হাতির দাঁত বেচা-কেনার ওপর নিষেধাজ্ঞার ২৫ বছর পরেও আইভরির লোভে চোরাগোপ্তা হাতি শিকার চলেছে, এমনকি সাম্প্রতিককালে চরমে উঠেছে বলা চলে৷ ইউরোপ থেকে হাতির দাঁত বিক্রিও কি তার জন্য দায়ী?
বিজ্ঞাপন
১৯৮৯ সালে যখন বিশ্বব্যাপী হাতির দাঁত নিয়ে ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়, তখন অনেকে ভেবেছিলেন, এবার বোধহয় হাতিরা বিলুপ্ত হওয়ার হাত থেকে বাঁচল৷ তার আগের দশ বছরে হাতিদের সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল৷ এবার তারা কিছুটা রেহাই পাবে৷
কিন্তু তার বছর ২৫ পরেই দেখা যাচ্ছে, হাতির দাঁত নিয়ে রমরমা ব্যবসা চলেছে – এবং তা পুরোপুরি বৈধ৷ মজার কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সেই ব্যবসায় একজন মেজর প্লেয়ার – তারা হাতির দাঁত বেচছে যেখানে বস্তুটির চাহিদা সবচেয়ে বেশি, অর্থাৎ এশিয়ায়৷ সংরক্ষণকারীদের বক্তব্য, এই বৈধ ব্যবসা শুধু নিষেধাজ্ঞাকে এড়িয়ে যাচ্ছে না, হাতির দাঁত নিয়ে অবৈধ ব্যবসাতেও ইন্ধন যোগাচ্ছে৷ যার ফলে আফ্রিকায় প্রতিবছর ৩০ হাজার হাতিকে চোরাশিকারীদের হাতে প্রাণ দিতে হচ্ছে৷
আইনের ফাঁক ও ফাঁকি
নিষেধাজ্ঞায় যে ব্যতিক্রমগুলো রাখা হয়েছে, তা নিয়েই সমস্যা, বলছেন পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণবাদীরা৷ বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি ‘সাইটস' সম্পাদিত হয় ১৯৮৯ সালে৷ সেই চুক্তিতে হাতির দাঁত নিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষিদ্ধ করা হলেও, দেশের অভ্যন্তরে হাতির দাঁত নিয়ে ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়নি৷
এ ধরনের লুপহোল বা আইনের ফাঁক আরও আছে; যেমন এক দেশ থেকে আরেক দেশে বাস তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় একক ব্যক্তিরা তাদের নিজস্ব শিকার করা গজদন্ত সাথে নিয়ে যেতে পারেন৷ এমনকি ‘‘প্রাক-চুক্তি'' হাতির দাঁতও বেচা চলতে পারে, যেমন চলে প্রাগৈতিহাসিক ম্যামথ হাতির দাঁত নিয়ে ব্যবসা৷
ওদিকে ইউরোপে গজদন্ত কিংবা গজদন্তের তৈরি হাতের কাজ কেনার প্রবণতা কমলেও, এশিয়ায় এখনও আইভরিকে ‘হোয়াইট গোল্ড' বা সাদা সোনা বলা হয়, সেখানে তার এমনই কদর ও চাহিদা৷ অপরদিকে বোটসোয়ানা, নামিবিয়া, জিমবাবওয়ে ও দক্ষিণ আফ্রিকা হাতিদের বিপন্ন প্রজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিরুদ্ধে সফল উমেদারি চালিয়ে গেছে, যার ফলে তারা ১৯৯৯ ও ২০০৮ সালে ‘‘একবারের মতো'' তাদের জমানো গজদন্ত বিক্রি করার সুযোগ পেয়েছে৷ এর ফলশ্রুতি: চোরাশিকার বেড়েছে বৈ কমেনি৷
ব্লাড আইভরি
২০০৮ সালে আফ্রিকা থেকে আইভরি বেচা হয় চীনকে; তার পরের কয়েক বছরে প্রতিবছর ৩০ থেকে ৫০ হাজার হাতি মারা হয়েছে বেআইনিভাবে৷ শুধু তানজানিয়াতেই ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে প্রতিবছর এক হাজার করে হাতি চোরাশিকারিদের শিকার হয়েছে৷ কাজেই হাতির দাঁতের বৈধ বেচাকেনার সঙ্গে পোচিং বা চোরাশিকারের সম্পর্কটা স্পষ্ট৷
যেসব তারকা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করেন
বিশ্বব্যাপী প্রাণীদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছু সংগঠন৷ তাদের কার্যক্রমে মানুষকে আকৃষ্ট করতে তারকাদের সহায়তা নেয় এসব সংস্থা৷
ছবি: AP
রায়ান গোসলিং
ক্যানাডীয় অভিনেতা ও সংগীত শিল্পী গোসলিং ২০০৩ সালে কেএফসির কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন৷ মুরগি পালন ও জবাইয়ের ক্ষেত্রে আরেকটু মানবিক হতে কেএফসিকে তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন৷ পরবর্তীতে ম্যাকডোনাল্ডসকেও একইরকম বার্তা পাঠান গোসলিং৷
ছবি: picture-alliance/dpa/G. Horcajuelo
এলেন ডিজেনেরাস
মার্কিন এই কমেডিয়ান টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর জনপ্রিয় শো-তে নিয়মিতভাবে প্রাণী অধিকারের বিষয়টি তুলে আনেন৷ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে তাঁকে ‘ওমেন অফ দ্য ইয়ার’ খেতাব দেয় প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিশ্বের অন্যতম বড় সংগঠন ‘পিপল ফর দ্য এথিক্যাল ট্রিটমেন্ট অফ অ্যানিমেল’ (পেটা)৷
ছবি: Getty Images/K. Winter
ক্রিস্টেন বেল
মার্কিন অভিনেত্রী ও সংগীত শিল্পী বেল ১১ বছর বয়স থেকেই ভেজিটেরিয়ান৷ পেটা ২০০৬ সালে তাঁকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে যৌনআবেদনময়ী ভেজিটেরিয়ান’-এর খেতাব দেয়৷ প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনকে তিনি আর্থিক সহায়তা দিয়ে থাকেন৷ মাঝেমধ্যে তাঁদের কার্যক্রমেও অংশ নেন বেল৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Sanchez-Gonzales
