মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ৷ কিন্তু সে অনুযায়ী কি এগিয়েছে আর্থিক খাত? বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত এখন খুবই করুণ অবস্থায় আছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলে:বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সার্বিক চিত্র এই মুহূর্তে কেমন বলে মনে করেন আপনি?
এম এম আকাশ: বেশ হতাশাজনক৷ এমনকি কোনো কোনো ব্যাংক তো একেবারে আতঙ্কজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷ এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংক একটা৷ এটা তো দেউলিয়া হবে কি হবে না, এই পর্যায়ে পৌঁছে গেছে৷
আর খেলাপী ঋণের পরিমাণ মতান্তরে ৭১ হাজার কোটি টাকা, কেউ কেউ বলে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা৷ এই পরিমাণ খেলাপী ঋণ থাকলে এবং আপনার টোটাল আউটস্ট্যান্ডিং ঋণের ১০ পার্সেন্ট খেলেপী ঋণ হয়ে গেলে, যেটা উপমহাদেশের অন্যান্য জায়গায় ৩-৫ শতাংশ৷ সুতরাং এটা তো খুবই আতঙ্কজনক এবং হতাশাজনক৷
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে একের পর এক অনিয়ম ধরা পড়ছে৷ কেন্দ্রীয় ব্যংকের ভূমিকা এখানে কী?
দেখুন, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর পরিচালনা এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক কর্তৃত্বাধীন নেই৷ এটা পরিচালনার দায়িত্ব চলে গেছে ফিন্যান্স মিনিস্ট্রির ব্যাংকিং বিভাগের অধীনে৷ তাঁরা বলছে, রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকের মালিক সরকার, সুতরাং সরকার এটা পরিচালনা এবং দেখভালের দায়িত্ব নেবে৷ সেইভাবে ওখানে আলাদা একটা ব্যাংকিং বিভাগ খুলে এর দায়িত্ব নিয়েছে৷ কিন্তু দ্বৈত কর্তৃত্বের কারণে, যখন কোনো অনিয়ম হচ্ছে, তখন একে অপরকে দোষারোপ করার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে৷ সেই সুযোগে অপরাধীরা মাফ পেয়ে যাচ্ছে৷
এম এম আকাশ
প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর ওপর কেন্দ্রের নজরদারি কেমন?
প্রাইভেট ব্যাংকগুলোর পরিচালনা বোর্ড গঠনেই গলদ আছে৷ পরবর্তীতে এই দফায় কিছুটা সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে৷ কিন্তু তারপরও আমার ধারণা অদক্ষ-অপেশাদার সরকারি দলের সঙ্গে সংযুক্ত এমন লোকের আধিপত্যই বেশি৷ ফলে তাঁরা যে দায়িত্বটা পালন করার কথা, তা ঠিকমতো পালন করছে না৷ আমি বলছি না যে দুর্নীতিবাজ সবাই৷ কিন্তু ব্যাংকের বোর্ডে তো পেশাদার দক্ষ লোকজনকে নিয়োগ দিতে হবে৷ সেখানে তো অন্যধরনের লোক নিয়োগ সুবিধা হবে না৷
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেছেন, ব্যাংকের কার্যক্রমে মানুষের মনে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে৷ এই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার উপায় কী?
যেসব রাঘববোয়ালরা দুর্নীতি করেছে এবং খেলাপী ঋণ করেছে তাদের এই খেলাপী ঋণ এবং দুর্নীতির সঙ্গে যেসব ব্যাংক কর্মচারীরা, রাজনীতিবিদরা এবং সরকারি কর্মচারীরা জড়িত আছেন, তাদেরকে শাস্তি দিতে হবে৷ রাঘববোয়ালদের বাধ্য করতে হবে ঋণ পরিশোধে৷ যদি এ ধরনের কিছু শাস্তি দেয়া যায়, তাহলে হয়তো মানুষের আস্থা ফিরে পাওয়া যাবে এবং ব্যাংকগুলো তখন শৃঙ্খলার মধ্যে আসতে শুরু করবে৷
ব্যাংক খাতের নানা কেলেঙ্কারি
রাজনীতি, অর্থ, পেশি শক্তি, অপকৌশল, দুর্নীতি – এ সব নানা কারণে বারবারই বিপদের মুখে পড়েছে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত৷ ব্যাংক খাতে নানা সময়ে সংঘটিত কেলেঙ্কারির খবর দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance / Klaus Ohlenschläger
রিজার্ভের অর্থ উধাও
২০১৬ সালে ঘটে বাংলাদেশের ব্যাংকিং ইতিহাসের সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা৷ অজ্ঞাতনামা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অফ নিউ ইয়র্কে রক্ষিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কায় পাচার করে দেয়৷ ফিলিপিন্সে পাচার করা ৮.১ কোটি ডলারের এখনো কোনো সুরাহা হয়নি৷ এ ঘটনার পর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Reuters/A. Rahman
জালিয়াতের খপ্পরে এটিএম কার্ড
‘স্কিমিং ডিভাইস’ নামের বিশেষ এক যন্ত্র বসিয়ে গ্রাহকদের কার্ডের ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালে৷ চুরি করে তারা এর সঙ্গে এক জার্মান নাগরিক জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়৷ প্রতারকদের আটক করা হলেও তারা বিভিন্ন ব্যাংকের বুথ থেকে দুই দিনেই অন্তত ২০ লাখ টাকা তুলে নেয়৷
ছবি: bdnews24.com
হলমার্ক কেলেঙ্কারি
