বেসরকারি চিকিৎসাতেই ভরসা কেন
১১ ডিসেম্বর ২০২০নেহাত সঙ্গতিহীন না হলে অসুস্থ মানুষ যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান না, সেটা জানা কথা৷ বেসরকারি চিকিৎসা ব্যয়বহুল হলেও লোকে ধারদেনা করেও যে তারই দ্বারস্থ হন, সেটাও সবার জানা৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অসুস্থ হয়ে কলকাতার এক নামজাদা বেসরকারি হাসপাতালে সম্প্রতি ভর্তি হওয়ার পর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কি সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থায় সরকারি কর্তাব্যক্তিরাই আস্থাহীন?সোশাল মিডিয়ায় এমন প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন যে, এই রাজ্যে টানা ৩৪ বছর বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকার পর সরকারি ব্যবস্থার এমন দুরবস্থা কেন? অথবা পালাবদলের পরের দশ বছরেও কেন বেহাল সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার কোনো উন্নতি হলো না?
কলকাতার সবথেকে বড় বেসরকারি হাসপাতালটির সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা.সৌম্য ভট্টাচার্য৷ তিনি দীর্ঘদিন ব্রিটেনে ডাক্তারি করেছেন৷ যুক্ত ছিলেন সেখানকার ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের সঙ্গে৷ তিনি বললেন, ‘‘বিদেশে যখন কেউ অসুস্থ হন, ইংল্যান্ডে, ফ্রান্সে, বা জার্মানিতে, কোনো রাজনৈতিক নেতা অসুস্থ হলে, তিনি সরকারি হাসপাতালেরই আতিথ্য গ্রহণ করেন৷ এবং সেখানে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত৷ বেসরকারি হাসপাতালের থেকেও উন্নত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে৷ সুতরাং তাদের যে চিকিৎসা, সেটা সরকারি ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই নেওয়া সম্ভব৷ এটার বিশেষ গুরুত্ব এই জন্য যে, যারা সরকারের নেতা, মন্ত্রী, বা আমলা আছেন, তারাই তো এই সরকারি ব্যবস্থাগুলো চালাচ্ছেন৷ তাঁরা যদি নিজেদের চালানো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে ভয় পান, তাহলে সাধারণ মানুষের কাছে কী বার্তা পৌঁছায়?যে এই হাসপাতালগুলো ভালো নয়, এখানে সুচিকিৎসা পাওয়া যায় না৷ সুতরাং নেতাদেরই উদাহরণ তৈরি করতে হবে৷’’
নেতাদের আরো একটা দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন ডা. ভট্টাচার্য যে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশে বাৎসরিক বাজেটের অন্তত ছয় থেকে আট শতাংশ স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে খরচ হয়৷ তবেই ওরা সুচিকিৎসা দিতে পারে৷ আমাদের দেশে যারা নীতি নির্ধারন করেন, সরকারি খরচের বাজেট বানান, তাঁদের সেটা মাথায় রাখতে হবে৷ প্রসঙ্গত ডা.ভট্টাচার্য বললেন, কোভিড মোকাবিলার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি হাসপাতালগুলো কিন্তু ভালো কাজ করেছে৷ কাজেই উদ্যোগী হলে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থাও পরিষেবা দিতে পারে, দিচ্ছেও৷
কলকাতার এক নামী বেসরকারি হাসপাতালের কর্ণধার ডা.পূর্ণেন্দু রায় সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার আরো একটি দুর্বলতার দিকে নজর ফেরালেন৷ তাঁর বক্তব্য, দিল্লিতে কিন্তু নেতা, মন্ত্রীরা সবাই সরকারি ব্যবস্থাতেই চিকিৎসা করান৷ তবে সেটা অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্স, বা এইমস–এর মতো প্রতিষ্ঠান, যেগুলোকে চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্স’ ধরা হয়৷ এইমস, বা পিজিআই, কিংবা জিপমার–এর মতো নামী প্রতিষ্ঠান, যেখানে উন্নত, আধুনিকতম চিকিৎসা ব্যবস্থার সঙ্গে দেশের মেডিকেল কলেজগুলির সেরা মেধাবী এবং দক্ষ ছাত্র–ছাত্রীরা কাজ করেন৷ নিজে জিপমার পন্ডিচেরির কৃতি ছাত্র হিসেবে ডা.রায় মনে করেন, কোনো ভালো ডাক্তার আসলে এইটুকুই চান৷ ভালো কাজের পরিবেশ, আর্থিক নিশ্চয়তা এবং সেই সঙ্গে নিজের জ্ঞান এবং অধিগত দক্ষতা ভবিষ্যতের চিকিৎসকদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ৷ সেই নিরিখে যদি একাধিক মেডিকেল কলেজ খোলার বদলে অন্তত একটা ‘সেন্টার ফর এক্সেলেন্স’ খোলা হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গেও সরকারি ব্যবস্থায় সুচিকিৎসা সম্ভব৷ ডা.রায় জানালেন, ‘‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করে বলেছিলাম, যারা মেডিকেল কলেজে আছেন, আপনি তাদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস অ্যালাও করেছেন৷ তাহলে আমরা যারা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে আছি, কেন মেডিকেল কলেজে গিয়ে মাঝে মধ্যে চিকিৎসা করতে পারবো না?কিন্তু সেটা অ্যালাওড হয় না৷ আমরা অনেকেই ছিলাম, যারা বলেছিলাম, যে পোস্ট, প্রোমোশান, স্যালারি, কোনো কিছুই চাই না, স্টুডেন্টদের মাঝেমধ্যে পড়াতে চাই৷ কিন্তু সেটা হয় না৷’’
এবং ডা.পূর্ণেন্দু রায় চিকিৎসকদের হয়ে একটা জোরালো প্রশ্ন তুলে দিলেন যে, ‘‘কেন একজন মেধাবী ছাত্র দশটা বেসরকারি জায়গায় কাজ করবে! সে তো একটা জায়গায় কাজ করতে চায়, যেখানে যে কাজ করবে, ছাত্রও পড়াবে, এবং পরিকাঠামো নিয়ে খুশি থাকবে৷ কিন্তু সেই সুযোগটা নেই৷ গাদাগাদা মেডিকেল কলেজ খোলার থেকে যদি একটা সেন্টার অফ এক্সেলেন্স করতে পারি, তা হলে সবাই সেখানে যেতে সাহস পাবে!’’