দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১৫৩টি আসনে একক প্রার্থী থাকায় রবিবার অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটগ্রহণ হয়নি৷ ঢাকারও অনেক আসনে ভোটগ্রহণ হয়নি৷ তবুও যেসব স্থানে ভোট নেয়া হয়েছে, সেসব স্থান পর্যবেক্ষণ করেছেন আমাদের ঢাকা প্রতিনিধি৷
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আতিয়ার রহমান৷ পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী৷ সকাল এগারোটায় ভোট দিতে যান হলি ক্রিসেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে৷ বাইরে থেকে নিজের ভোটার সিরিয়াল সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু ‘জাতীয় পরিচয় পত্র' সঙ্গে না নেয়ার কারণে তিনি নিজের সিরিয়াল খুঁজে পাননি৷ অনেক চেষ্টার পর প্রার্থীর এজেন্টরা তাকে জানায় তার কেন্দ্র এখানে নয়৷ কিন্তু কোনো কেন্দ্রে গেলে তিনি ভোট দিতে পারবেন তাও তারা জানাতে পারেনি৷ বাধ্য হয়ে সেখান থেকে তিনি ছুটে যান পাশের ফুলকি নার্সারী স্কুল কেন্দ্রে৷ সেখানেও একই বিড়ম্বনায় পড়তে হয় তাঁকে৷ সেখানেও দীর্ঘ চেষ্টার পর তাঁকে জানানো হয় তাঁর নাম লিষ্টে নেই৷ এরপর তিনি ফিরে যান বাসায়৷
জাতীয় পরিচয় পত্র নিয়ে আবার ভোটের উদ্দেশ্যে বের হন আতিয়ার রহমান৷ অথচ ভোট দিতে এই পরিচয় পত্রের কোনো দরকার নেই৷ এরপর তিনি যান হাজী আশ্রাফ আলী হাইস্কুল কেন্দ্রে৷ সেখানে কম্পিউটারে তল্লাশি চালিয়ে এজেন্টরা জানায় এখানেই তাঁর ভোট৷ সিরিয়াল নম্বর নিয়ে কেন্দ্রে প্রবেশের পর আরেক বিড়ম্বনা৷ একই স্কুলের মধ্যে ৭টি কেন্দ্র৷ তাঁর কেন্দ্র আসলে কোনটা? কেন্দ্রের ভোট কক্ষের বাইরে কেউ কিছু বলতেও পারছে না৷ এক পর্যায়ে একজন আনসার সদস্য তাকে সহযোগিতা করেন৷ শেষ পর্যন্ত তিনি ভোট দিতে সমর্থ হন৷
বের হওয়ার সময় বেলা একটায় সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে খুলে দিলেন অভিযোগের ঝাঁপি৷ রাগে, ক্ষোভে বিরক্ত এই ব্যবসায়ী বললেন, ‘‘এভাবে ক’জন দুই ঘণ্টা চেষ্টা করে ভোট দেবে? আমাদের কিসের ঠেকা পড়েছে, যে এভাবে ভোট দিতে হবে?''
শুধু আতিয়ার নয়, খোদ রাজধানীর বহু ভোটারকে একই ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে৷ কেন্দ্র খুঁজতে গিয়ে গলদঘর্ম তাদের৷ অনেকে ভোট না দিয়ে ফিরেও গেছেন৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রী রোকসানা আক্তার শেওড়াপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে নিজেদের বাড়িতে থাকেন৷ বাসার পাশেই ইস্ট ওয়েস্ট স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে নিজের নাম খুঁজে না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বাসায়৷ এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে ক্ষুব্ধ রোকসানা বললেন, ‘‘অত চেষ্টা করতে পারব না৷ আর এবার কোনো প্রার্থী বাসায় ভোটার নম্বরও পাঠায়নি৷'' বিরক্ত রোকসানা এক পর্যায়ে নির্বাচন নিয়েই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন৷
ঢাকা-১৫ আসনে প্রধানত দুই প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে৷ আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কামাল আহমেদ মজুমদার ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী এখলাছ উদ্দিন মোল্লা এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন৷ কোনো প্রার্থীকেই খুব একটা ভোট চাইতে দেখা যায়নি৷
সকাল ৯টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত মিরপুরের বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে, কেন্দ্রের মধ্যে কোনো লাইন নেই৷ নেই ভোটারদের চাপ৷ তবে বাইরে প্রার্থীদের এজেন্টদের কাছে নিজের সিরিয়াল নম্বর খুঁজতে মানুষের জটলা ছিল চোখে পড়ার মতো৷
