বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিতে উপযুক্ত কর্মীর সংকট দেখা দিয়েছে জার্মানিতে৷ আর এই সংকট কাটাতে একটি জার্মান ভোকেশনাল স্কুল শরণার্থীদের প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
এক বৃদ্ধার মতো দেখতে একটি ডামির চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন আটজন শরণার্থীর একটি দল৷ একজন প্রশিক্ষক দলটিকে জানান যে, বৃদ্ধার নাম ফ্রাউ ম্যুলার এবং তার স্ট্রোক হয়েছে৷ তিনি তার মুখের মধ্যে ব্যথা অনুভব করছেন৷ এরপর একজন শরণার্থী বলা হয় ব্যথার কারণ অনুসন্ধান করতে৷ ‘‘তার জিহ্বা সাদা হয়ে গেছে৷ সম্ভত মুখে ঘা হয়েছে'', বলেন একজন শিক্ষার্থী৷
ইরাক, আফগানিস্তান, এবং সিরিয়া থেকে আসা এই শিক্ষার্থীরা প্রতি সপ্তাহের সোমবার থেকে শুক্রবার অবধি ‘বন অ্যাসোসিয়েশন ফর হেল্থকেয়ার ইন ওয়েস্টার্ন জার্মানি' নামক একটি সংগঠনে বৃদ্ধদের পরিচর্যা বিষয়ক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছেন৷ তারা বাকিউফা নামের ছয়মাস মেয়াদি একটি প্রশিক্ষণ কর্মসূচির শিক্ষার্থী৷ প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হচ্ছে বৃদ্ধদের নার্সিং সেবা দিতে শরণার্থীদের প্রাথমিকভাবে প্রস্তুত করার পাশাপাশি তাদের জার্মান ভাষা শিক্ষা দেয়া৷
ইউরোপে শরণার্থী সংকট কীভাবে শুরু হয়েছিল?
মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় সহিংসতা বৃদ্ধি থেকে ইউরোপের অসংলগ্ন শরণার্থী নীতি অবধি ইউরোপে শরণার্থী সংকটে কারণগুলো তুলে ধরা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
যুদ্ধ এবং দারিদ্র্যতা থেকে পালানো
২০১৪ সালের শেষের দিকে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চতুর্থ বছরে পা দেয়ার প্রাক্কালে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে তথাকথিত ‘ইসলামিট স্টেট’-এর বিস্তার ঘটার পর সিরীয়দের দেশত্যাগের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়৷ একইসময়ে সহিংসতা এবং দারিদ্র্যতা থেকে বাঁচতে ইরাক, আফগানিস্তান, ইরিত্রিয়া, সোমালিয়া, নিগার এবং কসভোর অনেক মানুষ ইউরোপমুখী হন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সীমান্তের ওপারে আশ্রয় খোঁজা
সিরীয় শরণার্থীদের অধিকাংশই ২০১১ সাল থেকে সে দেশের সীমান্ত সংলগ্ন তুরস্ক, লেবানন এবং জর্ডানে আশ্রয় নিতে শুরু করেন৷ কিন্তু ২০১৫ সাল নাগাদ সেসব দেশের শরণার্থী শিবিরগুলো পূর্ণ হয়ে যায় এবং সেখানকার বাসিন্দারা সন্তানদের শিক্ষা দিতে না পারায় এবং কাজ না পাওয়ায় এক পর্যায়ে আরো দূরে কোথাও যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পায়ে হেঁটে লম্বা পথ পাড়ি
২০১৫ সালে ১৫ লাখের মতো শরণার্থী ‘বলকান রুট’ ধরে পায়ে হেঁটে গ্রিস থেকে পশ্চিম ইউরোপে চলে আসেন৷ সেসময় ইউরোপের শেঙেন চুক্তি, যার কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অধিকাংশ দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই চলাচাল সম্ভব, নিয়ে প্রশ্ন ওঠে৷ কেননা শরণার্থীরা গ্রিস থেকে ধীরে ধীরে ইউরোপের অপেক্ষাকৃত ধনী রাষ্ট্রগুলোর দিকে আগাতে থাকেন৷
