বাংলাদেশে করোনার বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হয়েছে৷ কিন্তু সুরক্ষা অ্যাপটি পুরোপুরি আপডেটেড না হওয়ায় ২৮ ডিসেম্বরের আগে পুরোমাত্রায় শুরু হচ্ছে না৷
বিজ্ঞাপন
আর এটা আপাতত পাবেন ষাটোর্ধ্বরা৷ অবশ্য বুস্টার ডোজ নিতে নিবন্ধনের প্রয়োজন নেই বলে বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সাবরিনা ফ্লোরা৷
১৯ ডিসেম্বর অনেকটা ঘটা করেই বুস্টার ডোজ নিলেন পাঁচ মন্ত্রী৷ নিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক৷ আর নিয়েছেন সেই স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা, যিনি প্রথম বাংলাদেশে করেনার টিকা নিয়েছিলেন৷
করোনার নতুন ভেরিয়েন্ট ‘ওমিক্রন’ বাংলাদেশেও এসে গেছে৷ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন৷ বলা হচ্ছে সেই কারণেই প্রধানত বুস্টার ডোজের উদ্যোগ৷ তাহলে সেটা শুধু ষাটোর্ধ্ব নাগরিদের জন্য কেন? এর জবাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে এপর্যন্ত যারা করেনায় মারা গেছেন তাদের ৮৫ ভাগেরই ৬০ এর বেশি বয়স৷ দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য এই উদ্বেগ আর সুরক্ষা অবশ্যই প্রশংসনীয়৷ তবে প্রশ্ন আছে দেশের সব নাগরিকের সুরক্ষা কি সম্ভব হয়েছে? সবাইকে কি টিকার আওতায় আনা গেছে? সবাইকে টিকা না দিয়ে বুস্টার ডোজ শুরু করা কোনো অসাম্য কী না?
দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে করোনার টিকা দেয়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের৷ সেই হিসেবে মোট ১২ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে৷ আর দুই ডোজ করে টিকা দিতে মোট টিকা লাগবে ২৫ কোটি ৬০ লাখ ডোজ৷ এপ্রিল মাসের মধ্যে এই টিকা দিতে হলে এখন পর্যন্ত যা দেয়া হয়েছে সেই বিবেচনায় আরো ১৫ কোটি ডোজ টিকা লাগবে৷ কিন্তু সরকারের হাতে আছে এখন টিকা আছে চার কোটি ৬৩ লাখ৷
বুস্টার ডোজের আদ্যোপান্ত
করোনা ভাইরাসের ভ্যারিয়েন্ট ও টিকার আলোচনায় সবশেষ সংযোজন ওমিক্রন ও বুস্টার ডোজ৷ বুস্টার ডোজের আলোচনা আগেই ছিল৷ তবে ওমিক্রন আসায় বুস্টার ডোজের প্রয়োগে গতি পেয়েছে বেশ৷ ছবিঘরে দেখুন বুস্টার ডোজের আদ্যোপান্ত৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
বুস্টার ডোজ কী?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, করোনা ভাইরাস ঠেকাতে টিকার প্রাথমিক পূর্ণ ডোজ (ধরন হিসেবে এক বা দুই ডোজ) পাওয়া একটি জনসংখ্যার মাঝে টিকার কার্যকারিতা নির্দিষ্ট মাত্রার নিচে নেমে যাওয়ায় বাড়তি যে ডোজ দেয়া হচ্ছে তাকেই বলা হচ্ছে বুস্টার ডোজ৷ এটি দেয়ার মূল লক্ষ্য হল, মানবশরীরে টিকার কার্যকারিতা বাড়ানো৷
ছবি: Tsafrir Abayov/AP Photo/picture alliance
পেলেন কতজন?
‘আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা’র ২২ ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত হিসেব বলছে, পুরো পৃথিবীতে প্রতি ১০০ জনে ৫.৮৬ জন বুস্টার ডোজ পেয়েছেন৷ এর মধ্যে চিলির বুস্টার পাওয়ার হার সবচেয়ে বেশি ৫২.৬৮%৷ এছাড়া যুক্তরাজ্যে প্রতি ১০০ জনে ৪৫.২২, ইসরায়েলে ৪৪.৮৯ ও উরুগুয়েতে ৪২.৫৯ জন পেয়েছেন এই ডোজ৷
ছবি: Lukas Barth/REUTERS
ছয় না তিন মাস?