হলি ক্রিসেন্ট স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জনতা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার কামরুল হাসান জানান, তাঁর কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ১৫৩ জন৷ সকাল ১০টায় এখানে কাষ্ট হয় ১৭ ভোট৷ বেলা ১টায় গিয়ে দেখা গেছে ওই কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ১৭৩টি৷
পোশাক শ্রমিকদের নির্বাচনি ভাবনা
আগামী পাঁচ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন৷ ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে এই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ নির্বাচন নিয়ে কি ভাবছেন? এই ছবিঘরে পোশাক শ্রমিকদের নির্বাচনি ভাবনা প্রকাশ করা হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিরোধী দলের উপর ‘ক্ষিপ্ত’ আকলিমা
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার পোশাক শ্রমিক আকলিমা বেগম৷ কাজ করেন ঢাকার রামপুরার একটি পোশাক কারখানায়৷ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে অবরোধ দেয়ায় বিরোধী জোটের ওপর ক্ষিপ্ত এই পোশাক শ্রমিক৷ এমনিতেই সামান্য কিছু টাকা বেতন পান৷ তার উপর টানা অবরোধের কারণে নিত্যপণ্যের দাম গেছে বেড়ে৷ ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন আকলিমা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট দিতে পারবেন না লাকী আক্তার
ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকার একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন লাকী আক্তার৷ বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে হলেও ভোটার হয়েছেন ঢাকায়৷ তাঁর এলাকার সাংসদ ইতোমধ্যেই একক প্রার্থী হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছেন৷ তাই ভোট নিয়ে তাঁর কোনো পরিকল্পনা নেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
রুবেলের ভাষায় ‘প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন’
পোশাক শ্রমিক রুবেলের বয়স মাত্র ২৩ বছর৷ কুমিল্লা জেলার তিতাস থানায় তাঁর বাড়ি৷ কাজ করেন ঢাকায়৷ রুবেলের প্রশ্ন, ‘‘প্রতিযোগিতাহীন এই নির্বাচনে ভোট দেয়ার কী আছে?’’ জীবনের প্রথম ভোটটি নষ্ট করতে রাজি নন তিনি৷ একইসঙ্গে আসন্ন নির্বাচনে ভোট দেয়াটাও অর্থহীন মনে করেন তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
এখনো সিদ্ধান্ত নেননি শেফালি
শেফালির বাড়ি ঢাকার পাশে আশুলিয়ায়৷ কাজ করেন, ঢাকার রামপুরার একটি তৈরি পোশাক কারখানায়৷ দশম জাতীয় সংসদ নিয়ে তাঁর অভিমত হচ্ছে, দুই পক্ষই যদি ভোটে আসত তাহলে ভালো হতো৷ ভোট দিতে কেন্দ্রে যাবেন কিনা এখনো সিদ্ধান্ত নেননি তিনি৷
ছবি: DW/M. Mamun
হোসনে আরার স্বপ্ন ছেলেকে মানুষ করা
গুলশানের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন ফরিদপুরের হোসনে আরা৷ দুপুরের খাবারের বিরতির সময় ছেলেকে নিয়ে বসেছেন পাশের একটি চায়ের দোকানে৷ ভোট নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তাভাবনা নেই৷ খেটেখুটে একমাত্র ছেলেকে মানুষ করাই তাঁর স্বপ্ন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট দেবেন না সাদ্দাম হোসেন
সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি বরিশালের উজিরপুরে৷ কাজ করেন ঢাকার রামপুরার একটি তৈরি পোশাক কারখানায়৷ রাজনীতিবিদদের উপর তাঁর অনেক রাগ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘ভোট দিয়া হইবটা কী? যারা দল করেন তারা কোনো না কোনো ভাবেই লাভবান হন, মরি আমরা শ্রমিকরা৷ ভোট দিব না ভাই৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট দিতে গ্রামে যাবেন মিতু
জামালপুরের বকশীগঞ্জের মিতু কাজ করেন ঢাকার গুলশানের একটি তৈরি পোশাক কারাখানায়৷ কাজের ফাঁকে স্বামীর মোবাইল ফ্লেক্সি লোডের দোকানেও বসেন৷ জীবনের প্রথম ভোট দিতে গ্রামে যাবেন মিতু৷ তবে নিরুত্তাপ নির্বাচন তাঁর ভালো লাগছে না৷
ছবি: DW/M. Mamun
ছুটি পেলে ভোট দিতে যাবেন মিজান