ছবি: Getty Images/M. Cardy
সমুদ্র পাড়ির উন্মত্ত চেষ্টা
সেসময় হাজার হাজার শরণার্থী ‘ওভারক্রাউডেড’ নৌকায় করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে শুরু করেন৷ লিবিয়া থেকে ইটালি অভিমুখী বিপজ্জনক সেই যাত্রায় অংশ নিতে গিয়ে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসে সাগরে ডুবে যায় অন্তত আটশ’ মানুষ৷ আর বছর শেষে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরা শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় চার হাজার৷
ছবি: Reuters/D. Zammit Lupi
সীমান্তে চাপ
ইউরোপের বহির্সীমান্তে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় কয়েকটি রাষ্ট্র চাপে পড়ে যায়৷ হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ম্যাসিডোনিয়া এবং অস্ট্রিয়া এক পর্যায়ে সীমান্তে বেড়া দিয়ে দেয়৷ শুধু তাই নয়, সেসময় শরণার্থী আইন কঠোর করা হয় এবং শেঙেনভুক্ত কয়েকটি দেশ সাময়িকভাবে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করে৷
ছবি: picture-alliance/epa/B. Mohai
বন্ধ দরজা খুলে দেয়া
জার্মান চ্যান্সেল আঙ্গেলা ম্যার্কেলের সমালোচকরা মনে করেন, তাঁর ‘ওপেন-ডোর’ শরণার্থী নীতির কারণে বিপজ্জনক পথ পেরিয়ে অনেক শরণার্থীই ইউরোপে আসতে উৎসাহ পেয়েছেন৷ এক পর্যায়ে অবশ্য অস্ট্রিয়ার সঙ্গে সীমান্ত পথ নিয়ন্ত্রণ শুরু করে জার্মানিও৷
ছবি: Reuters/F. Bensch
তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি
২০১৬ সালের শুরুতে ইইউ এবং তুরস্কের মধ্যে একটি চুক্তি হয়৷ এই চুক্তির আওতায় গ্রিসে আসা শরণার্থীদের আবারো তুরস্কে ফিরিয়ে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়৷ তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই চুক্তির বিরোধিতা করে৷ নভেম্বর মাসে অবশ্য তুরস্কের ইইউ-তে প্রবেশের সম্ভাব্যতা নিয়ে আলোচনা স্থগিত ঘোষণার পর, সেই চুক্তি আবারো নড়বড়ে হয়ে গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Altan
পরিস্থিতি বদলের কোনো লক্ষণ নেই
ইউরোপজুড়ে অভিবাসীবিরোধী মানসিকতা বাড়তে থাকলেও সরকারগুলো সম্মিলিতভাবে শরণার্থী সংকট মোকাবিলার কোনো সঠিক পন্থা এখনো খুঁজে পাননি৷ কোটা করে শরণার্থীদের ইইউ-ভুক্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা কার্যত ব্যর্থ হয়েছে৷ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতার ইতি ঘটার কোনো লক্ষণও নেই৷ ওদিকে, সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে শরণার্থীদের মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়তে শুরু করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/S. Mitrolidis
8 ছবি1 | 8