প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছিল, টিকার পূর্ণডোজের ছয়মাস পর বুস্টার ডোজ নেয়া যেতে পারে৷ কারণ ছয় মাস পর টিকার কার্যকারিতা এরপর কমতে শুরু করে৷ কিন্তু সম্প্রতি জার্মানির টিকা কমিশন বা এসটিআইকেও বলছে, পূর্ণ ডোজের তিন মাস পরই নেয়া যাবে বুস্টার৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
ওমিক্রনের টেনশন
করোনা ভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রনের প্রকোপের কারণে বুস্টার ডোজের প্রতি ঝুঁকছে দেশগুলো৷ যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপে ওমিক্রনের প্রভাব বাড়ায় নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের পাশাপাশি বুস্টার টিকার ওপর জোর বাড়ানো হচ্ছে৷
ছবি: Fleig/Eibner-Pressefoto/picture alliance
ইউরোপে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা
ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এরইমধ্যে বুস্টার ডোজ ছাড়া ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারির সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ সম্প্রতি ইউরোপীয়ান কমিশন ঘোষণা দিয়েছে, প্রাথমিক পূর্ণ ডোজ পাওয়া ব্যক্তিরা বুস্টার ডোজ না নেয়া থাকলে কেবল নয় মাস ইউরোপে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন৷ অন্যথায় তাদের ভ্যাকসিন পাসপোর্ট কার্যকর থাকবে না৷
ছবি: Frank Hoermann/SVEN SIMON/picture alliance
ওমিক্রনে বুস্টার কতটা কার্যকর?
ওমিক্রন ঠেকাতে বুস্টার ডোজ কতটা কার্যকর তা নিশ্চিত করে এখনো (ডিসেম্বর ২০২১ পর্যন্ত) বলতে পারেনি ইউরোপীয় মেডিসিনস এজেন্সি কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ কোন কোন টিকা কোম্পানি দাবি করছে, তাদের টিকা এই ভ্যারিয়েন্ট প্রতিরোধে কার্যকর৷ তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু টিকা নয়, মাস্ক পরাসহ বিধিনিষেধ অনুসরণ করলেই কেবল প্রচণ্ড সংক্রমক ওমিক্রনকে ঠেকানো যাবে৷
ছবি: Charlotte Chelsom-Pill/DW
বাধ্যতামূলক টিকা
ইউরোপে অস্ট্রিয়াতে সবার আগে করোনার টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ জার্মানিতে হাসপাতাল ও নার্সিং হোমগুলোতে কাজ করাদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে৷ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যেও অনেক দেশ টিকার ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করেছে৷ এছাড়া ২০২২ সালের শুরুতে অনেক দেশেই বিশেষ বিশেষ পেশা বা বয়সের মানুষের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করবে বলে জানিয়েছে৷
ছবি: Martin Meissner/ASSOCIATED PRESS/picture alliance
টিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
অন্যদিকে, বুস্টারসহ কোন ধরনের টিকা নিতে চান না এমন লোকেরও অভাব নেই৷ অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপের অনেক জায়গায় টিকা ও বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে সম্প্রতি ব্যাপক আন্দোলন দেখা গেছে৷ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষও হয়েছে প্রতিবাদকারীদের৷
ছবি: Angelo Carconi/ANSA/picture alliance
ধনী দেশে বুস্টার, আর গরীব দেশে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উন্নত বিশ্বের লোকজন যে ঢালাওভাবে করোনার বুস্টার টিকা দেয়া শুরু করেছে, তার নিন্দা জানিয়েছে৷ বিশ্বের অনেক দেশে এখন প্রয়োজনীয় প্রাথমিক টিকার সংস্থানও হয়নি৷ আফ্রিকা মহাদেশের বেশ কয়েকটি দেশে ১ শতাংশের কম মানুষ টিকার আওতায় এসেছেন৷ সেখানে বিশ্বে এখন ২০ ভাগ টিকা বুস্টার ডোজ হিসেবে দেয়া হচ্ছে৷
ছবি: Evrard Ngendakumana/Xinhua/imago images
মিশন চতুর্থ বুস্টার
তৃতীয় ডোজ বা বুস্টার ডোজের পর এখন আলোচনা চতুর্থ ডোজ নিয়ে৷ জার্মানির ডাক্তার অ্যাসেসিয়েশনের প্রধান উলরিশ ভাইগেল্ডট সম্প্রতি বলেন যে, ২০২২ সালের গ্রীষ্মে বা তারপর চতুর্থ বুস্টার ডোজের প্রয়োজন পড়তে পারে৷
ছবি: Paul White/AP/picture alliance
10 ছবি1 | 10
তবে সরকার বলছে চলতি মাসেই আরো ছয় কোটি ৫৫ লাখ টিকা আসবে৷ ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে ৯ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যাবে৷ সেই হিসেব করলে মার্চ মাসে ১৬ কোটি ডোজের বেশি টিকা আসছে বাংলাদেশে৷ সেটা হলে টিকা নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়৷ কিন্তু সরকারের পরিকল্পনায় সবার জন্য যদি বুস্টার ডোজের ব্যবস্থা করা হয় তাহলে কিন্তু এই টিকায় কুলোবে না৷ আর বুস্টার ডোজ তো সবার প্রাপ্য৷
তাই প্রশ্ন এখানে দুইটি:
১.সবাই দুই ডোজ টিকা পাওয়ার আগে বুস্টার ডোজ কি অসাম্য সৃষ্টি করবে?
