বাংলাদেশে ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধে' মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন করেছে ব়্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (ব়্যাব)৷ এমন অভিযোগে শুক্রবার সংস্থাটিসহ এর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিজ্ঞাপন
মার্কিন রাজস্ব ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শুক্রবার পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে৷
রাজস্ব মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকবিরোধী যুদ্ধের অংশ হিসাবে ব়্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে৷ এর ফলে আইনের শাসন, মানবাধিকার, বিভিন্ন মৌলিক স্বাধীনতা এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ক্ষুণ্ণ করার মাধ্যমে মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থ হুমকিতে পড়েছে৷
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে ছয় শতাধিক গুম, ২০১৮ সাল থেকে প্রায় ৬০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং নির্যাতনে ব়্যাব ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায় রয়েছে৷ বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার কর্মীদের এইসব ঘটনায় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়েছে বলেও কিছু প্রতিবেদনে উঠে এসেছে৷
মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকারের যত অভিযান
মাদক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে৷ সেই সাথে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জব্দ হওয়া মাদকের পরিমাণও বাড়ছে৷ পাশাপাশি মাদকবিরোধী অভিযানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগও তুলছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো৷ ছবিঘরে বিস্তারিত..
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
মাদক চোরাচালান
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, দেশে বিভিন্ন ধরনের মাদক চোরাচালানের পরিমাণ বাড়ছে৷ সরকারের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, আটককৃত মাদকের পরিমাণ ও এর সাথে জড়িতদের সংখ্যা তার আগের বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে৷
ছবি: AFP
বেড়েছে ইয়াবা
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে তিন কোটি ৬৮ লাখ ৮১ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে। ২০১৯ সালে এর পরিমান ছিল তিন কোটি চার লাখ ৪৬ হাজার পিস। ২০১৯ সালের চেয়ে ২০২০ সালে করোনার বছরে বেশি ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে।
ছবি: Getty Images/Afp/Y. A. Thu
গাঁজা আটকও বাড়ছে
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, ২০১৫ সালেদেশের বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা ৩৯ হাজার নয়শ ৬৮ কেজি গাঁজা আটক করে৷ ২০২০ সালে আটকের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ হাজার দুইশ ৭৯ কেজি৷
ছবি: Fadel Senna/AFP/Getty Images
হেরোইন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২০১৫ সালে একশ সাত দশমিক ৫৪ কেজি হেরোইন উদ্ধার করে৷ ২০২০ সালে উদ্ধারের পরিমাণ ছিল দুইশ ১০ দশমিক ৪৪ কেজি৷
ছবি: Bulgarian Prosecutor's Office/picture-alliance/AP
সরকারের বিশেষ অভিযান
মাদক নিয়ন্ত্রণে সরকার ২০১৮ সালের মে মাসে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে৷ বিশেষ করে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ‘সাড়াশি অভিযান’ চালায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
হাজার হাজার আটক
মাদকবিরোধী এ অভিযান শুরুর প্রথম দুই মাসের মাথায় প্রায় ২৫ হাজার মামলা দায়ের হয়৷ এসব মামলায় ৩৫ হাজারেরও বেশি লোককে আটক করা হয় বলে জানিয়েছে সংবাদমাধ্যমগুলো৷
ছবি: bdnews24.com/A. Al Momin
শতাধিক আত্মসমর্পন
অভিযান চলার সময় মাদকব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পনের সুযোগ দেওয়া হয়৷ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কক্সবাজারের টেকনাফে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ১০২জন মাদক ব্যবসায়ী আত্মসমর্পন করেন৷
ছবি: Getty Images/Afp
সমালোচনায় মাদকবিরোধী অভিযান
এদিকে অভিযানের প্রায় পুরোসময় জুড়েই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহতের খবর পাওয়া যায়৷ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য মতে, এ সময় ‘৪৬৬ জন বিচারবহির্ভূত’ হত্যার শিকার হয়৷ বিষয়টি নিয়ে দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার৷
ছবি: bdnews24.com
কতটা সফল মাদকবিরোধী অভিযান?
কক্সবাজারে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকার পরও তাদের বিচারের আওতায় না আনার অভিযোগ ও কথিত বন্দুকযুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলেরই এক কাউন্সিলরের মৃত্যুর পর প্রশ্নের মুখে পড়ে অভিযান৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ধরনের অভিযানে সময়িকভাবে ঠেকানো গেলেও মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A.M. Ahad
বাড়ছে মাদকাসক্ত রোগীর সংখ্যা
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমগুলো জানায়, ২০১৯ সালে ১১৪জন রোগী সরকারি-বেসরকারি পুনর্বাসন কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়েছেন৷ ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০৪ জন আর ২০১৭ সালে ৬৯জন৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Buchanan
নতুন মাদকের আবির্ভাব
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হওয়া মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ও ফেনসিডিল৷ সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে এলএসডি নামের এক মাদকের সন্ধানও পায় গোয়েন্দা বিভাগ৷ পুলিশের দাবি, রাজধানীতে ১৫টি গ্রুপ রয়েছে, যারা এক বছর ধরে এলএসডি বিক্রি ও সেবনের সঙ্গে জড়িত৷
ছবি: Picture-Alliance/AP Photo
11 ছবি1 | 11
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন নির্বাহী আদেশ ১৩৮১৮ এর অধীনে বিদেশি সংস্থা হিসাবে ব়্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন রাজস্ব মন্ত্রণালয়৷ এছাড়াও একই নির্বাহী আদেশের অধীনে নিষেধাজ্ঞায় বাহিনীটির সাবেক ও বর্তমান ছয় জন শীর্ষ কর্মকর্তার নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷
এই ছয় কর্মকর্তা হলেন ব়্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদ, বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) খান মোহাম্মদ আজাদ, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) তোফায়েল মোস্তফা সরওয়ার, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এবং অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান৷
২০১৭ সালে মার্কিন নির্বাহী আদেশ ১৩৮১৮ জারি করেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প৷ এই আদেশের অধীনে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা, পররাষ্ট্রনীতি এবং অর্থনীতি হুমকিতে পড়লে বিদেশি সংস্থা বা ব্যক্তির সম্পদ, সম্পত্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ তৈরি হয়৷
একই সঙ্গে ব়্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকাকালে দেশটিতে প্রবেশ করতে পারবেন না তিনি৷
দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, বেনজীরের সাথে একই নিষেধাজ্ঞায় পড়েছেন ব়্যাব ৭ ইউনিটের সাবেক কমান্ডিং অফিসার মিফতাহ উদ্দিন আহমেদও৷ কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই দুইজন ২০১৮ সালের মে মাসে টেকনাফে কাউন্সিলর একরামুল হককে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যাসহ বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ উগান্ডা, চীন, বেলারুশ, শ্রীলঙ্কা ও মেক্সিকোর ১০ জন বর্তমান ও সাবেক সরকারি কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও একই ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