কেশা
২৮ বছর বয়সি মার্কিন এই সংগীত শিল্পী সীল, সিংহ ও হাঙরের মতো প্রাণীর অধিকারের জন্য তাঁর জনপ্রিয়তা কাজে লাগাচ্ছেন৷ কসমেটিকস তৈরিতে বিভিন্ন প্রাণী নিধনের বিরুদ্ধেও তিনি সোচ্চার৷ এ ধরনের কাজের জন্য তিনি স্বীকৃতিও পেয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভিওলা ডেভিস
সার্কাসের হাতিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ করা বাধ্য করে আইন করতে যুক্তরাষ্ট্রের রোড আইল্যান্ড স্টেটের প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন মার্কিন অভিনেত্রী ভিওলা ডেভিস৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ডেমি মুর
সার্কাসের হাতিদের প্রশিক্ষণে অঙ্কুশ ব্যবহারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রাণীদের প্রতি তাঁর অনুভূতির জানান দেন ডেমি মুর৷
ছবি: Getty Images
পল ম্যাকার্টনি
নিজেদের পালিত একটি ভেড়াকে জবাইয়ের পর নিজেদের প্লেটে মাংস হিসাবে রূপান্তরিত হতে দেখে ভেজিটেরিয়ান হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন বিটলসখ্যাত পল ও তাঁর স্ত্রী লিন্ডা ম্যাকার্টনি৷ সেই থেকে এই দম্পতি পেটা সহ অন্য আরেকটি প্রাণী অধিকার বিষয়ক সংগঠনকে সহায়তা করে থাকে৷ তাঁরা বলেন, ‘‘যদি কসাইখানাগুলোর দেয়াল কাচের হতো তাহলে সবাই ভেজিটেরিয়ান হয়ে যেত৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/A. Scheidemann
প্যামেলা অ্যান্ডারসন
বেওয়াচখ্যাত অভিনেত্রী প্যামেলা অ্যান্ডারসন পেটা-র হয়ে অনেকগুলো কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়েছেন৷ যেমন ২০০৩ সালে তিনি পেটা-র ‘পশুর চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরার পরিবর্তে আমি নগ্ন হয়ে থাকব’ কর্মসূচিতে অংশ নেন৷ ২০০১ সালে তিনি কেএফসি-র বিরুদ্ধে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘‘প্রতিবছর কেএফসি সাড়ে সাতশ মিলিয়ন মুরগির সঙ্গে যা করে তা গ্রহণযোগ্য নয়৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
বলিউড তারকারাও সোচ্চার
বেশ কয়েকজন বলিউড তারকাও প্রাণী অধিকারের পক্ষে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের অবস্থান জানিয়েছেন৷ এঁদের মধ্যে আছেন হেমা মালিনি, মাধুরী দীক্ষিত, জন আব্রাহাম, সেলিনা জেটলি, শিল্পা শেঠী, অর্জুন রামপাল ও শাহেদ কাপুর৷
ছবি: UNI
9 ছবি1 | 9
এছাড়া কালো টাকা সাদা করার মতো, বেআইনি আইভরি বৈধ করতেই বা কতক্ষণ, বিশেষ করে যখন আইভরির বয়স বলার কোনো উপায় নেই? প্রাক-চুক্তি আইভরির সঙ্গে সার্টিফিকেট থাকার কথা, কিন্তু তা জাল করাটাই বা এমন কি শক্ত কাজ৷
প্রতিরোধ দানা বাঁধছে
হংকং হলো হাতির দাঁত নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যবসার একটি বড় কেন্দ্র৷ গত জানুয়ারি মাসে হংকং ঘোষণা করে যে, আইভরির আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হবে; এছাড়া হংকং-এর অভ্যন্তরেও ধাপে ধাপে আইভরি বেচাকেনা বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ গতবছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একটি যৌথ চুক্তিতে অনুরূপ প্রতিশ্রুতি দেয়৷ বিশ্বে হাতির দাঁতের চাহিদা চীনেই সবচেয়ে বেশি; তার পরেই নাকি আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ অথচ বিশ্বে ‘‘প্রাক-চুক্তি'' আইভরির সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক হল ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ কাজেই এখন দাবি উঠেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও কোনো একটা নিদর্শন রাখতে হবে৷
ফ্রান্স, জার্মিন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রিয়া, সুইডেন ও নেদারল্যান্ডস ইতিমধ্যেই প্রাক-চুক্তি গজদন্ত রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে - এবং অন্যান্য ইইউ-দেশের প্রতি সেই পন্থা অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছে৷ ওদিকে ইইউ-এর অভ্যন্তরে আইভরি পাচারের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায়, নিষেধাজ্ঞা-যুক্ত দেশগুলি থেকে আইভরি সহজেই নিষেধাজ্ঞা-মুক্ত দেশগুলিতে গিয়ে পড়ছে৷ ইউরোপীয় কমিশন বলছে, সমস্যাটি নিয়ে নাকি আগামী মার্চ মাসে ‘‘চিন্তা-ভাবনা'' করা হবে৷
ডাইনোসর বিলুপ্ত, এবার হাতিও কি ধীরে ধীরে যাবে?
