বয়স দশ কি এগারো৷ নাম আদুরি৷ তবে আদরের কোনো চিহ্ন নেই তার শরীরে৷ বরং নির্মম নির্যাতনের শিকার শিশুটির ছবি দেখে আঁতকে উঠছেন সবাই৷ ঢাকার একটি ডাস্টবিন থেকে উদ্ধারের পর এখন হাসপাতালে আদুরি৷
বিজ্ঞাপন
ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি ডাস্টবিনে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল আদুরি৷ ২৩ সেপ্টেম্বর সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্থানীয় এক নারী৷ এরপর তিনি আদুরিকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে এসব তথ্য জানিয়েছেন পল্লবী থানার ওসি আব্দুল লতিফ৷
অমানবিক নির্যাতনের শিকার আদুরির ছবি ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে৷ এই বর্বর আচরণের প্রতিবাদ জানিয়ে ব্লগ লিখেছেন অনেকে, ফেসবুকে করেছেন মন্তব্য৷ সামহয়্যার ইন ব্লগে নাহিদুল আইসিটি লিখেছেন, ‘‘মা-বাবা নাম দিয়েছিলেন আদুরী৷ কিন্তু হায়রে নিয়তি!!! আদুরী নামের হতভাগার আদরের চিহ্ন দেখে ক্রমাগত যান্ত্রিকতার পথে এগিয়ে যাওয়া মানুষগুলো এক মুহূর্তের জন্য হলেও ধমকে গেছে বিবেকের কাঠগোড়ায়৷''
মৃত্যুকূপ থেকে যেভাবে ফিরলেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ এই সতের দিন তিনি কিভাবে কাটিয়েছেন? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
সুস্থ আছেন রেশমা
সাভারে ধসে পড়া ভবন থকে ১৭ দিন পর উদ্ধার করা হয় জীবিত রেশমাকে৷ তিনি এখন সুস্থ আছেন৷ কিন্তু ধসে পড়া রানা প্লাজার মধ্যে কিভাবে সতের দিন কাটিয়েছেন তিনি? প্রশ্ন অনেকের মনে৷ চলুন ছবিতে উত্তর খোঁজা যাক৷
ছবি: Reuters
উদ্ধার অভিযান
১০ মে স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া ৩টার দিকে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক ধসে পড়া ভবনের মধ্যে বেঁচে থাকা একজন মানুষের উপস্থিতি টের পান৷ সেই মানুষটি রেশমা৷ তিনি একটি ভাঙা পাইপ দিয়ে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং তাঁকে বাঁচানোর অনুরোধ জানান৷ এরপর রড কেটে ভিতরে ঢুকে বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে রেশমাকে বাইরে নিয়ে আসা হয়৷
ছবি: Getty Images/STRDEL
যেভাবে টিকে ছিলেন রেশমা
১৭ দিন রেশমা কি খেয়ে টিকে ছিলেন সেই প্রশ্ন অনেকের৷ উদ্ধারকর্মী রাজ্জাক জানান, ‘‘রেশমা যে তলায় আটকে ছিলেন সেটা অন্যান্য তলার মতো মিশে যায়নি৷ সেখানে হাঁটা-চলা এবং নড়া-চড়া করার কিছুটা সুযোগ ছিল৷ রেশমা তাঁকে জানান যে, ঐ জায়গায় বিভিন্ন ধরনের শুকনা ও জুস জাতীয় খাবার ছিল, যা তিনি খেয়েছেন৷ ৭ মে শুকনা খাবার শেষ হয়ে যায় আর রসালো খাবার যায় পচে৷ ফলে শেষের দু’দিন ধরে তিনি অভুক্ত ছিলেন৷’’
ছবি: Getty Images/AFP/STRDEL
চিকিৎসকের ব্যখ্যা
ধ্বংসস্তূপের নীচে রেশমার এই ১৭দিন বেঁচে থাকার ঘটনাকে ডয়চে ভেলের কাছে ব্যাখা করেছেন মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিত্সক অধ্যাপক ডা. মনি লাল আইচ৷ তিনি বলেন, ‘‘রেশমা ১৭ দিনে হৃদরোগ বা নিউরোলোজিক্যাল সমস্যায় পড়তে পারতেন৷ হয়ত মানসিক জোর এবং বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছার কারণেই তাঁকে সেই সমস্যায় পড়তে হয়নি৷ আর গবেষণায় প্রমাণিত যে নারীদের মানসিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি৷’’
ছবি: Reuters
গোটা বিশ্বে আলোড়ন
রেশমাকে ১৭ দিন পর জীবিত উদ্ধারের খবরে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্রুত সাভারে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে এই তরুণীকে দেখতে যান৷ রেশমাকে কেউ যাতে মানসিকভাবে পীড়া না দেয় সেজন্যও সবাইকে নির্দেশনা দেন শেখ হাসিনা৷
ছবি: dapd
তৃতীয় নারী রেশমা