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর মিজানুর রহমান কাজ করেন গুলশানের একটি তৈরি পোশাক কারাখানায়৷ ছোট সময় তিনি নির্বাচন দেখেছেন অনেক উৎসবমুখর৷ কিন্তু এবার নিজে ভোটার হয়ে ভোটের উৎসব দেখতে পাচ্ছেন না৷ তারপরেও ছুটি পেলে পাঁচ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট দিতে গ্রামে যাবেন মিজান৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট নিয়ে ভাবার সময় নেই সাথীর
দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার পোশাক শ্রমিক সাথী৷ কাজ করেন রামপুরার একটি পোশাক কারখানায়৷ নির্বাচন কিংবা ভোট নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর৷ সাথীর একমাত্র চিন্তা কাজ নিয়ে৷ তিনি মনে করেন, ভালোভাবে কাজ করতে পারলেই সন্তানদের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দিতে পারবেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট দেওয়া অনর্থক মনে করেন আব্দুল আলীম
পটুয়াখালী জেলার খেপুপাড়ায় বাড়ি আব্দুল আলীমের৷ কাজ করেন রামপুরার একটি তৈরি পোশাক কারখানায়৷ ছুটি নিয়ে এই ধরনের নির্বাচনে ভোট দিতে যাওয়া তার কাছে অনর্থক মনে হয়৷ তাছাড়া তার ধারণা সে ভোট না দিলেও যে প্রার্থী জয়লাভ করার তার জয় হবেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
হাসনা হেনার কাছে ‘নিরুত্তাপ নির্বাচন’
ঢাকার মালিবাগের একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করেন হাসনা হেনা বেগম৷ বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে৷ দেশে যে সবচেয়ে বড় ভোট উৎসব চলছে সেটা তাঁর মনেই হচ্ছে না৷ নিরুত্তাপ নির্বাচনে ভোট দিতে চান না হাসনা হেনা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভোট দেয়ার ইচ্ছা ছিল লাইলীর
লাইলী বেগমের বাড়ি পিরোজপুরের জিয়ানগরে৷ ভোটার হয়েছেন ঢাকার তেজগাঁও এলাকায়৷ ভোট দেয়ার ইচ্ছাও ছিল তাঁর৷ কিন্তু শুনতে পাচ্ছেন তাঁর এলাকায় নাকি ভোট হবে না৷ একক প্রার্থী হিসেবে একজন ইতিমধ্যেই জিতে গেছেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
পদত্যাগে ভয় কিসের? প্রশ্ন সোহাগের
সোহাগ মিয়া কাজ করেন ঢাকার মালিবাগের একটি তৈরি পোশাক কারখানায়৷ বাড়ি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে৷ তাঁর মতে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করে বিরোধী দলকে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া উচিত ছিল৷ তিনি বলেন, ‘‘ভালো কাজ করলে পদত্যাগে প্রধানমন্ত্রীর এতো ভয় কিসের? ভোটতো আমরাই দিব৷’’
ছবি: DW/M. Mamun
13 ছবি1 | 13
একই অবস্থা ইস্ট ওয়েস্ট স্কুল এন্ড কলেজ কেন্দ্রে৷ এই স্কুলে তিনটি কেন্দ্র৷ প্রতিটি কেন্দ্রেই ভোটার ছাব্বিশ শত'র বেশি৷ বেলা দেড়টা পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে কাষ্ট হয়েছে ১০০ থেকে দেড়শ'র মতো ভোট৷ এর একটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার পাট গবেষণা ইনষ্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাকসুদার রহমান বলেন, ‘‘বেলা ১টা পর্যন্ত ভোট কাষ্ট হয়েছে ১০ শতাংশেরও কম৷''
ভোটার উপস্থিতি এত কম কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে হাজী আশ্রাফ আলী হাই স্কুলের একটি কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার জনতা ব্যাংকের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘ভোটার সিরিয়াল নম্বর খুঁজে পেতে অনেক বিড়ম্বনায় পড়ছেন ভোটাররা৷ অনেক ভোটার ভোট দিতে এসে তাদের কাছে এই অভিযোগ করেছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এতে তাদের কিছুই করার নেই৷ আগে তো প্রার্থীরাই ভোটারদের কাছে সিরিয়াল নম্বর পৌঁছে দিত৷ এবার কোনো প্রার্থী এমনটি করেনি বলেই ভোটারদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে৷'' তবে দুপুরের পর কিছু ভোটার বাড়তে পারে বলে ধারণা করেন তিনি৷ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ভোটের ফ্লো একটু বেড়েছে বলে বেলা দুইটার দিকে জানান এই নির্বাচনি কর্মকর্তা৷