রাস্তায় বেরিয়ে বোতল জল কেনার অভ্যাস অনেকেরই৷ মনে করা হয় ওই জল সবচেয়ে নিরাপদ৷ কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেখানেও লুকিয়ে আছে মাইক্রোপ্লাস্টিক৷
বিজ্ঞাপন
রাস্তায় বেরিয়েই দোকান থেকে পানির বোতল কিনে ফেলার অভ্যাস প্রায় সকলেরই কমবেশি আছে৷ অনেক দেশেই বোতলের জলকে মনে করা হয় নিরাপদ৷ বেড়াতে গিয়ে বহু পর্যটক বোতলের জলের ওপরেই নির্ভর করেন৷ কিন্তু সেই জলের সঙ্গে পেটের ভেতর চলে যাচ্ছে না তো বিষাক্ত প্লাস্টিক? সম্প্রতি এক সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে এসেছে৷
একটি প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি ৯টি দেশের ১৯টি অঞ্চলের ১১ রকমের জলের বোতল সংগ্রহ করে৷ পরীক্ষা করে দেখা যায়, সংগৃহীত বোতলের ৯৩ শতাংশ জলেই মাইক্রো প্লাস্টিক আছে৷ অর্থাৎ, যে জল বিশুদ্ধ ভেবে আমরা পান করছি, তা-ও মোটেই নিরাপদ নয়৷ জলে মিশে রয়েছে অসংখ্য মাইক্রো প্লাস্টিক৷
অজান্তেই পেটে যাচ্ছে প্লাস্টিক
প্লাস্টিকের ছোট ছোট অংশ প্রতিদিন আমাদের পেটে ঢুকছে৷ জানতেও পারছি না আমরা৷ গায়ে মাখার ক্রিম থেকে খাবার, প্লাস্টিক সর্বত্র৷ তেমনই কিছু খাবারের সন্ধান দেওয়া হলো এই ছবিঘরে৷
ছবি: picture alliance/JOKER/A. Stein
মুখভর্তি প্লাস্টিক
৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট প্লাস্টিকের অংশকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ ছোট ছোট এই প্লাস্টিকের অংশ গিয়ে মিশছে সমুদ্রে৷ ঢুকে পড়ছে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য সামগ্রীতে৷ শুধু তাই নয়, বাতাসেও ছড়িয়ে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ টুথপেস্ট থেকে ক্রিম, মাছ থেকে জল সর্বত্র মাইক্রোপ্লাস্টিক৷
ছবি: picture-alliance/dpa/S. Sauer
প্লাস্টিক দিয়ে মুখ ধোয়া
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, কোনো কোনো কসমেটিকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়৷ কখনো কখনো যার পরিমাণ প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের সমপরিমাণ বা তার চেয়েও বেশি৷ কিন্তু আপাত চোখে কসমেটিকে প্লাস্টিক দেখা যায় না৷ তা লুকিয়ে থাকে ক্রিম বা টুথপেস্টের মধ্যে৷ ব্যবহার করলে কিছু অংশ ঢুকে যায় দেহের ভিতর৷ বাকি অংশ চলে যায় ড্রেনে৷
ছবি: picture-alliance/empics/Y. Mok
পানিতেও প্লাস্টিক
ড্রেনের জলে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক পৌঁছে যায় সমুদ্রে৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সমুদ্রে গিয়ে মেশা প্লাস্টিক ঢুকে যায় জলজ উদ্ভিদে৷ মাছ সেই উদ্ভিদ খায়৷ ফলে তাদের শরীরেও পৌঁছে যাচ্ছে বিপুল পরিমাণ মাইক্রোপ্লাস্টিক৷ ২০১৭ সালের একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বাজারের ২৫ শতাংশ মাছের শরীরে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অংশ রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Anka Agency International
এমনকি লবণেও...