১৭ দিন ধরে অন্ধকারে ডুবে থাকা রেশমাকে উদ্ধারের খবরের সঙ্গে একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিসি৷ এতে দেখা যাচ্ছে, এর আগে পাকিস্তানে একই রকম পরিস্থিতিতে নাকাশা বিবি নামক এক নারী পচা খাবার আর পানি খেয়ে টিকে ছিলেন ৬৩ দিন৷ আর হাইতির ইভান্স মোনসিজনাক টিকে ছিলেন ২৭ দিন৷ এই সময়ের পর তাদের জীবিত উদ্ধার করা হয়৷
ছবি: Getty Images
পরিবারের সঙ্গে দেখা
রেশমার মা জোবেদা খাতুন, দুই ভাই ও বোন আসমা গত কয়েকদিন ধরেই রয়েছেন সাভারে৷ হাসপাতালে রেশমার সঙ্গে দেখা করেছেন তারা৷ রেশমার বড় ভাই জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘বর্তমানে রেশমা ভালো আছে, সুস্থ আছে৷’’
ছবি: Reuters
বাড়ছে মৃতের সংখ্যা
এদিকে, সাভারে ভবন ধসে মৃতের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে৷ গত ২৪ এপ্রিল ভবন ধসের পর ১২ মে অবধি উদ্ধার করা হয়েছে ১,১২৭ টি মৃতদেহ৷ নিহতদের মধ্যে ঠিক কতজন নারী আর কতজন পুরুষ – সেই হিসেব এখন আরা জানা যাচ্ছে না৷ অনেক মরদেহ পচে গেছে৷ গোটা বিশ্বে স্মরণকালের মধ্যে ভয়াবহতম ভবন ধস এটি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তবুও কি সতর্ক আমরা?
সাভার ভবন ধসের পর কতটা সতর্ক হয়েছে বাংলাদেশ? এই প্রশ্ন অনেকর মনে৷ বিশেষ করে, যে পোশাক খাত বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তুলছে, সেই খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তায় সরকার কতটা সচেষ্ট? সর্বশেষ খবর হচ্ছে, শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার৷ রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক শিল্পের যে নেতিবাচক ‘ইমেজ’ তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতেই এই পদক্ষেপ৷
ছবি: Reuters
‘আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক’
শান্তিতে নোবেল জয়ী বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনূস গত ৯ মে একটি নিবন্ধের একাংশে লিখেছেন, ‘‘সাভার ট্র্যাজেডি জাতি হিসেবে আমাদের ব্যর্থতার প্রতীক৷ রানা প্লাজার ফাটল ফেটে ভবন ধসে দেখিয়ে দিলো আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যে বিশাল ফাটল ধরেছে সেটা আমলে না নিলে জাতিও এরকম ধসের ভেতর হারিয়ে যাবে৷’’
ছবি: AP
10 ছবি1 | 10
একই ব্লগ সাইটে সৈয়দ সাইফুল আলম শোভনের লেখার শিরোনাম, ‘‘আদুরী আজ বাংলাদেশ৷ আদুরীকে নির্যাতনকারীদের গ্রেফতার চাই৷'' এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘নির্যাতনকারী কে? তার ক্ষমতা কত দূর তা জানতে চাই না৷ কোনো সীমাবদ্ধতার কথা শুনতে চাই না৷ যেহেতু আদুরীর নির্যাতনকারীদের পরিচয় পাওয়া গেছে অবিলম্বে অভিযুক্তদের গ্রেফতার চাই৷''
আদুরিকে নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ এর মধ্যেই এক গৃহকর্ত্রীকে আটক করেছে৷ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘রাজধানীর পল্লবী এলাকায় শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে এক নারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ৷ বৃহস্পতিবার দুপুরে তাকে নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷''
গৃহকর্মীকে গ্রেপ্তারের প্রতিক্রিয়ায় ব্লগার আরিফ জেবতিক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘মুমূর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করা নির্মম নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মী আদুরির নির্যাতনকারীকে দ্রুত গ্রেফতার করতে সক্ষম হওয়ায় আইন-শৃংখলা বাহিনীকে অভিনন্দন জানাই৷ আমি আনন্দিত৷''
এদিকে আদুরিকে নির্যাতনকারীর সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করেছেন ব্লগার শাহজাহান আহমেদ৷ নাগরিক ব্লগে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমরা আশা করতে পারি: আদুরীর উপর মধ্যযুগীয় কায়দায় যে বর্বর নির্যাতন হয়েছে তার সর্বোচ্চ বিচার যেন হয়৷ পৃথিবী থেকে দাস প্রথা উঠে গেছে সেই কবে৷ কিন্তু বাংলাদেশে এর ছায়া এখনো আছে৷''