পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনি সাফল্যের পরই বিজেপিতে যোগদানের ধুম লেগে গিয়েছে৷ এর ফলে দলে বেনোজল ঢুকে পড়ছে বলে আশঙ্কায় বিজেপি নেতৃত্ব৷ যোগদানে ইচ্ছুক নেতাদের বাছাই করার জন্য কমিটি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর দল৷
বিজ্ঞাপন
গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তাক লাগানো সাফল্য পেয়েছে বিজেপি৷ ১৮টি আসনে জয় পেয়ে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে তারা৷ এরপর থেকেই বিজেপিতে যোগদানের হিড়িক পড়ে গিয়েছে৷ পঞ্চায়েত সদস্য থেকে সাংসদ, বিভিন্ন স্তরের নেতারা মোদীবাহিনীতে নাম লেখাচ্ছেন ও লেখাতে চাইছেন৷ এর সঙ্গে সাধারণ কর্মীরা বিপুল সংখ্যায় দলবদল করছেন৷ এই গণহারে যোগদানের ফলে নিশ্চিত ভাবে বাছাইয়ের অবকাশ থাকছে না৷ এতে দলের আকার বড় হচ্ছে, কিন্তু অন্য রাজনৈতিক দলের বেনোজল বা অপশক্তি বিজেপিতে ঢুকে পড়ছে কি, এ নিয়ে ধন্দ তৈরি হয়েছে৷
এই বিতর্ক সবচেয়ে তীব্র আকার নেয় বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক মনিরুল ইসলাম বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর৷ সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মস্থান লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল তাঁর বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য কুখ্যাত৷ তিনি যোগ দেওয়ার পর জেলা বিজেপিতে বিদ্রোহ হয়৷ বীরভূমের বিজেপি নেতারা বলেন, মনিরুলদের বিরুদ্ধে মানুষ ভোট দিয়েছে৷ এই তৃণমূল নেতাদের হাতে বিজেপি সংগঠকরা আক্রান্ত হয়েছেন৷ তাহলে সেই নেতাকে দলে নেওয়া হল কেন? দলবদলের চাবিকাঠি যাঁর হাতে, সেই মুকুল রায় বলতে বাধ্য হন, মনিরুলকে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে৷ তিনি বিজেপি ছাড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন৷
মনিরুল-পর্বেই টনক নড়ে বিজেপি নেতৃত্বের৷ একইসঙ্গে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের তাত্ত্বিক সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস৷ সংগঠনের মুখপত্রে আরএসএস লেখে, বিজেপিতে প্রচুর বেনোজল ঢুকে পড়ছে৷ এটা দলের জন্য বিপদ ডেকে আনবে৷ এ বিষয়ে বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘পচা জিনিসের কোনো জায়গা নেই আমাদের দলে৷ এখন দল বড় হচ্ছে৷ এটা পার্ট অফ গেম৷ যদি বেনোজল ঢুকে পড়ে, তাহলে তাদের বার করে দেওয়া হবে৷ বিজেপিতে সেই ব্যবস্থা আছে৷'‘
শিবাজীপ্রতিম বসু
জেলায় জেলায় বিজেপিতে যোগদানের জন্য অনুরোধ পাচ্ছেন নেতারা৷ বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরও তার ব্যতিক্রম নয়৷ বাঁকুড়ার লোকসভা কেন্দ্রের সদ্য নির্বাচিত সাংসদ, চিকিৎসক সুভাষ সরকার বেনোজল নিয়ে চিন্তিত নন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সাফল্যের পর যোগদানের আগ্রহ স্বাভাবিক৷ অনেকেই এই সময় দলে যোগ দেবেন৷ যারা আসবে, তাদের পরিশোধিত হতে হবে৷ আমাদের নীতি-আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে৷ তবেই তারা দলে থাকতে পারবে, নইলে পারবে না৷ আরএসএস-এর দীর্ঘদিনের সংগঠক এই সাংসদ জানান, এ জন্য বিজেপিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে৷ বছরে চারবার এই প্রশিক্ষণ হয়৷ সেখানে শিখিয়ে-পড়িয়ে নেওয়া হবে নবাগত নেতা-কর্মীদের৷'‘