সংগঠনটির মুখপাত্র বির্গিট শিয়ারবাউম এ বিষয়ে বলেন, ‘‘শরণার্থীদের সুযোগ দেয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে৷ বৃদ্ধদের জন্য কাজ করতে পারেন এমন মানুষের সংখ্যা বেশি নেই৷ শরণার্থীরা কাজ করতে চান এবং নার্সিং কেয়ার হচ্ছে এমন এক পেশা যেখানে সামনে আগানোর সুযোগ আছে৷''
প্রশিক্ষণ কর্মসূচির পরিচালক শিলান ফেন্ডি এ সম্পর্কে বলেন, ‘‘দলটির মধ্যে আগ্রহ অনেক৷ আর নারী ও পুরুষ অংশগ্রহণকারীরা একে অপরকে সহায়তা করছেন৷'' ফেন্ডি প্রশিক্ষক হিসেবে পুরো দলকে সহায়তা করেন৷ এমনকি কোর্সের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত একমাসের ইন্টানর্শীপের জন্য জায়গাও খুঁজে দেন তিনি৷
জার্মানিতে আশ্রয়ের আবেদন বেড়েছে
জার্মানির অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএএমএফ বলছে, মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে রাজনৈতিক আশ্রয় আবেদনের সংখ্যা বেড়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Shkullaku
২.৩ শতাংশ বৃদ্ধি
জার্মানির অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক কেন্দ্রীয় সংস্থা বিএএমএফ এর সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে, এপ্রিল মাসে মোট ৫৯,৬৮০টি আবেদন পড়েছে৷ মার্চ মাসে সংখ্যাটি ছিল ৫৮,৩১৫, অর্থাৎ ১,৩৬৫টি কম৷
ছবি: Brian Leli
শীর্ষে সিরিয়া
সবচেয়ে বেশি আবেদন করেছেন সিরিয়ার নাগরিকরা৷ ২৫,৭৯১ জন৷ অবশ্য মার্চ মাসে সংখ্যাটি ছিল সাড়ে সাত শতাংশ বেশি৷ ২৭,৮৭৮ জন৷
ছবি: Fotolia
প্রথম চার মাসেও শীর্ষে সিরিয়া
২০১৬ সালের প্রথম চার মাসে এক লক্ষ ১৬ হাজার ৮২৬ জন সিরীয় নাগরিক জার্মানিতে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন৷ আর সব দেশ মিলিয়ে আবেদনের সংখ্যা দুই লক্ষ ৪৬ হাজার ৩৯৩ জন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
ইরাকিদের সংখ্যা বেড়েছে
মোট হিসেবে সিরিয়ার পরেই আছে ইরাক৷ তবে সিরিয়ার ক্ষেত্রে আবেদনের সংখ্যা এপ্রিলের চেয়ে মার্চে বেশি হলেও ইরাকের ক্ষেত্রে হয়েছে উল্টো৷ অর্থাৎ মার্চের চেয়ে এপ্রিলেই বেশি ইরাকি আবেদন করেছেন৷ ৯,৫০৫ জন৷ মার্চে ছিল ৮,৯৮২ জন৷
ছবি: DW/R. Shirmohammadi
তৃতীয় স্থানে আফগানিস্থান
সিরিয়া ও ইরাকের পর তালিকায় তিন নম্বরে আছে আফগানিস্তান৷ এপ্রিলে ৮,৪৫৮ জন আফগান রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন৷ মার্চ মাসের চেয়ে সংখ্যাটি ১১.৮ শতাংশ বেশি৷
ছবি: DW/Omid
জাতীয়তা জানা নেই
জাতীয়তা ‘অস্পষ্ট’ এমন আবেদনের সংখ্যা এপ্রিলে ছিল ১,২৯৯ জন৷ সংখ্যাটি মার্চ মাসে ছিল আরও বেশি৷ ১,৮৬৯ জন৷
ছবি: Reuters/A.Konstantinidis
পাঁচ নম্বরে ইরান
১,৯৮১ আবেদন নিয়ে তালিকায় ইরানের নাম আছে পাঁচ নম্বরে৷ ছয়-এ আছে আলবেনিয়া (১,১৮৮ জন)৷ পাকিস্তানি আবেদনের সংখ্যা ১,০৩৮; আর ইরিত্রিয়ার ১,১৫২৷
ছবি: Getty Images/AFP/G. Shkullaku
7 ছবি1 | 7
