রবিবারের সময়সীমার মধ্যে জার্মানিতে সরকার গড়ার লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি সম্ভাব্য জোটসঙ্গীরা৷ বুধবার চূড়ান্ত বোঝাপড়া হলেও মার্চ মাসের আগে সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না৷
বিজ্ঞাপন
সব মতপার্থক্য দূর করতে পারলে বুধবারই জার্মানির আগামী সরকারের কোয়ালিশন চুক্তি প্রকাশ করতে পারে ইউনিয়ন ও এসপিডি শিবির৷ মঙ্গলবার বার্লিনে সিডিইউ দলের দপ্তরে আলোচনায় সরকার গড়ার পথে শেষ কাঁটাগুলি দূর করার জন্য দুই পক্ষের উপরই চাপ বাড়ছে৷ দুই পক্ষই বলছে, সদিচ্ছার অভাব নেই৷
সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ইউনিয়ন শিবির ও এসপিডি দলের মধ্যে দর কষাকষি চলেছে৷ সব খুঁটিনাটি বিষয় স্পষ্ট না হলেও অর্থ, স্বাস্থ্য, শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার ও পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে কিছু বিষয় নিয়ে এ দিন ঐকমত্য সম্ভব হয়নি৷ বিশেষ করে এসপিডি দল শুরু থেকেই তাদের কয়েকটি দাবিতে অটল রয়েছে৷ শ্রমিক-কর্মীদের জন্য যখনই সম্ভব স্থায়ী চাকুরির ব্যবস্থা করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রেও বর্তমান বৈষম্য দূর করার কাজে হাত দিতে চায় তারা৷ অস্ত্র রপ্তানি ও সেনাবাহিনীর বাজেট নিয়েও নিজস্ব আদর্শ কার্যকর করতে চায় এসপিডি৷
বুধবার কোয়ালিশন চুক্তি চূড়ান্ত হলেও সরকার গড়ার পথে শেষ বাধা দূর করার প্রক্রিয়া বেশ দীর্ঘ হতে চলেছে৷ এসপিডি দলের সাধারণ সদস্যদের ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হতে ৩রা অথবা ৪ঠা মার্চ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে৷ বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই সপ্তাহান্তেই পোস্টাল ব্যালট গণনা হবার কথা৷ মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এসপিডি দলের সদস্য তালিকায় যাদের নাম রয়েছে, একমাত্র তাঁরাই ভোট দিতে পারবেন৷ উল্লেখ্য, বিশেষ করে দলের যুব শাখার মধ্যে মহাজোট সরকারে যোগ দেবার বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বাঁধছে৷
এদিকে প্রস্তাবিত মহাজোট সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷ সর্বশেষ জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, ইউনিয়ন শিবির ও এসপিডি দলের প্রতি ভোটারদের সমর্থন দ্রুত কমে চলেছে৷
নতুন সরকারে এসপিডি নেতা মার্টিন শুলৎসকেও মন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান না প্রায় ৫৪ শতাংশ মানুষ৷ বিশেষ করে এসপিডি দলের সদস্যদের সমর্থন পেতে হলে তাঁকে শীঘ্রই এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাতে হবে৷
কী চায় জার্মানির এসপিডি দল?
ছোট শরিক হয়েও জার্মানির বিদায়ী মহাজোট সরকারে যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে অনেক দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পেরেছে এসপিডি দল৷ তবে ভোটাররা তার স্বীকৃতি দেয়নি৷ আবার মহাজোটে যোগ দিলে অনেকগুলি শর্ত চাপাতে চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/U. Baumgarten
‘আরও ইউরোপ’
বর্তমান সংকটগুলির সমাধানের লক্ষ্যে ব্রেক্সিটের পথে না গিয়ে ইইউ-কে আরও শক্তিশালী করে তুলতে চায় জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ ইউরোপীয় স্তরে ন্যূনতম মজুরি, তরুণদের বেকারত্বের মোকাবিলা, কোম্পানিগুলির উপর অভিন্ন কর চাপানো এবং ‘কর ফাঁকির মরুদ্যান’ বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন দলের নেতা মার্টিন শুলৎস৷ ২০২৫ সালের মধ্যে ‘ইউরোপীয় যুক্তরাষ্ট্র’ স্থাপনের স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এই প্রাক্তন স্পিকার৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. Florin
শ্রমিকদের আরও অধিকার
জার্মানিতে শ্রমিক-কর্মীদের অধিকার বাড়াতে চিরকাল উদ্যোগ নিয়ে এসেছে সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ তবে সাম্প্রতিক কিছু সংস্কারের ফলে সেই ভাবমূর্তি বেশ ক্ষুণ্ণ হয়েছে৷ এবার বেতন ও মজুরি কাঠামো কার্যকর করা ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার দাবি জানাচ্ছে এসপিডি৷ তাছাড়া যারা পার্ট টাইম বা খন্ডকালীন কাজ করছে, তাদের ফুল টাইম বা পূর্ণ কাজের কাঠামোয় ফিরে যাবার অধিকারের স্বীকৃতি চায় এসপিডি৷
