বিয়ে, পরিবার, সন্তানসন্ততি - বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো জার্মানিতেও এই ধরনের সনাতনী পারিবারিক প্রথা আজও বিদ্যমান৷ কিন্তু এর পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের পারিবারিক রূপও সমাজে জায়গা করে নিচ্ছে৷ এগুলো আইনগতভাবে স্বীকৃতিও পাচ্ছে৷ যেমন বিয়ে ছাড়াই একত্রে বসবাস, প্যাচওয়ার্ক ফ্যামিলি, সিংগেল প্যারেন্ট, সমকামী দম্পতি ইত্যাদি জীবনধারাকেও মেনে নেওয়া হচ্ছে৷ ২০০১ সালে পাস করা এক আইনে সমকামিতা সম্পর্ককে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷
এতো ধরনের পারিবারিক পদ্ধতিকে বুঝতে হলে অনেক সময় খেই হারিয়ে যেতে পারে৷ তাই জার্মানির প্রটেস্টান্ট গির্জা ‘ইকেডি'র পক্ষ থেকে এক ধরনের দিক নির্দেশনামূলক পেপার বের করা হয়েছে গত জুন মাসে৷ ইকেডির প্রধান নিকোলাউস শ্নাইডার এই রিপোর্টকে ‘পজিশন পেপার অন মেরিজ অ্যান্ড ফ্যামিলি' নামে উপস্থাপন করেছেন৷ এরপর থেকে দুটি ধারা গড়ে উঠেছে প্রটেস্টান্ট গির্জার ভেতরে ও বাইরে৷ একটি রক্ষণশীল অন্যটি উদারপন্থি৷ মিডিয়া, উপাসনাস্থল এমনকি রান্নাঘরের টেবিলেও আলোচনার ঝড় উঠছে বিষয়টিকে ঘিরে৷
বিয়ের রীতি একেক দেশে একেক রকম৷ আবার ধর্ম, গোত্র অনুসারেও বিয়ের নিয়মকানুন ঠিক হয়৷
ছবি: Jamonlineপ্রথমে কোর্টে ছোট্ট একটি আয়োজনের মাধ্যমে বিয়েটা সেরে ফেলেন বর-কনেরা৷ পরে অন্য এক সময়ে গির্জায় হয় বিয়ের অনুষ্ঠান৷ গির্জার অনুষ্ঠানের আগের রাতে কনের বাড়ির সামনে সেরামিকের বিভিন্ন জিনিস ভাঙেন বর-কনের পরিবারের সদস্যরা৷ এরপর সেটা পরিষ্কার করেন শুধু বর আর কনে৷ এর মাধ্যমে নবদম্পতিকে দলবদ্ধভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দীক্ষা দেয়া হয়৷
ছবি: DWকনের এই পোশাকটির নাম ‘কিসওয়া’৷ হীরা আর মুক্তা দিয়ে সাজানো বিয়ের এই পোশাকটি ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকেই সেটা একদিনের জন্য ধার করে৷ শুধু এক রাতের জন্য ভাড়া হিসেবে দিতে হয় ২৫ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত!
