বুধগ্রহের রহস্য উন্মোচনে বহুমুখী অভিযান
৮ এপ্রিল ২০১৯মহাকাশযানে ১৬টি হাই টেক যন্ত্র রয়েছে৷ বার্লিনের এক গবেষকদল তার মধ্যে একটি তৈরি করেছে৷ তার কাজ থার্মাল বিকিরণ মাপা৷ বুধ গ্রহের উপরিভাগ সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা আরও তথ্য সংগ্রহ করতে চান৷
উচ্চ তাপমাত্রায় পৃথিবীর বুকে বিভিন্ন ধরনের পাথরের কী দশা হয়, সবার আগে বিজ্ঞানীরা তা জানার চেষ্টা করেছেন৷ বুধ গ্রহে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে তখন সেই ফলাফলের তুলনা করা যাবে৷ চরম উত্তাপ সত্যি বড় চ্যালেঞ্জ৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের ড. ইয়োর্ন হেলব্যার্ট বলেন, ‘‘বুধ গ্রহের যে গোলার্ধ সূর্যের দিকে মুখ করে রয়েছে, সেখানে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি৷ এবং আমরা তার খুব কাছাকাছি রয়েছি৷ অর্থাৎ আমাদের মহাকাশযান এক টোস্টারের মধ্য দিয়ে যাবে৷ সেটিকে বুধ গ্রহ এবং সূর্যের উত্তাপ সামলাতে হবে৷ অনেকটা সময় জুড়ে এই যানের সহ্যশক্তি নিশ্চিত করার উপযুক্ত ডিজাইন ও যন্ত্রপাতি তৈরির কাজ ছিল এক বড় চ্যালেঞ্জ৷''
আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মতো বুধ গ্রহও বিশাল, আদিম মেঘ থেকে সৃষ্টি হয়েছে৷ সেটা ছিল প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগের ঘটনা৷ সূর্যের প্রাথমিক অবস্থায় তাকে ঘিরে গ্যাস ও ধুলিকণার ঘূর্ণায়মান মেঘ ছিল৷ প্রথমদিকে ক্ষুদ্র পদার্থগুলি পরস্পরের সঙ্গে হালকাভাবে যুক্ত হতে থাকে৷ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে সেগুলির আকার বড় হতে থাকে৷ তারপর কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ ধুলিকণার পুঞ্জগুলির মধ্যে সংঘাত ঘটতে থাকে৷ উত্তাপ বাড়ার ফলে সেগুলি আরও নিবিড় হতে শুরু করে৷ ফলে আরও উপাদান সেগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়৷ ধীরে ধীরে গরম গোলাকার আয়তন সৃষ্টি হয় – যা আজকের গ্রহগুলির আদি রূপ৷
সূর্য ও তার জোরালো বিকিরণ থেকে দূরত্ব যত বেশি, বরফের অস্তিত্ব সেই হারে বাড়তে থাকে৷ পানি, মিথেন বা অন্য কোনো তরল গ্যাস দিয়ে তৈরি সেই বরফ৷ এভাবেই শনিগ্রহের মতো বিশালাকার গ্যাসভিত্তিক গ্রহ সৃষ্টি হয়৷ অন্যদিকে সূর্যের কাছাকাছি শক্ত আকারের গ্রহগুলি সৃষ্টি হতে থাকে – অর্থাৎ মঙ্গলগ্রহ, পৃথিবী, শুক্র ও বুধ গ্রহ৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাভিত্তিক যান ‘মেসেঞ্জার' বুধ গ্রহের ভূ-পৃষ্ঠ সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য পাঠিয়েছে৷ দেখা গেছে, সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহের ভূ-পৃষ্ঠ অন্যান্য পাথুরে গ্রহগুলির তুলনায় আলাদা৷ সেখানে পৃথিবী ও মঙ্গলগ্রহের তুলনায় অনেক বেশি লোহা রয়েছে৷
গবেষকরা কিন্তু তার বদলে গন্ধক ও ক্লোরিনের মতো উপাদান খুঁজে পেয়েছেন৷ ফলে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে৷ ড. ইয়োর্ন হেলব্যার্ট বলেন, ‘‘এই সব পদার্থের কিন্তু এত উচ্চ তাপমাত্রায় উবে যাবার কথা৷ সেখানে গন্ধক থাকার কথাই নয়৷ অথচ ভূ-পৃষ্ঠের সাড়ে চার শতাংশ জুড়ে তা রয়েছে৷ ফলে সেটা বিস্ময়ের বড় কারণ বৈকি৷ তাই প্রশ্ন হলো, বুধ গ্রহ কীভাবে তৈরি হয়েছে এবং কোথায় তৈরি হয়েছে৷''
বুধ গ্রহ কি সূর্যের কাছে তার বর্তমান কক্ষপথেই সৃষ্টি হয়েছে? তা যদি হয়, তাহলে এত পরিমাণ ভোলাটাইল সালফার সেখানে এল কী করে? সৌরজগতের সৃষ্টি সম্পর্কে আমাদের তত্ত্বের সঙ্গে বিষয়টি একেবারেই মিলছে না৷
পাথুরে এই গ্রহটি কি তাহলে একেবারে অন্য কোনো জায়গা থেকে এসেছে? সূর্য থেকে দূরে কোনো শীতল অঞ্চল থেকে? বিশাল গ্যাসভিত্তিক গ্রহগুলির কাছ থেকে?
কোনো গ্রহাণু সেটিকে তার কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত করে সূর্যের দিকে ঠেলে দিয়ে থাকতে পারে৷
বুধ গ্রহে নতুন অভিযানের মাধ্যমে বিস্ময়কর এই গ্রহের উৎপত্তি রহস্য সমাধানের আশা করা হচ্ছে৷ সেই প্রশ্নের উত্তর এমন জগতের উপর আলোকপাত করতে পারে, যা আমাদের নাগালের বাইরে৷
গরম এই গ্রহের দুই মেরু অঞ্চলে গবেষকরা জমাট পানির অস্তিত্বের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন৷ ফলে আমাদের জ্ঞান অনুযায়ী প্রাণের পূর্বশর্ত সেখানে রয়েছে৷ এমন সব গর্ত বা খাদের মধ্যে সেই বরফ রয়েছে, যা চিরকাল ছায়ার আড়ালে থাকে৷ চরম শীতল এই পরিবেশের অস্তিত্ব সত্যি বিস্ময়কর এক আবিষ্কার৷ জার্মান এয়ারোস্পেস সেন্টারের ড. ইয়োর্ন হেলব্যার্ট বলেন, ‘‘বুধ গ্রহকে ঘিরে এখনো বিস্ময়ের অনেক কারণ রয়েছে৷ তার উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের অনেক অনুমান ছিল৷ তার ভিত্তিতে অনেক মডেল তৈরি হয়েছে৷ কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা জানি, যে তার একটাও মিলছে না৷ এমন শূন্যতার মাঝে নতুন অভিযান হয়তো এই সব নতুন প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে৷''
২০২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বেপি কলম্বো' নামের যৌথ অভিযানের বুধগ্রহে পৌঁছনোর কথা৷ তার মধ্যে একটি ইউরোপীয় স্যাটেলাইট গ্রহের ভূ-পৃষ্ঠের মানচিত্র তৈরি করবে৷ জাপানের একটি যান আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে গভীর ও রহস্যময় গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র পরীক্ষা করবে৷
কর্নেলিয়া বরমান/এসবি