বেতন-বোনাস নিয়ে পোশাক কারখানায় অস্থিরতার শঙ্কা
২৬ মার্চ ২০২৪গার্মেন্ট মালিকেরা বলছেন, সরকারের প্রণোদনার টাকা না পেলে এই সংখ্যা আরও বেড়ে যেতে পারে৷
মালিকেরা বলছেন, এবার তিনটি কারণে সংকট হতে পারে৷ এর মধ্যে আছে, প্রথমত, গত দেড় বছরে অর্ডার অনেক কমে গেছে৷ এখন কারখানাগুলো সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ ভাগ উৎপাদনে রয়েছে৷ ফলে মালিকদের ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালাতে হচ্ছে৷ দ্বিতীয়, ব্যাংকগুলো গার্মেন্ট মালিকদের সহযোগিতা করছে না৷ আর তৃতীয়ত, কাস্টমসের অহেতুক ঝামেলার কারণে শিপমেন্টের সময় ফেল করছেন তারা৷ ৭ থেকে ১০ দিন মাল ফেলে রাখছে৷ এর ফলে ঠিকমতো টাকাও আসছে না৷
তৈরি পোশাক শিল্পে বিজিএমইএর কারখানা রয়েছে ১ হাজার ৫৮৯টি, বিকেএমইএর ৬২৮টি, বিটিএমএর ৩৫৬টি, বেপজার ৩৮৩টি ও অন্যান্য কারখানা রয়েছে ৬৫১টি৷ এসব কারখানা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে শিল্প পুলিশ৷ তাদের তথ্যানুযায়ী, ঈদের আগে বেতন না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১৩১টি কারখানায়৷ বোনাস না হতে পারে ১০৮টি, বেতন-বোনাস দুটিই না হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ১৭৭টিতে৷ সব মিলিয়ে সংকট হতে পারে এমন কারখার সংখ্যা ৪১৬টি৷ উদ্বুত পরিস্থিতিতে সোমবার বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএর নেতৃবৃন্দ এবং বেপজা, কলকারখানা অধিদপ্তর, শ্রম অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিল শিল্প পুলিশ৷ সেখানেও আলোচনায় এই সংকটগুলো উঠে এসেছে৷
জানতে চাইলে শিল্প পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাহাবুবুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা তো মালিকদের নির্দেশনা দিতে পারি না, অনুরোধ করেছি৷ আমরা একটি তালিকা করেছি, সেখানে যেসব ফ্যাক্টরিতে সংকট হতে পারে সেগুলো তাদের জানিয়েছি৷ মালিকেরা বলেছেন, শ্রমিকদের বেতন এবং ভাতা ঈদের আগে তারা পরিশোধ করবেন৷ অধিকাংশ কারখানাই যথাসময়ে পরিশোধ করতে সক্ষম হবে৷ তবে কেউ কেউ ব্যর্থ হতে পারেন৷ নানা সংকটের কারণে অতীতে যারা কখনো ব্যর্থ হয়নি তারাও এবার তাদের সংকট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ আমরা তাদের বিকল্প উপায়ে বেতন-বোনাস পরিশোধের জন্য বলেছি৷”
পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, "আমরা যে তালিকাটি করেছি, সেখানে কিছু প্রতিষ্ঠান শ্রমিকদের বেতন ভাতা না দিয়েই বন্ধ করে দিয়েছে৷ আবার ফেব্রুয়ারির বেতন মার্চে হওয়া কথা৷ এখনো কিছু কারখানায় শ্রমিকেরা ফেব্রুয়ারির বেতন পাননি৷ মার্চের বেতন এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে হওয়ার কথা৷ এবার যেহেতু ঈদ হচ্ছে তাই আমরা বলেছি, বোনাস যেন এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে দিয়ে দেওয়া হয় এবং মার্চ মাসের বেতন যেন ঈদের ছুটির আগেই পরিশোধ করা হয়৷ মালিক ও শ্রমিকদের বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ঈদের ছুটি নির্ধারণ করা হবে৷ ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতাকে কেন্দ্র করে কোনো অপশক্তি যেন আইনশৃঙ্খলা অবনতি ঘটাতে না পারে, সে বিষয়েও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি করা হয়েছে৷”
শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর উপকণ্ঠে তিন পাশে শিল্পাঞ্চল রয়েছে৷ এই পথ ধরেই ঈদে ঘরমুখী মানুষ গ্রামে যাবেন৷ ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধ না করলে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হবে৷ এতে করে সড়ক অবরোধসহ সহিংসতা হতে পারে৷ শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিলে দুর্ভোগে পড়তে হবে ঘরমুখো মানুষকে৷