অতিকায় ডাইনোসর আর নেই৷ এখনো টিকে থাকা স্থলচরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতিও কি এবার বিলুপ্ত হয়ে যাবে? আন্তর্জাতিক হাতি দিবসে প্রশ্নটা খুব বড় হয়ে উঠেছে৷ ছবিঘরে দেখুন কেন এবং কীভাবে খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে হাতি৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/M. Hicken
আর মাত্র ১০ বছর?
হাতি যে হারে কমছে, তাতে ১০ বছর পর চিড়িয়াখানা ছাড়া আর সব জায়গা থেকে এই প্রাণীটির চিহ্ন মুছে গেলে নাকি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না৷ আশঙ্কাটা যে মোটেই বাড়াবাড়ি নয়, তা দুটো তথ্য দিলেই বুঝতে পারবেন৷ একশ’ বছর আগে আফ্রিকায় মোট এক কোটি হাতি ছিল৷ এখন সেখানে মাত্র সাড়ে চার থেকে সাত লাখের মতো হাতি টিকে আছে৷ এশিয়ায় আছে মাত্র ৩৫ থেকে ৪০ হাজার হাতি৷ গত দশ বছরে নাকি সারা বিশ্ব থেকে ৬২ ভাগ হাতি কমেছে!
ছবি: picture-alliance/R. Harding
দাঁতের জন্য মরছে হাতি
কথায় আছে, মরা হাতির দাম লাখ টাকা৷ সত্যিই তাই৷ বিশেষ করে হাতির দাঁত তো হীরা-মুক্তা-জহরতের মতোই মূল্যবান৷ সেই দাঁতের লোভে আফ্রিকার জঙ্গল থেকে প্রতিদিন কমপক্ষে একশ’টি হাতি মারা হয়৷ হাতির দাঁত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় চীনে৷ গত জুলাই মাসে জুরিখ বিমানবন্দরে ২৬২ কিলোগ্রাম ওজনের হাতির দাঁতসহ ধরা পড়ে এক চীনা নাগরিক৷
ছবি: Reuters/R. Sprich
জঙ্গিদের টাকার উৎসও হাতি!
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অবৈধ ব্যবসা এই হাতির দাঁতের কেনাবেচা৷ মাদক এবং মানবপাচারের পরই এর স্থান৷ অনেক যু্দ্ধ-দাঙ্গা-হাঙ্গামার পেছনেও ভূমিকার রাখে হাতির দাঁত৷ আফ্রিকা অঞ্চলের দুই ইসলামি জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম এবং আল-শাবাব বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্র কেনে হাতির দাঁতের বিনিময়ে!
ছবি: picture-alliance/AP Photo/African Parks
জঙ্গল কমছে, কমছে হাতি
জনসংখ্যা বাড়ছে৷ আর জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ পড়ছে জঙ্গলের ওপর৷ মানুষ জঙ্গল কেটে সেখানে গড়ছে বাসস্থান, কলকারখানা৷ ফলে জঙ্গলের প্রাণীরা পড়ছে বিপদে৷ হাতির জন্যও জঙ্গল ক্রমশই কমছে, বাড়ছে বিপদ৷ গত এক শতকে আফ্রিকার জনসংখ্যা চারগুণ বেড়েছে৷ হাতির সংখ্যা সেখানে এক কোটি থেকে কমে সাত লাখ বা তারও কম হওয়াই তো স্বাভাবিক, তাই না?
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Gambarini
হাতিরক্ষায় তৎপর ওবামা
চীনের পর হাতির দাঁত সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় যুক্তরাষ্ট্রে৷ তবে ধীরে ধীরে হয়ত সেখানে অবৈধ এ ব্যবসাটা কমবে৷ গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এই ব্যবসা একেবারে বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা৷