1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যবাংলাদেশ

বুস্টার ডোজের ঘরপোড়া গরু আর ওমিক্রনের গর্জন-বর্ষণের গল্প

মোস্তফা মামুন
২৪ ডিসেম্বর ২০২১

শুরুতে বাংলাদেশে কে প্রথম টিকা দেবে তা বিরাট জাতীয় জিজ্ঞাসা। তখন টিকা নিয়ে সারা বিশ্বেই নানা প্রচার। আর বাংলাদেশে যেকোনো প্রচার আরও বেশি অপপ্রচারের রং নিয়ে ভীতির পুরু দেয়াল তৈরি করে দেয়।

Bangladesh Impfstart
সব মিলিয়ে বাংলাদেশে টিকার একরকম রোলার কোস্টার রাইড হয়েছে৷ছবি: Rashed Mortuza/DW

ফলে, লাখ টাকার প্রশ্ন, আদৌ টিকা দেয়ার লোক পাওয়া যাবে কিনা? কে সেই সাহসী যিনি প্রথম এই অচেনা টিকাটি নেবেন? সাহসী নয়, পাওয়া গেল একজন সাহসিনিকে। ভেরোনিকা কস্তা নামের এক অসীম সাহসী নার্স টিকা নিয়ে অক্ষত থেকে জানালেন, টিকাতে অনিশ্চয়তার চেয়ে অনেক বেশি নিশ্চয়তা। আশঙ্কার নয়। এটা আশার।

এক বছর পর বুস্টার ডোজ দেয়ার সময় যখন এল তখনও ভেরোনিকাকে তার প্রাপ্য হিসাবে প্রথম টিকাটি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গী হতে আগ্রহী অনেক বড় মানুষ। তাদের অনেকেই বুস্টার ডোজ দিয়ে দিলেন। ৭ কোটির বেশি মানুষকে দুই ডোজ দিয়ে দেয়া হয়েছে, এক ডোজসহ হিসাব করলে সংখ্যাটা আরও কয়েক কোটি বেশি। তবু প্রয়োজন অনুযায়ী পুরো জনগোষ্ঠীর আশি শতাংশ এখনও সাধারণ সুরক্ষার আওতায় আসেননি, সেখানে কাউকে কাউকে বুস্টার ডোজ দিতে গেলে পুরো প্রক্রিয়াটা বাধাগ্রস্ত হওয়ার একটা ভয়। আবার অন্য দিক থেকে দেখতে গেলে, ওমিক্রনে যেহেতু বুস্টার ডোজটা জরুরি এবং এখানে বয়স্ক মানুষেরা বেশি ঝুঁকিপূর্ন, কাজেই সিদ্ধান্তটা সেই হিসাবে অনেকের কাছে সঠিক। ৬০ বছরের বেশি মানুষ আর সম্মুখযোদ্ধারা অগ্রাধিকার পাবেন/পাচ্ছেন এ ক্ষেত্রে। তাতে সমস্যা দুটো। ১. বুস্টার ডোজের অ্যাপটা হালনাগাদ হয়নি। ২. ভয় কমে যাওয়াতে 'নির্ভীক' বড় মানুষের সংখ্যা এত এত বেড়ে গেছে যে এই কাড়াকাড়িতে না সত্যিকারের প্রাপ্যরা আড়ালে হারিয়ে যায়।

শুরুতে কিছু ইঙ্গিত মিলেছে। আর আমরা ঘরপোড়া ঘরু। সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।

টিকা নিয়ে যে অনিয়মের শঙ্কা শুরুতে ছিল তার অনেকটাই সত্য হয়েছে। অনেকটা হয়নি। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি বিস্মিত হয়েছি। বক্ষব্যাধি হাসপাতালে টিকা নিতে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল, ভিড়-টানাপোড়েন ইত্যাদিতে জেরবার হতে হবে। গেলাম।স্বেচ্ছাসেবকেরা এমনভাবে স্বাগত জানাল, কাগজপত্র ঠিক করতে এমন ব্যস্ততা দেখাল যে একেকবার খটকা লাগল সত্যিই বাংলাদেশের কোনো হাসপাতালে এসেছি কিনা। লম্বা লাইন নেই। সিরিয়াল ভাঙ্গার অপচেষ্টা নেই। এবং যারা টিকা দিল তারাও এমন অক্লান্ত আর হাসিমুখ যে পুরো বিষয়টা উৎসবের মত হল।