তবু মনিরুলের ঘটনার পর বিজেপি নেতৃত্ব একটু সাবধানে পা ফেলছেন৷ আরএসএসের দেখানো পথে ছাঁকনি পদ্ধতির সাহায্যে বেনোজল রোখার চেষ্টা হবে বলে বিজেপি সূত্রের খবর৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, দলের সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ পশ্চিমবঙ্গে একটি বাছাই কমিটি গড়ার নির্দেশ দিয়েছেন৷ এই কমিটি যোগদানে ইচ্ছুক নেতাদের আবেদন খতিয়ে দেখে ছাড়পত্র দেবে৷ একইসঙ্গে বিজেপিতে আদি ও নব্য নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ এই কমিটি নবাগতদের উপর নজরদারি রাখবে, যাতে কোনো বিরোধ সৃষ্টি না হয়৷
বিজেপির ছাঁকনি তত্ত্বকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ৷ অধ্যাপক শিবাজীপ্রতিম বসু বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের ৪০ জন বিধায়ক যোগাযোগ রেখেছেন৷ অমিত শাহ সমাবেশ থেকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মমতাকে, যদি সম্ভব হয়, দল অটুট রাখুন৷ তৃণমূলের যে নেতাদের দলে নেওয়ার কথা বিজেপির শীর্ষ দুই নেতা বলেছেন, তাঁদের জন্য কি ছাঁকনির ব্যবস্থা ছিল? তাই বেনোজল নিয়ে হইচই স্রেফ কথার কথা৷' অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘ক্ষমতায় পালাবদলের পর বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসেও অন্য দল থেকে নেতা-কর্মীরা ঢুকে পড়েছিলেন৷ পশ্চিমবঙ্গে এটা নতুন কিছু নয়৷ বিজেপির ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে এবং হবে৷ ছাঁকনি কাজে আসবে না৷''
কেন ঘরবাড়ি ছাড়ছে উত্তর প্রদেশের মুসলমানরা?
কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ- এমতাবস্থায় ভারতের উত্তরপ্রদেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্য চরমে৷ তাদের নানাবিধ প্রভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাড়িছাড়ার হিড়িক
ভারতের উত্তর প্রদেশের নয়াবান গ্রামে মোট ৪ হাজার মানুষের মধ্যে ৪০০ জন মুসলিম৷ গত দুই বছরে তাঁদের মধ্যে প্রায় এক ডজন ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র৷ আরো অনেকে গ্রাম ছাড়ার পরিকল্পনা করলেও সামর্থের অভাবে পারছেন না বলে তাঁরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন৷ এর মধ্যে গত বছরের শেষে গরু নিয়ে সহিংসতার ক্ষত এখনো তাদের মধ্যে গদগদে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
গরু নিয়ে সহিংসতার জের
গত নভেম্বরে নয়াবানে গরু জবাইয়ের অভিযোগে সহিংসতা জড়ায় হিন্দুরা৷ পুলিশ গরু জবাই বন্ধ করতে পারেনি, এমন অভিযোগে মহাসড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখায় তারা৷ সে সময় সংঘর্ষে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুইজন নিহত হয়েছিলেন৷ এরপর ওই ঘটনায় মামলা হয়, বিনা অপরাধে জেল খেটেছেন অনেক মুসলিম৷ ওই সংঘর্ষের জের এখনো রয়েছে বলে মনে করছেন মুসলিমরা৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
মাইকে আজান দেয়া নিষেধ
২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে৷ পরের রমজানে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একটি মসজিদে আজান দেওয়া বন্ধ করে দেয় কট্টরপন্থি হিন্দুরা৷ দীর্ঘ সময় ধরে চললেও আজান দেওয়া বন্ধ করে দিতে হয় মুসলিমদের৷ মুসলিম বাসিন্দা আয়েশা বলেন, ‘‘এখন এখানে আমরা ধর্মীয় বিষয় প্রকাশ করতে পারি না৷ তাঁরা (হিন্দুরা) যা ইচ্ছা তা করতে পারে৷’’
ছবি: Reuters/A. Abidi
হিন্দুরা যান না মুসলিম দোকানে