২. সবাইকেই কি বুস্টার ডোজ দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের আছে?
ষাটোর্ধ্ব কত নগরিক এখন পর্যন্ত টিকা পেয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে হাতে সঠিক সংখ্যাটি এখনও নাই৷ তারা বলছেন ষাটোর্ধ্বদের ৬০ ভাগ টিকা পেয়েছেন৷ কিন্তু তারা সবাই কি দুই ডোজ পেয়েছেন৷ এই হিসাব করতে আরো সময় নেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়৷ হিসাব থাকলে তারা বলে দিতে পারতেন ষাটোর্ধ্বদের বুস্টার ডোজ দিতে কত টিকা লাগবে৷ তবে সাধারণ ভাবে একটি হিসাব বের করা যায়৷ দেশের মোট নাগরিকদের ৬.১ ভাগ ষাটোর্ধ্ব ৷ জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে তাদের সংখ্যা এক কোটির বেশি৷ তার ৬০ ভাগ ৬০ লাখের বেশি৷ তাহলে বুস্টার ডোজ দিতে ৬০ লাখের বেশি টিকা লাগবে৷ আর দেশের সবাই যদি টিকা পেয়ে যায় তাহলে সবাইকে বুস্টার ডোজ দিতে লাগবে ১২ কোটি ৮০ লাখ অতিরিক্ত টিকা৷
কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ পেয়েছেন ছয় কোটি ৯৪ লাখ ২৯ হাজার ৮০১ জন৷ দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন চার কোটি ৭৬ লাখ ৩৯ হাজার ৪২৫ জন৷ বুস্টার ডোজ পেয়েছেন ১০ জন৷ শতকরা হিসেবে প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৫০ ভাগের বেশি মানুষ৷ আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩৫ ভাগের বেশি৷ এটা মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগের হিসেবে৷
বুস্টার ডোজ নিবন্ধন করেই নিতে হবে৷ তাই সুরক্ষা অ্যাপটি আপডেটেড না করা পর্যন্ত আসলে বুস্টার ডোজ ওই অর্থে শুরু হচেছ না৷
করোনায় এপর্যন্ত বাংলাদেশে মারা গেছেন ২৮ হাজার ৫২ জন৷ মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১৫ লাখ ৮১ হাজার ৯৮৬ জন৷ যারা মারা গেছেন তাদের মধ্যে ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সের সর্বোচ্চ আট হাজার ৭০১ জন৷ শতকরা হিসেবে ৩১.২ ভাগ৷ মৃত্যুর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সীরা৷ তাদের সংখ্যা ছয় হাজার ৬১৪ জন৷ শতকরা হার ২৩.৫৮৷ তৃতীয় অবস্থানে ৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সীরা৷ তাদের সংখ্যা চার হাজার ৮৬৯ জন৷ শতকরা হিসেবে ১৭.৩৬ ভাগ৷
এই হিসেব দেখলে এটা স্পষ্ট যে এখনকার বুস্টার ডোজের বয়স সীমা সর্বনিম্ন ৫০ থেকে ধরা উচিত ছিলো৷