২০১৭ সালে ইউরোপ, অ্যামেরিকা এবং চিনে একটি যৌথ গবেষণা হয়েছিল৷ তার রিপোর্টে বলা হয়, শুধু মাছ নয়, সমুদ্র উপকূল থেকে সংগৃহীত নুনের মধ্যেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে৷ তার কারণও আছে৷ প্রতি বছর প্রায় ১২ মিলিয়ন প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রে গিয়ে মেশে৷ ফলে উপকূলবর্তী নুনেও তার অংশবিশেষ মিশে যায়৷
ছবি: picture alliance/Bildagentur-online/Tetra
নিরাপদ নয় মধু
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন জানিয়েছে, মধুতে প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে৷ এ কারণে মধু নিষিদ্ধ করারও একটি পরিকল্পনা হয়েছে৷ কিন্তু মধুতে কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশছে, সে বিষয়ে এখনো পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি৷
ছবি: Colourbox
জামা নয়, প্লাস্টিক
সুতি নয়, কিন্তু সিন্থেটিক জামায় প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকে৷ কাপড় ধোয়ার সময় সেই প্লাস্টিক জামা থেকে বেরিয়ে ড্রেনের পানিতে গিয়ে মেশে৷ পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৬ কিলোগ্রাম সিন্থেটিক জামা কাচলে তার থেকে ৭ লক্ষ প্লাস্টিক ফাইবার নির্গত হয়৷ ড্রেনের জলের মাধ্যমে তা গিয়ে পৌঁছায় সমুদ্রে৷ বস্তুত, সমুদ্রের জলে প্লাস্টিকের মোট পরিমাণের এক তৃতীয়াংশই জামা কাপড়ের মাইক্রোপ্লাস্টিক৷
ছবি: Imago/Mint Images
চাকায় প্লাস্টিক
গাড়ির চাকা থেকেও প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক পরিবেশে গিয়ে মেশে৷ রবারের সঙ্গে সিন্থেটিক পলিমার মিশিয়ে তৈরি হয় গাড়ির টায়ার৷ রাস্তার সঙ্গে টায়ারের ঘর্ষণে সেই সিন্থেটিক পলিমার থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক রাস্তায় গিয়ে মেশে৷ কখনো বা বাতাসেও মিশে যায়৷ নরওয়ে এবং সুইডেনের বিভিন্ন পরীক্ষায় ধরা পড়েছে, সমুদ্র থেকে পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের একটা বড় অংশ গাড়ির চাকার পলিমার৷
ছবি: Colourbox/Akhararat
কল খুললেও প্লাস্টিক
কলের পানিতেও মিশে থাকছে প্লাস্টিক৷ বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশ থেকে কলের জল সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অন্তত ৮০ শতাংশ নমুনাতেই মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কলের পানিতেই প্লাস্টিক থাকলে যে কোনো খাবারেই তা সহজে মিশে যেতে পারে৷
ছবি: Imago/Westend61
বিয়ারেও ভয়
কলের পানিতেই যদি প্লাস্টিক থাকে, বিয়ারেও যে থাকবে, তা তো স্বাভাবিক! ২০১৪ সালের একটি পরীক্ষা থেকে জানা গেছে, ২৪টি জার্মান বিয়ারে প্লাস্টিক মিশে আছে৷ যদিও জার্মানির পরিবেশ সংক্রান্ত দফতর জানিয়েছে, এ বিষয়ে আরো গবেষণার প্রয়োজন আছে৷
ছবি: picture alliance/PIXSELL/Z. Basic
9 ছবি1 | 9
বিজ্ঞানীরা ইদানীং মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে নানাবিধ পরীক্ষা চালাচ্ছেন৷ আদৌ মাইক্রো প্লাস্টিক মানুষের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর কিনা, ক্ষতিকর হলেও ঠিক কতটা, এ সমস্ত বিষয় নিয়ে লাগাতার গবেষণা চলছে৷ অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর এবং বিজ্ঞানী রোলফ হালডেন বহুদিন ধরেই মাইক্রো প্লাস্টিক নিয়ে কাজ করছেন৷ তাঁর বক্তব্য, মাইক্রো প্লাস্টিক রক্তধারায় গিয়ে মিশছে, এমন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি৷ তবে যে মাইক্রো প্লাস্টিক শরীরে ঢুকছে,তা আদৌ কোনো ক্ষতি করছে কিনা, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত নন তিনি৷