২০১২ সালে এই চাঞ্চল্যকর ঘটনা ফাঁস হয়৷ সে সময় কেবল সোনালী ব্যাংকের শেরাটন শাখা থেকে ২০১০-২০১২ সময়ে মোট তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়৷ এর মধ্যে অখ্যাত হলমার্ক গ্রুপ একাই আত্মসাৎ করে ২ হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা৷ তখন তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়, সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়নি৷
ছবি: DW
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতি
রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আব্দুল হাই বাচ্চু পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাংকটি অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়৷ ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ব্যাংকটিতে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পায় বাংলাদেশ ব্যাংক৷ ব্যাংকের টাকা মেরে দিতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অনেক ভুয়া প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়া হয়৷ এসব ঋণের বেশিরভাগই আর ব্যাংকে ফেরত আসেনি৷
ছবি: bdnews24.com
ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে লুটপাট
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০৫ সালে ঘটে এই ঘটনা৷ ব্যাংকটির তৎকালীন উদ্যোক্তারা অনিয়মের মাধ্যমে হাতিয়ে নেন প্রায় ৬০০ কোটি টাকা৷ লুটপাটের কারণে ২০০৬ সালে ব্যাংকটি অতিরুগ্ন হয়ে পড়ে৷ মালিকপক্ষের হাতে থাকা ব্যাংকের ৮৬ শতাংশ শেয়ারও বাজেয়াপ্ত করা হয়৷ তা কিনে নেয় আইসিবি গ্রুপ৷ তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তিত হয়ে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক হয়, তবে এখনো পুরো টাকা ফেরত পাননি গ্রাহকেরা৷
ছবি: imago/Milestone Media
ফারমার্স ব্যাংকে অনিয়ম
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনুমোদন দেয়া একটি ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংক৷ সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম খা আলমগীর, অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দীকী নাজমুলের মালিকানাধীন বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ছয়টি শাখায় প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ঋণ অনিয়ম পাওয়া যায়৷ এতে জনগণের সংরক্ষিত আমানত ফেরত দিতে অক্ষম হয়ে পড়ে ব্যাংকটি৷
ছবি: bdnews24.com
লুটপাটের অন্ত নেই
নতুন এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকে ৭৪১ কোটি টাকার ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম দেখা যায়৷ ২০১০-২০১৫ সালে আইন লঙ্ঘন করে অ্যাননটেক্স নামে একটি গ্রুপকে ৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার ফান্ডেড, নন-ফান্ডেড ঋণ প্রদান করে জনতা ব্যাংক৷ বিসমিল্লাহ গ্রুপ ২০১১ ও ২০১২ সালে দেশের পাঁচটি ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়৷
ছবি: DW
আরো আছে অনেক
এখানেই শেষ নয়৷ সময়ে সময়ে বিভিন্ন সরকারের আমলে নানান অভিনব কৌশলে ভূয়া চুক্তিপত্র দেখিয়ে, কিংবা এক কাজে ঋণ নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার অসংখ্য নজির আছে দেশে৷ তাই নানা সময়ে বিপাকে পড়েছে ব্যাংক খাত৷ শুধু তাই নয়, শেয়ার বাজারকে নানা সময়ে অতিমূল্যায়িত করে ব্যাংক খাতের ওপর ভয়াবহ চাপ তৈরি করা হয়েছে৷
ছবি: picture alliance / Photoshot
8 ছবি1 | 8
অনেকেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার পর দেশের আর্থিক খাত ঢেলে সাজানোর কথা বলছেন৷ আপনার প্রস্তাব কী?
প্রথমত, পরিচালনা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে আমি যে ত্রুটিগুলার কথা বললাম সেগুলো দূর করা৷ তারপর, সোজা কথা, নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হবে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ এবং তাকে চূড়ান্ত ক্ষমতা দিতে হবে এবং পেশাদারি দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের এই দায়িত্বে নিয়োগ করতে হবে৷ সেরকম লোক আছে বাংলাদেশ ব্যাংকে, তাঁরা সেসব দক্ষ লোকদের দায়িত্ব দিতে পারে৷ তাঁদের যদি ফিল্ড ভিজিট করে ইন্সট্যান্ট ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার দেয়া যায়, এবং তাঁরা যদি একই সাথে পাবলিক ব্যাংক এবং প্রাইভেট ব্যাংকের দেখভাল করার দায়িত্ব পায়৷
যেমন ভারতে রিজার্ভ ব্যাংক যেসব নীতিতে চলে এবং যেসব ক্ষমতা নিয়ে চলে, সেরকম নীতি ও ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংককে দিলে এখনও একটা সম্ভাবনা আছে অ্যকাউন্টেবিলিটি নিশ্চিত হবে এবং ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে৷ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশ হওয়ার জন্য যে ধরনের ফিনানশিয়াল সিস্টেম দরকার, সেটা আমরা পাবো৷
অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশের সাক্ষাৎকারটি কেমন লাগলো? লিখুন নীচের ঘরে৷