ছবি: picture-alliance / dpa/dpawebদক্ষিণ কোরিয়ায় বিয়ের ক্ষেত্রে এখনও প্রচলিত নিয়মগুলো পালন করা হলেও তরুণরা ইদানীং পশ্চিমা ধাঁচের দিকে ঝুঁকছে৷ সে অনুযায়ী তরুণীরা সাদা গাউন আর তরুণরা কালো জ্যাকেট পরে বিয়ে করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpaবরের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য কনের পরিবারের কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়৷ আর বিয়ের দিন বর তিন চারজন সঙ্গীকে নিয়ে গান গাইতে গাইতে কনের বাড়ি যান৷
ছবি: DW/Yohannes Gegziabherএটি কলকাতার একটি গণবিয়ের অনুষ্ঠানের দৃশ্য৷ বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা এভাবে গরিব মানুষদের জন্য বিয়ের আয়োজন করে থাকে৷ কেননা ভারতে নিয়ম মেনে বিয়ে করাটা ব্যয়বহুল – যা অনেকের পক্ষেই জোগাড় করা সম্ভব হয়না৷
ছবি: DW/P.M.Tewariছবিটি ইরানের হলেও এটি আসলে সেখানকার সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ‘তুর্কমেন’-দের একটি বিয়ের অনুষ্ঠান৷ সংখ্যালঘু হওয়ায় তুর্কমেনদের ভাষা ও সংস্কৃতি খোদ ইরানিদের কাছে ততটা পরিচিত নয়৷ তিন-চারদিন ধরে তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়৷
ছবি: Jamonline
বিয়ে ও পরিবারের এক বিশেষ ভূমিকা
জার্মানিতে অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর সিভিল সোসাইটিতে বিয়ে ও পরিবারের এক বিশেষ ভূমিকা ছিল৷ বাবা, মা, সন্তান এই নিয়ে গড়ে ওঠে একটি পরিবার৷ বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে জাতীয় সমাজতান্ত্রিকদের আমলে পরিবারের এই ছবিকে আদর্শ হিসাবে ধরে নেওয়া হয়৷ সমকামিতা আইনত নিষিদ্ধ করা হয়৷
ক্যাথলিক ও অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের কাছে পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিয়ে একটি পবিত্র বন্ধন৷ ঈশ্বরের পবিত্র নির্দেশ৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবারের চিরাচরিত চিত্রটা পাল্টাতে শুরু করে৷ যদিও পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্বে বাবা আর সন্তান লালনপালনের ক্ষেত্রে মায়ের স্থানটি শক্তপোক্তই ছিল অনেকদিন৷ সত্তরের দশকের মাঝামাঝি অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করে৷ খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ থেকে অনেকেই দূরে সরে যেতে শুরু করেন৷ গুরুত্ব দিতে থাকেন মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ককে৷
সবধরনের পারিবারিক বন্ধনকে স্বীকার করা হয়
প্রটেস্টান্ট গির্জার ১৬০ পৃষ্ঠাব্যাপী দিক নির্দেশমূলক লেখায় কী রয়েছে, তা এখন খতিয়ে দেখা যাক৷ ২০০৯ সাল থেকে একটি বিশেষজ্ঞ প্যানেল খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধ ও পারিবারিক বিবর্তন সংক্রান্ত একটি পেপার নিয়ে কাজ করছেন৷ যার সারমর্ম: প্রটেস্টান্ট গির্জা সবধরনের পারিবারিক বন্ধনকে স্বীকার করে৷ এর মধ্যে রয়েছে সমকামী ও প্যাচওয়ার্ক পরিবারও৷ বিশেষ করে প্রটেস্টান্টদের উদারপন্থি শাখাটি এই বক্তব্যকে স্বাগত জানান৷ ‘ইকেডি-পেপারে'র অন্যতম রচয়িতা শ্টেফানি শার্ডিয়েন ডয়চে ভেলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘আধুনিক সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয় গির্জাকে৷ পরিবারের বিভিন্ন ধরনের রূপ আজ স্পষ্টই লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷''