গরু জবাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৬ দিন জেল খেটেছেন ৩৮ বছর বয়সি শরফুদ্দিন সাইফি৷ যদিও পরে এর কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ৷ এখন হিন্দুরা তাঁর কাপড়ের দোকান এড়িয়ে চলেন৷ বিক্রি কমা আর মামলার পেছনে টাকা খরচ হওয়ায় দোকানে মালামাল তুলতে পারছেন না সাইফি৷ ছেলেকে ভালো স্কুল থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে তাঁকে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘ওরা পুলিশ মারে, আমরা কোন ছাড়’
উত্তর প্রদেশের নয়াবান ছেড়ে দিল্লির নিকটবর্তী মাসুরিতে চলে গেছেন কাঠমিস্ত্রী জব্বার আলী৷ এক সময়ের এই সৌদি প্রবাসী সেখানে একটি বাড়ি কিনেছেন৷ তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘যদি হিন্দুরা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশকে হত্যা করতে পারে, তাহলে আমরা মুসলিমরা কোন ছাড়?’’
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘এখন হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে খেলে না’
রাজধানী নতুন দিল্লিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চলেছেন ওই গ্রামের বাসিন্দা, ২২ বছর বয়সি জুনাইদ৷ আগে হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কথা এখনো মনে পড়ে তাঁর৷ ‘‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে খেলতাম- বিশেষ করে ক্রিকেট৷ আমি অনেক খেলেছি৷ কিন্তু গত একবছরে আমরা একসঙ্গে খেলিনি,’’ রয়টার্সকে বলেন জুনাইদ৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘সব শেষ করেছেন মোদী-যোগী’
হিন্দুত্ববাদের স্লোগান উচ্চকিত করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদী৷ এরপর ২০১৭ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন হিন্দু পুরোহিত যোগী আদিত্যনাথ৷ আগে সম্প্রীতি থাকলেও এখন তাঁদের প্রভাবে এলাকার সম্প্রীতি একেবারেই নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন নয়াবানের মুসলিমরা৷ ‘‘মোদী আর যোগী সব শেষ করে দিয়েছে৷ তাঁদের প্রধান এজেন্ডাই হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি,’’ রয়টার্সকে বলেছেন নয়াবানের বাসিন্দা গুলফাম আলী৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
মোদীকে ভয়
লোকসভা নির্বাচনে এক্জিট পোলে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘এগিয়ে’ নরেন্দ্র মোদী৷ বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি আরো বাজে হতে পারে বলে শঙ্কায় নয়াবানের মুসলিমরা৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
অস্বীকার করছে বিজেপি
ঘরবাড়ি ছাড়ার অভিযোগ মুসলিমরা করলেও কোনো ধরনের আধিপত্যের কথা অস্বীকার করেছে বিজেপি৷ দলের মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেন, ‘‘বিজেপির সময়ে কোনো দাঙ্গা হয়নি৷ অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের বিষয় মেলানোটা ভুল হবে৷’’ বিরোধী দলগুলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘যা-ই হোক, চলে যাব না’
অনেকের মনে এলাকা ছাড়ার প্রবণতা থাকলেও কোনো কোনো মুসলিম বলছেন লড়াই চালানোর কথা৷ তাঁদের মতো একজন ৪২ বছর বয়সি আয়াস মোহাম্মদ৷ নিকটবর্তী শহরে এই টাইলসের দোকানি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমি লড়াই চালিয়ে যাব৷ আমি ভীত নই৷ তবে, মোদী আবার ক্ষমতায় আসলে অনেকের জন্য এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাবে৷’’