আমস্টারডামের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী হিথার লেসলি ইঁদুরের ওপর মাইক্রো প্লাস্টিকের একটি পরীক্ষা শুরু করেছেন৷ ২৮ দিন ধরে ইঁদুরদের শরীরে প্রচুর মাইক্রো প্লাস্টিক ঢোকানো হয়েছে৷ এখনো সেই ইঁদুরগুলিকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে৷ তবে লেসলি জানিয়েছেন, ভয়াবহ কোনো লক্ষণ এখনো দেখা যায়নি৷ অর্থাৎ, ইঁদুরগুলির শরীরে মাইক্রো প্লাস্টিক সেভাবে কোনো প্রভাব ফেলেনি৷ তবে আরো বেশ কিছুদিন ইঁদুরগুলিকে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলেও জানিয়েছেন লেসলি৷
২০১২ সালে গোটা বিশ্বে ২৮৮ বিলিয়ন লিটার বোতলবন্দি জল বিক্রি হয়েছিল৷ ২০১৭ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৯১ বিলিয়ন লিটার৷ এখনো পর্যন্ত জলের বোতলের মাইক্রো প্লাস্টিকে ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি৷কিন্তু যদি অদূর ভবিষ্যতে তেমন কিছু মেলে,তাহলে তা কত মানুষকে আক্রান্ত করবে, তা ভেবেই চিন্তিত বিজ্ঞানীরা৷ প্লাস্টিকের বোতলে জল বিক্রি নিষিদ্ধ করা উচিত কি না, তা নিয়েও ইতিমধ্যেই আলোচনা শুরু হয়েছে কোনো কোনো মহলে৷
প্লাস্টিকের পানির বোতলের জীবন
সারা বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বোতল পানি বিক্রি হয়৷ কিন্তু পানি পান করার পর প্লাস্টিকের ঐ বোতলগুলোর কী হয় তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত৷
ছবি: Fotolia/zhekos
প্লাস্টিকের দামই বেশি
এক বোতল পানি কেনার জন্য আপনি যে দাম দেন তার বেশিরভাগই কিন্তু চলে যায় প্লাস্টিকের জন্য৷ এছাড়া রয়েছে বোতলের গায়ে লেবেল লাগানো, পরিবহণ, সংরক্ষণ ও বোতল নষ্ট করে ফেলার খরচ৷
ছবি: Fotolia/fottoo
তেলের ব্যবহার
অশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয় পলিইথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) প্লাস্টিক৷ এরপর সেটা দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিকের বোতল৷ এই তেল উৎপাদনের সময় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়৷ এছাড়া প্লাস্টিক তৈরির সময় বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ ছবিতে জার্মানির সবচেয়ে বড় তেলশোধন প্ল্যান্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বড়ি থেকে বোতল
পরিশোধিত তেল থেকে প্রথমে প্লাস্টিকের এমন ছোট ছোট বড়ি তৈরি করা হয়৷ এরপর সেগুলোকে গলিয়ে বোতল তৈরি করা হয়৷
ছবি: Fotolia/digitalstock
চারে এক
আর্থ পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সারা বিশ্বে উৎপাদিত চারটি পানির বোতলের অন্তত একটি ক্রেতার খোঁজে কমপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে৷ অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়৷ এভাবে পানি পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত যানবাহন থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পানি সংকট
প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের হিসেবে এক বোতল পানির জন্য তিনগুণ বেশি পানি খরচ হয়৷ ফলে যে অঞ্চলে পানির ফ্যাক্টরি অবস্থিত সেখানকার ভূগর্ভে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র অর্ধেক
এক হিসেবে জানা গেছে, ইউরোপে গত বছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করা হয়৷ পরিমাণটা, যত বোতল ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্ধেকের কিছু বেশি৷ বাকি বোতলগুলো বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে বিশেষ করে জলাধার ও সাগরে পড়ে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: JOSEPH EID/AFP/Getty Images
রিসাইক্লিং
ব্যবহার হওয়ার পর পানির বোতলগুলো রিসাইকেল করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়৷ যেমন এক ধরণের পশম, যেটা শীতবস্ত্র জাতীয় পোশাক তৈরিতে কাজে লাগে৷