নার্সিং কোর্সের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন৷ তাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে৷ ২৭ বছর বয়সি রামি বাজি নিজের দেশ আফগানিস্তানে ফিজিক্যাল থেরাপি নিয়ে লেখাপড়া করেছেন৷ এমনকি তিন বছর কাজও করেছেন৷ এরপর আর নিজ দেশে নিরাপদ বোধ না করায় শরণার্থী হিসেবে ইউরোপে পাড়ি জমান তিনি৷
তবে আফগানিস্তানে শিক্ষা গ্রহণ করায় সরাসরি জার্মানির স্বাস্থ্যসেবা খাতে চাকুরি নেয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে যাচ্ছেন না বাজি৷ বরং প্রয়োজন অনুযায়ী জার্মানিতেও তাঁকে কোর্স করতে হবে৷ তারমতো অবস্থা আরো অনেকের৷ আর তাদের সহায়তা করছে বাকিউফা কোর্সটি৷ আগামী অক্টোবর অবধি চলবে এই কোর্স৷
ইন্ফোমাইগ্রেন্টস – সকল সত্ত্ব সংরক্ষিত
বাহ্যিক ওয়েবসাইটের কন্টেন্টের জন্য ইন্ফোমাইগ্রেন্টস দায়বদ্ধ নয়৷
জীবন বাজি রেখে ইউরোপের পথে
অভিবাসনের আশায় বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকেই ইউরোপে আসছেন৷ ইটালির ‘পাসো ডেলা মর্তে’ হয়ে ইউরোপের আরো উত্তরের দেশগুলোতে আসতে জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন অনেকে৷ ফটোসাংবাদিক ফেডেরিকো স্কপা ছিলেন তেমন শরণার্থীদের সঙ্গে....
ছবি: DW/F.Scoppa
গহীন জঙ্গল, দুর্গম পথ
জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সভয়ে এগিয়ে চলেছে আফগান কিশোরদের একটি দল৷ সব সময় ভয় – পুলিশ যদি দেখে ফেলে! এই ভয় নিয়ে, দুর্গম পাহাড়ি পথ ধরেই পেরোতে হবে ‘ডেথ পাস টু ফ্রান্স’৷ যাত্রা শেষ হতে এখনো ১২ কিলোমিটার বাকি৷
ছবি: DW/F.Scoppa
পদে পদে বিপদ
ইটালির ভেনটিমিগলিয়া শহর আর ফ্রান্সের মেতোঁর মাঝখান দিয়ে এক সময় হাইওয়ের টানেলের ভেতর দিয়ে, কখনো রেলপথ ধরে, কখনো বা গিরিপথ ধরে হেঁটে হেঁটে এগিয়ে যেতে হয়৷ যে কোনো মু্হূর্তেই ঘটে যেতে পারে সমূহ বিপদ৷
ছবি: DW/F.Scoppa
তীব্র গতি, দৃষ্টি ক্ষীণ
অভিবাসনপ্রত্যাশীদের্ অনেকেই প্রাণ হাতে নিয়ে এই হাইওয়ে টানেল ধরে ধরে হেঁটে পৌঁছাতে চান ফ্রান্স৷ জীবনের ঝুঁকি তাদের প্রায় প্রতি পদক্ষেপে৷
ছবি: DW/F.Scoppa
প্রকৃতির আশ্রয়ে, প্রকৃতির ভরসায়
কীভাবে যেতে হবে তা না জেনে, সঙ্গে কোনো খাবার না নিয়েও ‘ডেথ পাস’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন অনেকে৷ প্রকৃতির উদারতাই তাদের একমাত্র ভরসা৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতীয় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের রুখতে ফরাসি সরকার তৈরি করেছিল এই প্রাচীর৷ শান্তির পতাকাও ওড়ানো হয় তখন৷ ইটালি ও ফ্রান্স সীমান্তের এই এলাকটি অভিবাসন প্রত্যাশীদের খুব পরিচিত রুট৷
ছবি: DW/F.Scoppa
ওই দেখা যায়..
৩০০ মিটার দূরেই ‘ডেথ পাস’-এর শীর্ষ বিন্দু৷ সেদিকেই তাকিয়ে আছে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ন তিন অভিবাসন প্রত্যাশী৷ এখানে অনেকেই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে৷ পুলিশ ধরলেই ফিরিয়ে দেয় ইটালিতে৷