাহিকার ঘন বসতিপূর্ণ উত্তর বিহারের প্রায় দু'হাজার গ্রাম ভাসিয়ে নিয়ে যায়৷ কয়েকশো মানুষ মারা যায়৷ হাজার হাজার হেক্টর কৃষিজমি প্লাবিত হয়৷ স্রোতবাহিত কাদা মাটির নীচে চাপা পড়ে থাকে তাঁদের কৃষিজমি৷ সেই জমি আবার চাষযোগ্য করতে লেগে যায় কয়েক বছর৷ ঘরছাড়া হয় শত শত পরিবার৷
এর আগে বিহারের কোশী নদীতে এই ধরণের বন্যা হয়েছিল ১৯৬৮ এবং ১৯৮৪ সালে৷ তবুও সরকারের হেলদোল নেই৷ ২০০৮ সালের কোশী নদীর বন্যার কারণ এবং নিযন্ত্রণের বিষয়ে তৈরি হয় বিচারপতি রাজেশ বালিয়া কমিটি৷ রিপোর্টে দায়ী করা হয় সরকারি ইঞ্জিনিয়ার, বন্যা বিভাগের কর্মকর্তাদের৷ বলা হয়, ভূমিক্ষয় নিরোধক এবং বন্যা সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি৷ বন্যা সংকটে ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ এবং চিফ ইঞ্জিনিয়ার নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন৷ বন্যা নিয়ন্ত্রণে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয়েছিল, সেই অনুযায়ী কাজ কিছুই হয়নি৷ তাই বিচারপতি বালিয়া কমিটির সুপারিশ ছিল, বন্যা নিরীক্ষণ সেল গঠন করা, বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার জন্য বন্যা প্রবণ এলাকাগুলিতে বিশেষজ্ঞ দল পাঠানো ইত্যাদি, যাতে আগাম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়৷