সমস্যা দেখা দিল টিকা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা পর। আবার একটা এসএমএস, যাতে টিকা দেয়ার একটা তারিখ দেয়া হয়েছে। সেই তারিখ আবার কয়েকদিন আগে পেরিয়ে গেছে। সত্যি বললে, শুরুতে টিকাটাও খুব স্বচ্ছন্দ হওয়ার কারণ বোধহয় ছিল মানুষের অনাগ্রহ। খুব বেশি মানুষ আগ্রহী নয় বলে যারা গেছেন জামাই আদর পেয়েছেন। তাছাড়া তখন করোনার তোপও সাময়িক বিরতি নিয়েছে। অনেকে এই বিরতিকে বিদায় ধরে নিয়ে ভাবছিল, এখন আর খামাখা টিকা দিয়ে ঝামেলা টেনে আনার দরকার কী!

কয়েক মাসের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে করোনা এমন বিষদাঁত নিয়ে এল যে, এবার টিকার জন্য লম্বা লাইন। এসএমএসের অপেক্ষা। কোথাও কোথাও ভাঙচুর পর্যন্ত। মাঝখানে গণটিকা দিতে গিয়ে ঝামেলা কমার বদলে বাড়ল। এরা নগদ টিকা পেয়ে গেল কিন্তু যারা আগে রেজিস্ট্রেশন করে বসে আছে তাদের আবার সেই সুযোগ নেই। ওদিকে গণটিকার ধাক্কায় টিকায় টান পড়াতে তাদের অপেক্ষা শেষ হয় না। আমার পরিচিত কয়েকজন দুই তিন মাস অপেক্ষা করে শেষে ধরাধরি করে টিকা দিতে পারলেন।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে টিকার একরকম রোলার কোস্টার রাইড হয়েছে। প্রথমে তুমুল অনাগ্রহ। পরে দারুণ টানাটানি। এবং ক্রমে যোগান-সরবরাহ সব এক লাইনে চলে আসাতে পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল কতজন টিকা দিলেন না দিলেন সেটা পত্রিকার তৃতীয় পৃষ্ঠার সংবাদ। আর এরকম সময়েই ওমিক্রন এবং বুস্টার ডোজের আগমনী আওয়াজ।

বুস্টার ডোজ নিয়ে ঘরপোড়া গরুর গল্প তো বললামই। আর ওমিক্রনের ক্ষেত্রে বোধহয় গল্পটা হবে যত গর্জে তত বর্ষে না। এই লেখার ঠিক আগে যুক্তরাজ্যের একটা গবেষণা দেখলাম, যাতে বলা হয়েছ ডেল্টার চেয়ে ওমিক্রন অনেক কম গুরুতর। তা ডেল্টাসহ করোনার সব ধরনকে আমরা যেভাবে সামাল দিয়েছি তাতে মনে হয় না আর কোনো গুরুতর আঘাত আসবে।

করোনা যখন প্রথম এল তখন এক বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। টেলিফোনে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘শেষ হয়ে যাবে। সব শেষ।'

‘কী শেষ?'

‘মরে সব সাফ হয়ে যাবে।'

‘অবস্থা এতটাই খারাপ হবে?'