অন্যদিকে প্রটেস্টান্টদের রক্ষণশীল ধারাটি এই বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, এতে বিয়ে ও পরিবার সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হয়েছে৷
সমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের৷ ইউরোপের কয়েকটি দেশে এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ তবে পূর্ব ইউরোপের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ বিস্তারিত দেখুন এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpaসমকামীদের বিয়ে এবং সন্তান দত্তক নেওয়ার অধিকার দিতে সরকারি পরিকল্পনার সমর্থনে গত রবিবার প্যারিসে হাজির হন লাখো মানুষ৷ কিছুদিন আগে অবশ্য সেখানে সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে লাখো মানুষ সমবেত হয়৷ এই ইস্যু নিয়ে বেশ উত্তপ্ত সেদেশ৷ বিশেষ করে ক্যাথলিক চার্চ এবং ডানপন্থি বিরোধী দল ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদকে এই আইন করা থেকে বিরত রাখতে চাইছে৷
ছবি: Reutersইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের পরিস্থিতি মিশ্র৷ নেদারল্যান্ডস হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম দেশ যেখানে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ ঘোষণা করা হয়৷ ২০০১ সালের এপ্রিল থেকে সেদেশে এই আইন কার্যকর আছে৷
ছবি: AP২০০৩ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসের প্রতিবেশী দেশ বেলজিয়ামে সমলিঙ্গের মধ্যে বিবাহ বৈধ করা হয়৷ প্রথম দিকে সেদেশে বিদেশিদের মধ্যে এ ধরনের বিবাহে খানিকটা জটিলতা ছিল৷ কিন্তু ২০০৪ সালের অক্টোবর থেকে সকল দেশের নাগরিকদের এই সুবিধা দেওয়া হয়৷ এক্ষেত্রে যে কোনো একজনকে কমপক্ষে তিন মাস বেলজিয়ামে থাকতে হবে৷ ২০০৬ সাল থেকে সমকামী পুরুষ এবং নারীকে সন্তান দত্তক নেওয়ার সুবিধাও প্রদান করা হয় বেলজিয়ামে৷
ছবি: picture-alliance/dpaখোসে লুইস রোদ্রিগেজ সাপাতেরো-র সমাজতন্ত্রী সরকারের মেয়াদকালে পৃথিবীর তৃতীয় দেশ হিসেবে স্পেন সমকামীদের মধ্যে বিয়ে বৈধ করে৷ ফ্রান্সের মতো সেদেশেও ক্যাথলিকদের শক্ত অবস্থান রয়েছে৷ তা সত্ত্বেও ২০০৫ সালের জুলাই মাসে স্পেনে এ ধরনের বিয়ে বৈধ করা হয়৷ ২০১০ সাল থেকে পর্তুগালও একই পথের পথিক হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpaআইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ইওয়াহানা সিগুরডোটির এবং তাঁর সঙ্গিনী ইওহিনা লিওসডোটির সমকামীদের বিয়ে বৈধ ঘোষণার পর প্রথমেই সেই সুযোগ নিয়েছেন৷ সিগুরডোটির হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মেয়ে সমকামী রাষ্ট্রপ্রধান৷ ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি৷ এরপর ২০১০ সালে সেদেশে সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হলে সঙ্গিনী লিওসডোটিরকে বিয়ে করেন সিগুরডোটির৷