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শিল্প পুলিশ যে তালিকা দিয়েছে, আমার ধারণা সংকটের আশঙ্কা আছে আরও বেশি কারখানায়৷ এখন পর্যন্ত যে আমরা এই সেক্টর টিকিয়ে রেখেছি, সেটাই বড় ব্যাপার৷ প্রথমত, ১২ টাকার গ্যাসের দাম হয়েছে ৩০ টাকা৷ বিদ্যুতের দামও বেড়েছে৷ ৫৬ শতাংশ বেড়েছে শ্রমিকদের বেতনও৷ এর মধ্যে গত দেড় বছরে রপ্তানি আদেশ কম এসেছে৷ যাও এসেছে সেগুলো সময়মতো ডেলিভারি করা যাচ্ছে না৷ কারণ বেশি দাম দিয়েও গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে না৷ এখন প্রতিটি কারখানা সক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদনে আছে৷ কোনো কারখানা যদি সক্ষমতার ৮০ শতাংশের বেশি উৎপাদনে না থাকে তাহলে কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠান লাভজনক হবে না৷”
আর কী ধরনের সংকট আছে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, "ব্যাংকগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে না৷ আমাদের নগদ প্রণোদনা বাবদ সরকার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাওনা রয়েছে৷ ঈদের আগে এই টাকা পাব কিনা জানি না৷ এটা না পেলে বহু কারখানা বিপদে পড়বে৷ আমি নিজে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি৷ কাস্টমসের হয়রানি তো আছেই৷ বিনা কারণে তারা শিপমেন্ট পিছিয়ে দিচ্ছে৷ আবার বায়ররাও অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছে৷ পণ্য সেখানে পৌঁছানোর পর তারা খালাস করছে না৷ দাবি করছে, দুই মাস পর টাকা দেবে, এই শর্তে তারা পণ্য খালাস করবে৷ বাধ্য হয়ে আমাদের তাদের সেসব শর্ত মেনে নিতে হচ্ছে৷”
শিল্প পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় চার হাজারের মতো গার্মেন্ট কারখানা রয়েছে৷ এতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন৷ এই খাতে উৎপাদিত পোশাক বিশ্বের প্রায় ১৬৭টি দেশে রফতানি হয়৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৫৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে৷ এর মধ্যে পোশাক রফতানি হয়েছে প্রায় ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলার মূল্যমানের, যা রফতানি আয়ের শতকরা ৮৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ৷ ফলে এ খাতে বিশৃঙ্খলা-সৃষ্টি করে বিধি নিষেধ আরোপ করানো গেলে সরকার অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে৷ দেশ বিরোধী একটি শক্তি দেশকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে৷”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মো. মাহাবুবর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা সতর্ক অবস্থায় আছি৷ সমাধানের চেষ্টা করছি৷ কেউ অযাচিত হস্তক্ষেপ করে ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারবে না৷” বিজিএমইএ'র নবনির্বাচিত কমিটির পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "শিল্প পুলিশের প্রতিবেদনটি আমরা দেখেছি৷ এর মধ্যে বিজিএমইএ'র সদস্য আছে ১৩১টি কারখানা৷ আমরা এর আগেও এসব সমস্যার সামাধান করেছি৷ এবারও হয়ে যাবে৷ আমরা বিজিএমইএ থেকে একটি মনিটরিং কমিটি করেছি, তারাও প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করবেন৷ শেষ মুহূর্তে যে কারখানাগুলো সমস্যা থাকবে, আমরা সেগুলো সমাধান করে ফেলব৷”
বিএমএমইএ'র সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন যে সংকটগুলো দেখা যাচ্ছে, এগুলো আসলে হতো না যদি আমরা সাংগঠনিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারতাম৷ একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, আগের এলসির টাকা না আসা পর্যন্ত ব্যাংকগুলো নতুন এলসি খুলতে দিচ্ছে না৷ ওই টাকা হয়ত পাইপলাইনে আছে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই চলে আসবে৷ এখানে সংগঠন থেকে যদি দায়িত্ব নিয়ে ব্যাংকের সঙ্গে কথা বলে তাহলে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়৷ আবার ছোট ছোট ফ্যাক্টরিগুলোর সমস্যা ট্রেডবডির নেতারা গুরুত্বের সঙ্গে নেন না৷ কারণ তাদের ফ্যাক্টরিগুলো বড়৷ সরকারের উচ্চ মহলে তাদের যোগাযোগ আছে৷ আবার সরকার আমাদের যে সুবিধা দিয়ে চায়, সেটাও আমরা নিতে পারছি না, নেতৃত্বে দুর্বলতার কারণে৷ এগুলো যদি কাটিয়ে উঠা যায় তাহলে এসব সংকটের কিছুই আর থাকবে না৷”