‘ইতালি-স্পেনের মত দেশ, যাদের মেডিক্যাল সিস্টেম হাজারগুণ ভালো তাদেরই এই অবস্থা। এই দেশে কিয়ামত হয়ে যাবে।'

মোস্তফা মামুন, সাংবাদিকছবি: DW

কিয়ামত একরকম হল! তবে করোনায় নয়, করোনাভীতিতে। মানুষ ভয় থেকে এমন নিষ্ঠুর আচরণ করতে থাকল যে চেনা মানুষদের অচেনা মূর্তি দেখে স্তম্ভিত। কাজের মানুষ-ড্রাইভারেরা বেশিরভাগ বিদায় হল। করোনা আক্রান্ত একা-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াল না প্রতিবেশীরা। লাশ দাফনে যেতে রাজি নয় আত্মীয়-স্বজন। ডাক্তার-নার্সদের বাড়িভাড়া দিতে আপত্তি কিছু পাষণ্ড বাড়িওয়ালার। দুর্যোগ মানুষের সব রূপ দেখায়। এই মানবিক পতনের মধ্যে দেখা মিলল কিছু মানুষের, জীবনকে তুচ্ছ করে যারা ঝাঁপাল। তাতে আবার জানা গেল, যত করোনা আসুক শেষপর্যন্ত পৃথিবী এদের কারণেই টিকে থাকবে।

করোনা ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে তাই এই শিক্ষাও দিয়ে গেল, মানুষের আসল রূপ বের হয় বিপদে। যে মানুষকে মহামানুষ মনে করি সে হয়তো আসলে অতি সামান্য। আবার কোনো কোনো সাধারণ কী অসাধারণ!

দ্বিতীয় শিক্ষা আরও গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ ধারণা ছিল আমাদের শ্রমজীবী-গরিব মানুষেরা শেষ হয়ে যাবে একদম। স্বাস্থ্যবিধি মানে না। পুষ্টিকর খাবার নেই। রোগে-শোকে এরা দাঁড়াতেই পারবে না এই তোপের

সামনে। মাসখানেক পর দেখা গেল, করোনা প্রত্যাশিত বিষাক্ত হচ্ছে না শ্রমজীবীদের জন্য।

রহস্য বের করতে আমাদের পত্রিকায় এই নিয়ে বিষদ আয়োজন হল। যে রিপোর্টার খবরটা করতে গিয়েছিল, সে এসে বিস্ময়কর বর্ণনা দিল। ওদের জ্বর-টর হচ্ছে। পাত্তাই দিচ্ছে না। টেস্ট করানো নিয়ে তখন এমন সব কাণ্ড যে ওদের সেই সুযোগই নেই। তারা দরকারও মনে করছে না। রিপোর্টার বললেন, ‘সবচেয়ে মজার ব্যাপার কী জানেন, ওরা বিশ্বাস করে এটা বড়লোকের রোগ।'

রোগেরও যে বড়লোক-ছোটলোক ভেদ আছে আমরা জানতাম না। এবং আসলে নেই। অবস্থপন্নরা ডাক্তার-হাসপাতাল করতে পারে বলে অসুখে তুলনামুলক নিরাপদ থাকে। গরিবেরা বিপদে পড়ে চিকিৎসার অভাবে। এই সাধারণ ধারণাও গড়াগড়ি খেল। জানা গেল, আসল বিষয় রোগ প্রতিরোধের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা। চিকিৎসাবিজ্ঞান এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখে জানাল, কায়িক পরিশ্রম বেশি করে বলে তাদের প্রতিরোধক্ষমতা বেশি। তাই সেখানে করোনা খুব সুবিধা করতে পারছে না।

আমাদের যে চিকিৎসাবিজ্ঞানবোধ সেটাকে আমূল বদলে শরীর-স্বাস্থ্যের মানেটা অন্যরকম করে দিয়ে গেল করোনা। আরও বড় করে দেখলে, যত গরিব দেশ তারা তত বেশি করোনাপ্রতিরোধী। তাই আমেরিকা-ফ্রান্স-স্পেন-ইতালি বা ইউরোপের তুলনায় এশিয়া-আফ্রিকার ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক কম।

আর তা থেকেই মনে হয় ওমিক্রন হয়ত আমরা জয় করে। হয়ত গর্জন-বর্ষণের গল্প হবে। এখন বুস্টার ডোজের সিঁদুরে মেঘ দেখার গল্প সত্যি না হলেই হয়।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