ছবি: Getty Imagesসমকামীদের অধিকারের বিষয়ে আইনিভাবেই সচেতন স্ক্যান্ডিনেভিয়া৷ সুইডেনে ২০০৯ সালে সমলিঙ্গের মধ্যে বিয়ে বৈধ করা হয়৷ পুরুষ এবং নারী সমকামী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হতে সেদেশে কোনো বাধা নেই৷ নরওয়ে ২০০৮ সালে এ সংক্রান্ত এক বিল অনুমোদন করেছে৷ ২০১২ সালের গ্রীষ্ম থেকে ডেনমার্কেও সমকামীদের বিয়ে বৈধ করা হয়েছে৷ ফিনল্যান্ডও এ ধরনের বিয়েকে বৈধতা প্রদানের পথে রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpaএই ছবিটি গত শতকের ৮০-র দশকের৷ এতে দেখা যাচ্ছে, সমকামীদের অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করছেন একদল মানুষ৷ এরপর অনেকদিন পেরিয়েছে৷ যুক্তরাজ্যে সমলিঙ্গের পুরুষ বা নারী যুগল সামাজিক বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি রয়েছে৷ ২০০৫ সাল থেকে রয়েছে এই প্রথা৷ তবে চার্চে সমলিঙ্গের নারী বা পুরুষ বিয়ে করতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP২০০১ সাল থেকে সমলিঙ্গের যুগলের রেজিস্ট্রেশন বৈধ করেছে জার্মানি৷ এই প্রক্রিয়ায় জার্মানিতে বিয়ের সুযোগ সুবিধার অনেকটাই পান সমকামীরা৷ কিন্তু যৌথভাবে সন্তান দত্তক নেওয়া কিংবা পূর্ণ আয়কর সুবিধা এখনো পায়না সমকামী দম্পতিরা৷ চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, জার্মানির ৬৬ শতাংশ জনসাধারণই সমকামীদের বিয়ের পক্ষে৷
ছবি: picture-alliance/dpaতবে ইউরোপের পর্বাঞ্চলের পরিস্থিতি ভিন্ন৷ সেখানকার সমাজে সমকামী নারী বা পুরুষকে ভালোভাবে গ্রহণ করা হয়না৷ লিথুনিয়া, পোল্যান্ডের মতো লাটভিয়াতেও বিষমকামী দম্পতির মতো সমান অধিকার পায় না সমকামী দম্পতি৷ পূর্ব ইউরোপের অধিকাংশ জনগণই সমকামীদের বিয়ের বিপক্ষে৷
ছবি: Reutersরাশিয়ার সংসদ সম্প্রতি শিশুদের মাঝে ‘সমকামীদের প্রচারণা’ নিষিদ্ধ করেছে৷ আর আগেই অবশ্য সেন্ট পিটার্সবুর্গের (ছবিতে) মতো বিভিন্ন শহরে সমকামিতাকে উৎসাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল৷ নতুন এই আইনের ফলে সমকামীদের অধিকার বিষয়ক প্রচারণা রাশিয়ায় অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং আয়োজকদের জরিমানা হবে৷ বলাবাহুল্য, রাশিয়াতে সমকামীদের বিয়ে বৈধ নয়৷
ছবি: Dmitry Lovetsky/AP/dapd
‘জার্মান এভানগেলিক্যাল অ্যালায়েন্স' এর প্রধান মিশাইল ডিনার ইকেডির পরিবার সংক্রান্ত এই দিকনির্দেশনামূলক লেখাটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানান৷ কারণ হিসাবে বলা হয়, এতে পরিবারের চিরাচরিত সংজ্ঞাকে বাতিল করে ইচ্ছামত ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে৷ তবে এই দাবির কাছে মাথা নত করেননি ইকেডি প্রধান শ্নাইডার৷
বিয়ে হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ
শ্নাইডারের পূর্বসূরি বার্লিনের বিশপ ভল্ফগাং হুবারও এব্যাপারে তাঁর সঙ্গে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করেন৷ হুবারের মতে, বিয়ে হলো ঈশ্বরের আশীর্বাদ৷ এ কারণে নৈতিক দিক দিয়েও দাম্পত্য জীবনের অগ্রাধিকার রয়েছে৷ যিশুও বিবাহ বন্ধনকে অটুট বলে আখ্যায়িত করেছেন৷ এসব কিছুই দিক নির্দেশনামূলক পেপারটিতে উঠে আসেনি৷
চারজন খ্যাতনামা ধর্মতত্ত্ববিদ জানিয়েছেন যে ইকেডি-পেপারে আধ্যাত্মিক বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ কিন্তু ইকেডি প্রধান শ্নাইডার এই প্রসঙ্গে বলেন, এই রিপোর্টে বিয়ে ও মূল পরিবারের গুরুত্বকে অস্বীকার করা হয়নি৷ পাশাপাশি সিংগেল প্যারেন্ট ও প্যাচওয়ার্ক ফ্যামিলিকেও মূল্য দেওয়া হয়েছে৷ বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চলছে৷ শেষ কথা বলা হয়নি এখনও৷