ছবি: picture-alliance/Ulrich Baumgarten
অবসর ভাতার আমূল পরিবর্তন
সমাজে সংহতির ভিত্তিতে জার্মানির অবসর ভাতা কাঠামোর আমূল পরিবর্তন চায় সামাজিক গণতন্ত্রী দল৷ বিশেষ করে সারা জীবন কাজ করেও শেষ বয়সে দারিদ্র্যের ঝুঁকি এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে চায় এসপিডি৷ অতএব সংহতির স্বার্থে অবসর ভাতার বিচ্ছিন্ন সব কাঠামোগুলিকে একত্র করার চেষ্টা চালাতে চায় তারা৷ অত্যন্ত জটিল এই ব্যবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন যে কঠিন হবে, সে বিষয়ে অবশ্য তেমন সংশয় নেই৷
ছবি: picture-alliance/S. Gollnow
বিনামূল্যে শিক্ষা
জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থার একটা বড় অংশই সরকারি ভরতুকিতে চলে৷ তবে অবকাঠামোর কিছু দুর্বলতার ফলে সমস্যা রয়েছে৷ বিশেষ করে শিক্ষা রাজ্য সরকারগুলির এক্তিয়ারে থাকায় এ ক্ষেত্রে সার্বিক উদ্যোগ নেওয়া কঠিন৷ এসপিডি দলের দাবি, সারা দেশে বিনামূল্যে কিন্ডারগার্টেন ও সেখানে সারাদিন বাচ্চা রাখার সুযোগকে অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে৷ এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির আধুনিকীকরণসহ শিক্ষা ক্ষেত্রে আরও বিনিয়োগ চাই৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gambarini
স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থার সংস্কার
বর্তমানে জার্মানিতে সার্বজনীন ও বেসরকারি স্বাস্থ্যবিমা চালু রয়েছে৷ ডাক্তারখানা ও হাসপাতালে বেসরকারি স্বাস্থ্য বিমাকারীদের বিশেষ খাতির করা হয়, অন্যদের বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়৷ এই বিভাজন ঘুঁচিয়ে সবাইকে নিয়ে এক ‘নাগরিক স্বাস্থবিমা’ চালু করতে চায় সামাজিক গণতন্ত্রীরা৷ তবে এই প্রস্তাবের জোরালো বিরোধিতা করছে বেশ কিছু মহল৷ তাদের আশঙ্কা, এর ফলে স্বাস্থ্য অবকাঠামোর মানের ক্ষতি হবে৷
ছবি: Colourbox
শরণার্থী নীতি
২০১৫ সালে বিশাল সংখ্যক শরণার্থীর ঢলের কারণে জার্মানির রাজনীতি জগত উত্তাল হয়ে উঠেছে৷ চ্যান্সেলর ম্যার্কেল তাঁর উদার মনোভাবের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছেন৷ এসপিডি গোটা অভিবাসন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণের দাবি জানাচ্ছে, যাতে আইনি পথে বিদেশিরা জার্মানিতে এসে কাজের সুযোগ পায়৷ তবে রাজনৈতিক আশ্রয়ের অধিকার সঙ্কুচিত করার বিরোধী এই দল৷ আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কোনো ঊর্ধসীমাও মানতে নারাজ তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/R. Jensen
জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা
সন্ত্রাসী হামলা ও অপরাধ দমন করতে প্রায়ই হিমশিম খায় জার্মানির পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ৷ ফলে মানুষের মনে অসন্তোষ দেখা যায়৷ এই সমস্যার মোকাবিলা করতে এসপিডি দল আরও পুলিশকর্মী নিয়োগের দাবি জানাচ্ছে৷ সেইসঙ্গে অপরাধ প্রতিরোধ করার জোরালো উদ্যোগ চায় তারা৷ তাদের মতে, দাগী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে গোটা ব্যবস্থায় আরও দক্ষতার ছাপ আনতে হবে৷
ছবি: Picture-Alliance/dpa/B. Marks
পরিবেশ সংরক্ষণ
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার ক্ষেত্রে এককালে জার্মানি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে৷ বিকল্প জ্বালানির বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাফল্যও এসেছে৷ কিন্তু কয়লার লাগাতার ব্যবহার, ডিজেল গাড়ি নিয়ে বিতর্কের মতো কারণে এ ক্ষেত্রে জার্মানির ভাবমূর্তি বেশ ধাক্কা খাচ্ছে৷ এমন প্রেক্ষাপটে এসপিডি বিকল্প জ্বালানির আরও ব্যবহারের উপর জোর দিতে চায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
শিল্পোন্নত দেশগুলিতেও কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য বাস্তব সমস্যা৷ এই তালিকায় জার্মানির অবস্থান ভালো নয়৷ একাধিক সরকার এই বৈষম্য দূর করতে শিল্প-বাণিজ্য জগতের সঙ্গে বোঝাপড়ার চেষ্টা করেও বিফল হয়েছে৷ এবার এসপিডি দল চায়, আলাপ-আলোচনার বদলে আইন করে তাদের এই বৈষম্য দূর করতে বাধ্য করা হোক৷